বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনাকালীন বাস্তবতা এবং শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রত্যাশা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০৩ এএম

আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে পদার্পণ করেছি। দীর্ঘ ৫০ বছরের পথ পরিক্রমার পর বাংলাদেশ এখনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে পারেনি। আমাদের পূর্বসুরী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যে স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের জীবন বাজি রেখে ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন, যে লাখো মানুষ স্বাধীনতা লড়াইয়ে জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন, তাদের স্বপ্ন ছিল শোষন ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। পঞ্চাশ বছর পেরিয়েও সে স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে। জাগতিক ও বৈশ্বিক নিয়মে ও প্রভাবে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও গড় আয়ু বেড়েছে। এসব উন্নয়ন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের আত্মতুষ্টি, বেøইমগেম থেকে উন্নয়নের সম্ভাবনা ও ব্যর্থতা উঠে আসে। আমরা যখন এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উর্ত্তীণ হওয়ার জন্য প্রতীক্ষায় আছি, তখন আমাদের আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের অবস্থান কোথায়, তার তুলনামূলক পর্যালোচনা করলেই ব্যর্থতাগুলো ধরা পড়ে। শুধুমাত্র জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব দিয়ে কোনো জাতির উন্নয়নের মাপকাঠি নিরূপণ করা যায় না। এক সময়ের প্যারিয়াহ স্টেট হিসেবে পরিচিত মায়ানমার প্রায় তিন দশক ধরে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন থেকেও যখন বাংলাদেশের সম্প্রীতিমূলক অবস্থানকে পাত্তা না দিয়ে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব আহবানও দাবী উপেক্ষা করে বাংলাদেশের প্রতি এক ধরনের আগ্রাসী মনোভাব দেখানোর সাহস দেখায়, নিকটতম প্রতিবেশী ভারত বন্ধুত্বের কথা বলে বাংলাদেশের কাছ থেকে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সব সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেয়ার পরও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে টালবাহানা করে, বাণিজ্য বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে, সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিদের হত্যা করছে, নতুন নাগরিকত্ব আইনের নামে আসামের লাখ লাখ লাখ বাংলাভাষী মুসলমানকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশের আঞ্চলিক অবস্থান ও মর্যাদা কোথায় তা ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে নির্নয় করা খুব কঠিন নয়।

করোনাকালীন সমাজবাস্তবতা পুরো বিশ্বের সামাজিক-অর্থনৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিগুলোকে নাড়িয়ে দিয়েছে। একটি ভাইরাসের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিল, গত এক বছরে তা অনেকটা গা-সহা হয়ে গেলেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এখনো সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিনের সফল ট্রায়াল শেষে বাণিজ্যিক উৎপাদন ও প্রয়োগ শুরু হলেও ভ্যাকসিনেশনের সাফল্য সম্পর্কে শেষকথা বলার সময় এখনো হয়নি। তবে করোনাকালীন বাস্তবতা আমাদের জন্য যে মেসেজ রেখে গেলো তা যদি আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের সভ্যতা, প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো দাবিকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারব না। এই করোনাকালে আমাদের চিরায়ত পারিবারিক বন্ধন, স্নেহমমতা ও ত্যাগের শিক্ষা, নাগরিক দায়িত্ববোধ এবং পারলৌকিক জবাবদিহিতার আত্মোপলব্ধির জায়গাগুলো নতুনভাবে ফোকাস হয়েছে। সেখানে একরাশ হতাশা ও অন্ধকার যেমন দেখা গেছে, সেই সাথে অনেক আলোর ঝলকানিও দেখা গেছে। করোনা সংক্রমিত হওয়া শতকরা ৯৫ জনই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। আমাদের দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার শতকরা ২ ভাগের বেশি নয়। করোনা শুরুতেও এ হার খুব বেশি ছিল না। তথাপি আমরা দেখলাম, করোনা সন্দেহে সন্তানরা মাকে, বাবাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, সন্তানরা বাবার সাথে শেষ দেখা করতেও হাসপাতালে যাচ্ছে না, সজনের লাশ দাফন করতে কেউ এগিয়ে আসছে না। মুনাফার জন্য ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা হাজার হাজার বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতাল ও ডাক্তারদের পরিষেবা কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়া, করোনা টেস্টের নামে কতিপয় হাসপাতাল ও ব্যক্তির কোটি কোটি টাকার প্রতারণা বাণিজ্য এবং করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য সরকারি ক্রয় ক্ষেত্রে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির চিত্রও আড়াল করা যায়নি। এসব ঘটনা সমাজের ভেতরকার মূল্যবোধের ভয়াবহ অবক্ষয়,
স্নেহমমতা ও আত্মিক বন্ধনগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার বাস্তব উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতিবেশী দেশের কূটচালে জড়িয়ে পড়া, চীনা ভ্যাকসিন ঠেকাতে দেশি-বিদেশি কুশীলবদের নেপথ্য চালবাজি অতঃপর বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার বাস্তবতা থেকে পুরো জাতি যে মেসেজ পেয়েছে তা সুখকর নয়। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় পিছিয়ে পড়লে তা যেকোনো জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, করোনা পরীক্ষায় জালিয়াতি ধরা পড়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ এবং বিমান সংস্থা এখনো বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণ এবং যাত্রী পরিবহন বন্ধ রেখেছে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং রেমিটেন্স আয়ের উপর বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত গত প্রায় ১ বছরে আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১০ হাজারের কম। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চললেও এ সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। করোনায় যতটা না মানুষের সংক্রমণ ও মৃত্যু ঘটেছে, এর সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর একটু সেবা পেলে হয়তো ভাল হয়ে যেতে পারতো এমন ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার বদলে বাসায় কোনো এক ঘরে তালাবদ্ধ করে অন্য সদস্যদের অন্যত্র সরে যাওয়া অথবা মুমূর্ষু হয়ে পুলিশের সহায়তায় হাসপাতালে নেয়ার অনেক উদাহরণ আছে। আবার কোনো বাসায় করোনা রোগী আছে এমন তথ্য বা গুজবে ভর করে সে বাড়িতে হামলা করে লোকজনদের তাড়িয়ে দেয়ার মত অমানবিক উদাহরণও কম নেই। করোনার চিকিৎসা ও ভ্যাকসিনেশন এখন সবার জন্য উন্মুক্ত না হলেও সে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি এখন আর নেই। তবে করোনাকালীন সমাজবাস্তবতা থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয়, অনেক কিছু করণীয় রয়েছে, এতদিন এসব সামাজিক- মনস্তাত্তি¡ক বিষয়গুলো নিয়ে তেমন একটা বিচার বিশ্লেষণ হয়নি বললেই চলে। করোনাকালীন বাস্তবতার আলোকে পরবর্তী সময়ের শিক্ষা ও সমাজবাস্তবতায় মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও অবক্ষয়ের এই দিকগুলোর অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে সন্নিবেশিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ এ সময়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে ঘরে বসেছিলেন, আগামী দিনে তাদের লাইসেন্স দেয়া বা নবায়নের ক্ষেত্রে বাড়তি শর্ত আরোপ করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মহামারীর সময়ে যদি হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়, আক্রমণ বা সংক্রমণের ভয়ে ডাক্তার-নার্সরা ঘরবন্দি হয়ে আরাম-আয়েশে দিন যাপনে ব্যস্ত থাকেন, তবে তা সমাজের অবক্ষয়-অধঃপতনের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। আবার এই করোনালীন সময়েও কিছু মানুষকে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে। নারায়ণগঞ্জে সিটি কপোর্রেশনের কাউন্সিলর মোকসেদুল আলম খন্দকার খোরশেদের মত ব্যক্তিরা শুধু জনপ্রতিনিধি হিসেবে নয়, মানবিক দায়বদ্ধতা প্রতিপালনের ক্ষেত্রেও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।

বিশ্ব ও প্রতিবেশিদের সাথে তাল মিলিয়ে গত ৫০ বছরে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। স্বাধীনতার পর দুর্ভীক্ষ ও ক্ষুধা-দারিদ্র্য পীড়িত বাংলাদেশকে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আমাদের বর্তমান উন্নয়ন অগ্রগতির দিকে আঙুল দেখিয়ে তার সে সময়ের বক্তব্য নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা এখন কটাক্ষ করেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কবল থেকে বাঁচাতে বিশ্বের ধনী দেশগুলো উদারভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। হাজার হাজার টন টন খাদ্যসশ্য, কোটি কোটি কম্বল অনুদান পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি। তিনি নিজের কম্বলটি না পাওয়ার কথাও বলেছিলেন। তার এই বক্তব্য থেকেই তলাবিহীন ঝুরির বাস্তবতা ধরা পড়ে। ৫০ বছর পরেও সে বাস্তবতার পরিবর্তন হয়েছে কি? একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, আমরা আরো পিছিয়ে পড়েছি। আগে বিদেশী অনুদানের অর্থ লোপাট হতো, এখন বিদেশে কর্মরত কোটি শ্রমিকের রক্ত পানি করা টাকা লোপাট হয়। বিদেশী সংস্থা থেকে উচ্চ সুদে টাকা ঋণ নিয়ে বাস্তবায়ন করা মেগা প্রকল্পে অস্বাভাবিক খরচ দেখিয়ে, ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে এমনকি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রির্জাভের পাসওয়ার্ড হ্যাক করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দেশের এক কোটি শ্রমিক বিদেশ থেকে যে পরিমান রেমিটেন্স দেশে পাঠায়, বৈধ-অবৈধ কয়েক লাখ ভারতীয় কর্মী তার প্রায় অর্ধেক নিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে যে পরিমান টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে তা দিয়ে প্রতিবছর পদ্মাসেতুর মত ৫টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ অবস্থা না থাকলে আরো দুই দশক আগেই বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিনত হতে পারত। বিদেশীরা কি বলল সেটা বড় কথা নয়, হেনরি কিসিঞ্জার বলার আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চোরের খনির কথা বলেছিলেন। এখন অনেকে ডাকাতে পরিণত হয়েছে, একেকজন হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশী ব্যাংকে পাচার করে ধনকুবের হয়ে গেছে। গত এক দশক ধরে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা চলছে। প্রতি বছর প্রায় লক্ষ-কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই বাস্তবতা জিইয়ে রেখে আমরা কি তলাবিহীন ঝুরির তকমা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি?

রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির পথ, সামাজিক সাম্য, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের স্বপ্ন ক্রমে অপরাজনীতি ও দুর্বৃত্তায়ণের গোলক ধাঁধায় হারিয়ে যেতে বসেছে। স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তীর বছরে সেসব বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও প্রত্যাশিত রাষ্ট্রের রূপরেখা বাস্তবায়ন ও বিনির্মানের পথ কি উন্মুক্ত আছে? নাগরিকরা তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মূল্য বিচার করে শাসক নির্বাচনের অধিকারটুকু অবশিষ্ট আছে কিনা স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে আমাদেরকে সে বিষয়ে বিতর্কে জড়াতে হচ্ছে। এটাই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বর্ষ স্মরণে মুজিব শতবর্ষ উদযাপনের বছরে রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতা থেকে উত্তরণে জাতিকে নতুন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে। অতীতের ক্ষত এবং বর্তমানের বিভক্তি, ভঙ্গুরতা, অবক্ষয় ও দুর্বৃত্তায়ণের পঙ্কিল পথ থেকে যারা জাতিকে সোনালী দিগন্তের সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে পারবে, তারাই হবে নতুন বাংলাদেশের মুক্তি সেনানি। কয়েক দশক ধরে আমরা যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ ও সামাজিক অবক্ষয় ও সর্বব্যাপী দুর্নীতির মচ্ছব দেখছি, তার নেপথ্যে রয়েছে শত বছরের ঔপনিবেশিক শোষন এবং শিক্ষাব্যবস্থায় অনৈতিক ভোগবাদী দর্শন ও সংস্কৃতির চর্চা। জাতিকে স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কাছাকাছি নিয়ে যেতে হলে প্রথমেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্য ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা ছাড়া তা কখনো সম্ভব নয়। এই করোনাকালে আমরা আকস্মিকভাবে অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছি। ভয়ে, আতঙ্কে, সতর্কতায় সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে সমাজ মানসের চিন্তা-চেতনা ও মননে যে ছায়াপাত ঘটেছে তাকে যদি ইতিবাচক পরিবর্তনের পক্ষে কাজে লাগানো যায় তবেই সমাজে ও রাষ্ট্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করা সম্ভব। সেটি শুরু করতে হবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে।

করোনাভাইরাস মহামারী সংকটে এক সময় সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলেও আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মহামারীর উত্তুঙ্গ সময়েও দেশের সবচেয়ে জনবহুল শিল্পখাত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো খুলে দেয়ায় অনেক সমালোচনা হলেও আদতে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। কোনো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা ইপিজেড এলাকায় করোনামহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি। ব্যবসায়-বাণিজ্য, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকলে দেশের অর্থনীতি অনেক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ব্যতিক্রম শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এগুলো বন্ধ থাকলে যেন কারো কিছু যায় আসেনা। গত বছরের মার্চ মাসে বন্ধ হওয়া স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এখনো খোলেনি। এ সময়ে দেশের কোটি কোটি শিশুর শিক্ষা, শারিরীক, মানসিক স্বাস্থ্য ও মনস্তত্তে¡র উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তা যেন দেশের কোনো ক্ষতি নয়! ভারতে এবং ইউরোপ-আমেরিকায় এখনো প্রতিদিন শত শত মানুষ করোনাভাইরাসে মারা যাচ্ছে, হাজার হাজার আক্রান্ত হচ্ছে। সেখানে এখনো শ্রমঘন শিল্প-কারখানাগুলো পুরোপুরি খোলেনি। অথচ আমাদের দেশে সবকিছু খুলে দিয়ে শুধু স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার বাস্তবতার মধ্যেও জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের নির্বাহী প্রধান হেনরিয়েটা স্কুলগুলো খুলে দেয়ার আহবান জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে আমাদের সরকারও সীমিত আকারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় কোটি কোটি শিশু-কিশোর-তরুণের রোজ নামচায় বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ শহরগুলোতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, সুবজ প্রান্তর, পার্ক, সুষ্ঠু ধারার বিনোদনকেন্দ্র না থাকায় শিশু-কিশোররা বিশেষত মোবাইল ফোন ও ডিজিটাল ডিভাইসনির্ভর হয়ে পড়েছে। অনেক শিশু-কিশোরের ক্ষেত্রে এটা অ্যাডিকশন বা আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। একটি মহামারীতে বছর ধরে ঘরবন্দী শিশু-কিশোরদের মনস্তাত্বিক পরিচর্যা ও করণীয় সম্পর্কে দেশের শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা বোর্ড, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজসেবা অধিদফতর বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো পরিকল্পনা আছে কি? সম্ভবত নেই। এ প্রসঙ্গ ছাড়াও করোনাকালে সমাজে যে সর্বগ্রাসী অবক্ষয়, নিষ্ঠুরতা ও মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতিহীনতা, অমানবিক আচরণের প্রবণতা দেখা গেছে, তা থেকে উত্তরণের দায়িত্বও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বর্তায়। করোনায় সবদিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার তথা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। কর্ম হারানো হাজার হাজার অভিভাবক স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেক সমস্যা সত্তে¡ও অভিভাবকরা সন্তানদের আবার স্কুল-কলেজে পাঠাবেন। করোনাকালে শিল্পখাতসহ বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার জরুরী তহবিল বরাদ্দ দেয়া হলেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নির্বিঘœ রাখার কোনো বাস্তব পরিকল্পনার কথা শোনা যায়নি। করোনা মহামারীত্তোর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাওয়ার কার্যকর নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি, লুটতরাজের অর্থনীতি, ভোগবাদী অপসংস্কৃতির প্রতিযোগিতা এবং তথাকথিক শিক্ষিত শ্রেণীর অনৈতিক ও অমানবিক নিষ্ঠুরতা বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার দায়িত্ব সচেতন মহলের। এ জন্য প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি ও অপরাজনীতিমুক্ত করতে হবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন