শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনার টিকা যাদের প্রয়োজন তাদের দেয়া উচিত

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০৩ এএম

সরকার ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে করোনা টিকা কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করতে যাচ্ছে। তার আগে আজ বুধবার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একজন নার্সকে টিকা প্রদানের মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামীকাল রাজধানীর পাঁচটি হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ‘কোভিশিল্ড’ নামে এই টিকা দিয়ে দেশে টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। এরপর পর্যায়ক্রমে বৈশ্বিক উদ্যোগের কোভ্যাক্সসহ অন্যান্য দেশ থেকে টিকা আনা হবে। তবে শুরুতেই ভাতের টিকা প্রদান এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে জনমনে নানা দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এ টিকা প্রদানের পর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞদের মতামতেও উঠে এসেছে। এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতেও এসব প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ভ্যাকসিন নেয়ার পর কারো কারো ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন ভ্যাকসিন প্রয়োগের জায়গায় ফুলে যাওয়া, সামান্য জ্বর হওয়া, বমি বমি ভাব, মাথা ও শরীর ব্যথা হতে পারে। লক্ষণগুলো সাধারণত দুই-একদিন থাকতে পারে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর টিকা গ্রহণের আগে গ্রহীতাকে একটি সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করার ফর্মও তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘এই টিকা গ্রহণের সময় অথবা পরে যেকোনো অসুস্থতা, আঘাত বা ক্ষতি হলে তার দায়ভার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা সরকারের নায়।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও টিকা গ্রহীতার সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর টিকা গ্রহণে মানুষকে অনাগ্রহী ও ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলবে।

গত কয়েক দিন ধরে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে জনমনে এক ধরনের সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়েছে। অনেককে বলতে দেখা গেছে, এই টিকা ভারত পরীক্ষা করার জন্য দিয়েছে। আমাদের এখানে আগে পাঠালো কেন। এছাড়া টিকা কে আগে নেবে, কে পরে নেবে, এ নিয়ে নানা কথাবার্তা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি। বিরোধী দল বলছে, এই টিকা প্রদান আগে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করা হোক। এতে জনগণের মধ্যে সৃষ্ট সংশয় দূর হবে। অন্যদিকে, সরকারের এক মন্ত্রী বলেছেন, এই টিকা আগে বিএনপিকে দেয়া হবে। তার কথার জবাবে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, সরকার বিএনপির নেতা-কর্মীদের গুম-খুন, হামলা-মামলা করে নিধন করার চেষ্টা করেছিল। এখন বিএনপিকে আগে টিকা দিয়ে নিধনের চেষ্টা করা হচ্ছে। টিকা নিয়ে জনমনে সংশয় সৃষ্টির পাশাপাশি এ ধরনের রাজনীতি পুরো টিকা প্রদান কার্যক্রমে এক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়েছে। এর উপর টিকার কার্যকারিতা এবং এর স্থায়ীত্ব নিয়ে সঠিক তথ্য তুলে না ধরার বিষয়টিও পরিস্কার করা হয়নি। এই টিকাা কি জন্য, বা মানব দেহে তা কি কাজ করবে? এটা কি রোগ ভাল করার অষুধ না রোগ প্রতিরোধ করার? যার করোনা হয়েছে সে টিকা নিতে পারবে কিনা বা ভাল হয়ে যাবে কিনা? এই টিকা যে নেবে জীবনে তার আর করোনা হবে কিনা? সরকারিভাবে এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, টিকা নেয়ার আগে গ্রহীতাকে বন্ডসই দিতে হবে। সে অসুস্থ হয়ে পড়লে এর দায় সরকার নেবে না। এই যদি হয় টিকার পরিস্থিতি, তাহলে মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি না হয়ে কি উপায় আছে? একজন সুস্থ মানুষ স্বেচ্ছায় গিয়ে বন্ডসই দিয়ে কি এই টিকা নেবে? আমাদের দেশে পুরোপুরি নিরাপদ হাম, পোলিও থেকে শুরু করে অন্যান্য যেসব রোগ প্রতিরোধক টিকা দেয়া হয়, সেসব টিকা নিতেই মানুষের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। ছোটবেলা দেখেছি, স্কুলে টিকা প্রদানকারী দল হাজির হলেই শিক্ষার্থীরা ভয়ে স্কুল থেকে পালিয়ে যেত। আর করোনার মতো ভয়াবহ একটি রোগের টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের সংশয় ও ভীতি তৈরি হয়েছে, তাতে মানুষ উৎসাহী হয়ে টিকা নেবে, এমন মনোভাব এখনও তৈরি হয়নি। এর একটি কারণ হচ্ছে, মানুষ ইতোমধ্যে জেনে গেছে, যে টিকাটি দেয়া হচ্ছে তা ‘ফার্স্ট জেনারেশন’ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ যেটি প্রয়োগ করা হবে তা ‘চতুর্থ ট্রায়াল’। তার মানে হচ্ছে, টিকাটি এখনও পুরোপুরি ম্যাচিউর হয়নি। না হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, যেকোনো রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে তা নিরাপদ করতে একযুগের বেশি সময় লেগে যায়। সেক্ষেত্রে, করোনার মতো ভয়াবহ একটি রোগের টিকা এক বছরেরও কম সময়ে আবিষ্কার করে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকাই স্বাভাবিক। তবে এই উদ্ভাবিত টিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। এটি একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের এবং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার টিকা। যত দিন যাবে, এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে তার দূর করে কার্যকর করে তুলবে। এখানেই টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিধা-দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিক এই টিকা নিয়ে অনেক আগে থেকেই কিছু কথা প্রচলিত। কথাগুলো হচ্ছে, ক). এই টিকার প্রধান কাজ দেহে এন্টিবডি তৈরী করা বা করোনা ভাইরাস ঠেকাতে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, খ). যারা ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের শরীরে এই ভ্যাকসিন কাজ করবে না, গ). নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পর পর দুইটি ডোজ না নেওয়া পর্যন্ত এর পূর্ণ কার্যকরিতা পাওয়া যাবে না, ঘ). সকলের জন্য এই টিকা নয়, বিশেষ করে যাদের শরীরে নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ আছে তাদের নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা হিতে বীপরিত হওয়ার আশংকা আছে, ঙ). এই ভ্যাকসিন করোনা থেকে বেঁচে যাওয়ার কোন গ্যারান্টিও নয়। এটা হচ্ছে, এক ধরনের প্রতিরোধক। সবার শরীরে যে এটি সমানভাবে কাজ করবে তাও না। তারপরও টিকাটি নেয়া মুলত: এক ধরনের প্রতিরোধ প্রস্তুতি হিসাবে। এই কথাগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না।

শুরুতে টিকা কবে আসবে এ নিয়ে যেমন আগ্রহ ছিল তেমিনি আসলে সঙ্গে সঙ্গে টিকা নেয়ার মনোভাবও জনমনে সৃষ্টি হয়েছিল। দ্রæততম সময়ে টিকা আবিষ্কারের কথা শুনে সবাই আশ্বস্থ হয়েছিল। তবে ভারতের টিকা আসা এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানার পর মানুষের উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়েছে। সা¤প্রতিক সময়ে দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি, সংক্রমণের হার নিস্নমুখী এবং মৃত্যুহার কমে যাওয়াও মানুষের মধ্যে আগ্রহ কমেছে। এর মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সংশয় থাকাই স্বাভাবিক। মাস্ক পরিধান করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা একজন সুস্থ মানুষ চাইবে না, টিকা নিয়ে সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ অজানা অন্য কঠিন প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পড়ে অসুস্থ হোক। তবে করোনা প্রতিরোধে টিকা নেয়া অবশ্যই উচিত। ইংল্যান্ড থেকে যে নতুন প্রজাতির করোনার সংক্রমণ হয়েছে তা দেশে প্রবেশ করলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে, আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে দেহে এন্টিবডি তৈরী করা দরকার। এই এন্টিবডি তৈরীর জন্যই টিকা নেয়া প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের শরীরে ইতিমধ্যেই এন্টিবডি তৈরী হয়েছে, তাদেরও কি টিকা নিতে হবে, নাকি সবাইকেই নিতে হবে? এ বিষয়টি পরিস্কার করা হয়নি। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাছ-বিচার না করেই যে চায় তাকেই দিয়ে দাও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, যাদের দেহে ইতিমধ্যেই এন্টিবডি তৈরী হয়ে আছে, তাদের ভ্যাকসিন নেয়ার দরকার নাই। কার শরীরে এন্টিবডি নাই তা এন্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়। দেশে শুরু থেকেই তা নিয়ে এক ধরনের লুকোচুরি বা রাখঢাক ছিল। গনস্বাস্থ্য কেন্দ্র অনেক আগেই এই কীট তৈরী করে। সরকার তার অনুমোদন দেয় নাই। অবশেষে, কযেক দিন আগে অনুমতি দিয়েছে। শুরুতে দিলে কি এমন ক্ষতি হতো? তাতে কি করোনা সামাল দেয়ার বিষয়টি দ্রুত হতো না? টিকার জন্যও এতো অপেক্ষা করতে হতো না। এমনকি টিকা নিয়ে হুলুস্থুল কান্ডও ঘটত না। এখন তো টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই। বরং টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভীতি সৃষ্টি করেছে। দেখা যাবে, টিকা কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হলে ভীতির কারণে অনেকে টিকা নিতে যাবে না। এক্ষেত্রে, যেনতেনভাবে বা অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো বা আবেগী না হয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে টিকা কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। করোনার দশ মাসে বোঝা গেছে, সাধারনভাবে আমাদের দেশের মানুষের দেহের ইমিউন ব্যবস্থা ভাল। প্রাকৃতিকভাবেই শরীরে এন্টিবডি তৈরী হয়ে আছে। এ অবস্থায় টিকা তাদেরই দিতে হবে, শুধু যাদের দরকার। টিকা দেয়ার আগে এন্টিজেন টেস্ট বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। এতে টিকা নিতে হবে কি হবে না, তা জানা যাবে। তখন যার প্রয়োজন, সে টিকা নিতে আগ্রহী হবে। এছাড়া গ্রহীতার অন্যান্য শারীরিক সমস্যা আছে কিনা, তা জেনে নেয়া উচিত। এর ফলে টিকার যেমন সাশ্রয় হবে, তেমনি আমদানি খরচও কমবে এবং জনগণের অর্থ বাঁচবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন