চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আজ বুধবার। সিটি মেয়র পদে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী আর বিএনপির ধানের শীষের ডা. শাহাদাত হোসেনের ভোটের লড়াই। এই ভোটযুদ্ধে কে হাসবেন শেষ হাসি। নৌকা না ধানের শীষ- চাটগাঁবাসীর সিদ্ধান্ত জানা যাবে কয়েক ঘণ্টা পর।
মেয়র পদে প্রার্থী সাত জন। ৫৩টি কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ২২৯ জন। মহানগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে ৭৩৫টি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ইভিএম-এ। ৫৭ শতাংশ ভোটকেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইভিএম মেশিনসহ নির্বাচনী সামগ্রী পৌঁছে গেছে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে। এবার মোট ভোটার ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেন বলেন, ধানের শীষের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, সুষ্ঠু ভোট হলে তিনিই বিজয়ী হবেন। ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, চসিক নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য হবে। দেশবাসী একটি ভালো নির্বাচন দেখবে।
এদিকে বিরোধ, সংঘাত, সহিংসতায় প্রচার শেষে এখন ভোটগ্রহণ পর্ব কেমন হবে তা নিয়েও সাধারণ ভোটার তথা নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভীতি-শঙ্কা রয়েছে। বেশিরভাগ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বিদ্রোহীদের মারমুখী অবস্থান, দলীয় কোন্দল, বিএনপির এজেন্টদের ধরপাকড় আর ভয়ভীতি প্রদর্শনের মধ্যে ভোটের দিনে কোথায় কখন কি অঘটন ঘটে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসনও। পৌনে এক কোটি মানুষের এই নগরীতে ভোটের দিনেও দেয়া হয়নি সাধারণ ছুটি। যদিও সরকারি দুটি ইপিজেডে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। আছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও। এতে ভোটারদের মধ্যে কিছুটা নির্লিপ্ত ভাব রয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত ভোটারের উপস্থিতি কেমন হবে তা নিয়ে সংশয়ে প্রার্থীরা।
মেয়র পদে ছয়টি রাজনৈতিক দলের ছয় জনসহ মোট প্রার্থী সাত জন হলেও মূল প্রতিদ্ব›দ্বীতা নৌকা আর ধানের শীষে। নৌকার প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। ডা. শাহাদাত হোসেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক। বড় দুই দলের এ দুই প্রার্থী রাজনীতিতে পরিচ্ছন্ন এবং মার্জিত হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘ ১৮ দিনের জমজমাট ভোটের প্রচারে পরস্পরের প্রতি কোনরূপ কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি না করে তারা তাদের ইমেজ আরও বাড়িয়েছেন। সাধারণ ভোটাররা তাদের এ ভূমিকা ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। ভোটের হিসেবে দলীয় পরিচয়ের বাইরে তাদের ব্যক্তি ইমেজও ভ‚মিকা রাখবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল বিশেষ করে কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মুখোমুখি অবস্থান অন্যদিকে বিএনপির কতিপয় নেতার নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকা প্রার্থীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরোধে ভোটের প্রচারে তিন জনের লাশ পড়েছে। প্রকাশ্যে গুলির ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন এলাকায়। বিএনপিতে কাউন্সিলর নিয়ে গৃহবিবাদ না থাকলেও চট্টগ্রামের অনেক নেতা ধানের শীষের পক্ষে মাঠে নামেননি। আবদুল্লাহ আল নোমান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন এবং গোলাম আকবর খন্দকারসহ বেশ কয়েকজন নেতা নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে ছিলেন।
এসব বিষয় নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এসব ঘটনা শেষ পর্যন্ত ভোটের হিসেবে প্রভাব ফেলতে পারে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দলীয় রাজনীতিতে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও ভোট কতটুকু অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে সংশয়ে নগরবাসী। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান দাবি করেন, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে যাবতীয় প্রস্তুতি তারা সম্পন্ন করেছেন। তিনি নগরবাসীকে ভোটকেন্দ্রে এসে নির্বিঘে, নির্ভয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ভোটাররা ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন। গতকাল নগরীর সিজেকেএস জিমন্যাশিয়ামে নির্বাচনী সরঞ্জামাদি বিতরণ কার্যক্রম পরিদর্শনকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ৭৩৫টি কেন্দ্রে চার হাজার ৮৮৬টি কক্ষে নয় হাজার ৭৭২ জন পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। ১৬ হাজার ১৬৩ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার পাঁচ হাজার ৯০২ জন এবং পোলিং অফিসার ১০ হাজার ২৬৮ জন। ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এরমধ্যে পুরুষ নয় লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন, মহিলা নয় লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ জন। ভোটগ্রহণ চলবে সকাল ৮টা থেকে টানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
এদিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর জানিয়েছেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হবে। আমরা ডানেও থাকাবো না, বামেও থাকাবো না। যে আইন-শৃঙ্খলার জন্য থ্রেড হয়ে দাঁড়াবে তাকেই আমরা কঠোরভাবে দমন করবো। কোনো বহিরাগত এসে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। ৭৩৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৪১৬টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ জন এবং সাধারণ কেন্দ্রে ১৬ জন করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। নির্বাচনে সাত হাজার ৭৭২ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। ইতোমধ্যে ২৫ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ৪১টি ওয়ার্ডে থাকবে র্যাবের ৪১টি টিম। এছাড়া পুলিশের রিজার্ভ টিম ও আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবে নির্বাচনী এলাকায়। স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে ১৪০টি, মোবাইল টিম থাকবে ৪১০টি। সব মিলিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১৮ হাজার সদস্য মাঠে থাকছে। মাঠে থাকবেন ৬৯ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ২০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।
নির্বাচনে অন্য পাঁচজন মেয়র প্রার্থী হলেন- ইসলামী আন্দোলনের হাত পাখা প্রতীকের প্রার্থী জান্নাতুল ইসলাম, ইসলামী ফ্রন্টের মোমবাতি মার্কার প্রার্থী মাওলানা এম এ মতিন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আম মার্কার প্রার্থী আবুল মনজুর, ইসলামিক ফ্রন্টের চেয়ার মার্কার প্রার্থী মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ ও স্বতন্ত্র হাতি প্রতীকের প্রার্থী খোকন চৌধুরী। নগরীর ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে দুটিতে নির্বাচন হচ্ছে না। এরমধ্যে ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তারেক সোলায়মান সেলিমের মৃত্যুতে স্থগিত নির্বাচন আগামী ২৮ ফেব্রæয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডের একক প্রার্থী আওয়ামী লীগের মো. হারুনুর রশিদ বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ৩৯টি ওয়ার্ডে প্রার্থী আছেন ১৭২ জন এবং সংরক্ষিত ১৪টি মহিলা কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ৫৭ জন।
গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি চসিক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। সেই অনুযায়ী ২৯ মার্চ ভোটগ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে ২১ মার্চ নির্বাচন স্থগিত করা হয়। ৫ আগস্ট চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও ৪১ জন সাধারণ ওয়ার্ড এবং ১৪ জন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের মেয়াদ শেষ হয়। প্রশাসক হিসেবে খোরশেদ আলম সুজনকে নিয়োগ দেয় সরকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন