বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় ৬৪ প্রজাতির মাছের ২৪টি পুনরুদ্ধার করেছে বিএফআরআই

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০২১, ৪:৪৬ পিএম

দেশে বিলুপ্ত প্রায় ৬৪ প্রজাতির মাছের ২৪টি জাতই ফিরিয়ে আনার গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য অর্জন করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটি-বিএফআরআই’র বিজ্ঞানীগন। যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক সাফল্য বলে মনে করেন মৎস্য বিজ্ঞানীগন। আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক সংরক্ষণ সংস্থা-আই ইউ সি এন ইতোপূর্বে বাংলাদেশের ৬৪ প্রজাতির মাছকে ‘বিপন্ন বা বিলুপ্তপ্রায়’ ঘোষনা করায় বিএফআরআই’র মৎস বিজ্ঞানীগন বিষয়টি নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে। ইতোমধ্যে এসব বিপন্ন মাছের ২৪টি প্রজাতির প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব রক্ষা সহ উৎপাদন সম্প্রসারনেও সক্ষম হয়েছে বিএফআরআই। এসব উদ্ধারকৃত মাছের উন্নত চাষ পদ্ধতি মৎস্য অধিধপ্তরের কাছে হস্তান্তরও করা হয়েছে মাঠ পর্যায়ে মৎস্য চাষীদের কাছে পৌছে দেয়ার লক্ষে। ২০২১-২৫ সময়কালে ৮ম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের মৎস্য অভায়াশ্রম এলাকায় সংকটাপন্ন মাছের প্রজাতি সমুহের সংখ্যা ৫০% হ্রাস করার লক্ষ্য নির্ধারন করা হয়েছে। 

এ ব্যপারে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শম রেজাউল করিম জানান, বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় সব প্রজাতির মাছকে ফিরিয়ে আনতে আমাদের বিজ্ঞানীগন যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করছেন। আগামী ২-৩ বছরের অস্তিত্ব সংকটে থাকা সব দেশীয় মাছ পুনরুদ্ধার করে জনগনের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কথাও জানান তিনি।
বিপন্ন ২৪টি প্রজাতি পুণরুদ্ধারের ফলে দেশে মাছ উৎপাদনে এসব প্রযুক্তি যথেষ্ঠ ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আগামীতে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে তা আরো সহায়ক হবে বলে মৎস্য বিজ্ঞানীগন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ২০১৮-১৯ সালে দেশে মাছের উৎপাদন ছিল ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। যারমধ্যে চাষকৃত মাছের উৎপাদনই প্রায় ২৫ লাখ টন। দেশের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশই যোগান দেয় মাছ। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, বর্তমানে দৈনিক গড় ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরিতে ৬২.৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহন করছে দেশের মানুষ। বর্তমানে জিডিপি’তে মৎস্য সেক্টরের অবদান ৩.৫০%। আর কৃষিজ আয়ের ২৫.৭২% আসছে মৎস্য উপখাত থেকে। গত ৫ বছরে মৎস্য খাতে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৬.২৮%। পাশাপাশি দেশের ১২% বা প্রায়ে পৌনে ২ কোটি মানুষ কোন না কোনভাবে মৎস্য সেক্টর থেকে জীবিকা নির্বহ করছে। যার মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ নারী।

তবে আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ সীমান্তের ওপারে অভিন্ন নদ-নদী সুমহের পানি একতরফা প্রত্যাহারের ফলে দেশের অনেক বিল ও হাওড়ে বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ে প্রয়োজনীয় পানি থাকাছে না। এটাই দেশীয় মাছের বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্তির অন্যতম কারন বলে জানা গেছে। অনেক বিল ও হাওরের অস্তিত্ব বিপন্ন হবার ফলে ইতোপূর্বে প্রায় ৩৫টি দেশীয় প্রজাতির মাছ চীর দিনের মত হারিয়ে যেতে বসেছিল বলেও মৎস্য বিজ্ঞানীগন জানিয়েছেন। এমনকি সীমান্তের ওপারে পনির প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের ফলে শুধু নদÑনদীই নয় দেশের প্রায় সব বিল ও জলাশয়ও ক্রমশ মূল চরিত্র হারাতে বসেছে। মৎস্য বিজ্ঞানীগন সহ আইইউসিএন-এর মতে এর ফলে প্রায় ৩৫ প্রজাতির দেশীয় মাছের অস্তিত্ব ইতোপূর্বেই বিপন্ন হয়ে পরে। তবে বিপদগ্রস্থ মাছের মোট সংখ্যা ৬৪ বলে আইইউসিএন জানিয়েছে।

বিপন্ন এসব মাছের মধ্যে মহাশোল, নান্দিনা, গনিয়া, দেশী সরপুটি, শোল, গজার, বাইম, গুতুম,চিতল, ফলি, বাঙ্গনা, খলিশা, চান্দা,নাপিত, চেওয়া এবং রাণি সহ আরা বেশ কয়েটি প্রজাতির দেশীয় মিঠা পানির মাছও রয়েছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, মলা,ঢেলা, পুটি, বাইম,টেংরা,খলিশা, পাবদা, শিং,মাগুর, কেচকি ও চান্দা জাতের মাছসমুহে প্রচুর পরিমান ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরস, লৌহ ও আয়োডিনের মত মানব দেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। এসব খনিজ পদার্থ মানব দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সহ রক্ত শূণ্যতা,গলগন্ড ও অন্ধত্ব রোগ প্রতিরোধে বিশেষ সহায়ক। কিন্তু নানা কারণে মাছের প্রজনন ও বিচরন ক্ষেত্রসমুহ হওয়ায় দেশের ৬৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হয়ে পরেছিল।

বিএফআরআই’র বিজ্ঞানীগন ইতোমধ্যে ২৪ প্রজাতির মাছকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। পাবদা, গুলশা, টেংরা, গুজি আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালী, বারাচাটা,
গুতুম, কুচিয়া, ভাগনা, খলিশা ও গজার সহ ২৪ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজনন নিশ্চিত করতে সক্ষম হওয়ায় ইতোমধ্যে এর প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে বরে জানিয়েছেন বিএফআরআই’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এনামুল হক । নদী, হাওড় ও বিলে সাম্প্রতিককালে দেশীয় মাছের অবমুক্তির সাথে মৎস্য অধিপ্তর দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাছের অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিরও উদ্যোগ গ্রহন করেছে বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল সূত্র। বিএফআরআই’র ময়মনসিংহ স্বাদু পানি গবেষণা কেন্দ্রের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির আরো কয়েকটি উপকেন্দ্রেও বিপন্ন মাছের অস্তিত্ব রক্ষায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে জানা গেছে।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, মৎস্য সেক্টরে দেশীয় ছোট মাছের একটি বড় অবদান রয়েছে। দেশীয় মাছের চাষাবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে হ্যাচারিতেও ব্যাপকভাবে এসব মাছের পোনা উৎপাদন হচ্ছে। এমনকি পোনা সহজলভ্য হওয়ায় সম্প্রতিককালে মাঠ পর্যায়ে পাবদা, গুলশা, শিং, টেংরা, মাগুর ও কৈ মাছের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিএফআরআই থেকে বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা, শাল বাইম, রাণী, কাজলি, পিয়ালি, বাতাসি, কাকিলা ও ভোল মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবনে গবেষনা চলছে বলে জানা গেছে।

এব্যাপারে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এনামুল হক জানান, আমাদের লক্ষ্য সবগুলো দেশী মাছের প্রজাতি সংরক্ষন ও তাার চাষ সম্প্রসারন। এলক্ষে আমরা সাফল্যের আশাবাদী। তবে কিছু কিছু প্রজাতির মাছ একবারেই খুজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়ে তিনি বলেন, সেগুলো খুজে বের করে প্রজনন সম্প্রারনেরও চেষ্টা চলছে। তিনি এক্ষেত্রে সবার সহযোগীতাও কামনা করেন। যেকোন বিলুপ্তপ্রায় মাছের সন্ধান পেলে তা বিএফআরআই বা নিকটস্থ মৎস্য অফিসে পৌছে দেয়ারও আহবান জানান ড. এনামুল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন