মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পাপুল ‘মাফিয়া বস’

দেশদ্রোহীতার অভিযোগে মামলার দাবি কুয়েত প্রবাসীদের

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

কুয়েত আদালত লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী সহিদ ইসলাম পাপুলের ৪ বছরের কারাদন্ড দেয়ার খবর এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। সর্বত্রই পাপুলের কারাদন্ড নিয়ে আলোচনা চলছে। পাপুলের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি থাকবে না তা নিয়েও চলছে জল্পনা-কল্পনা। কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশিরা পাপুলকে ‘মাফিয়া বস’ অবিহিত করে তার বিরুদ্ধে দেশেও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছেন। পাপুল বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন করেছে বলেও তার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরুর দাবি জানান।

কুয়েতে সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুল কুয়েতে পাঁচ মিলিয়ন দিনার সম্পদ করেছেন বলে দেশটির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার কুয়েতের দৈনিক আল কাবাস’র বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস এ তথ্য জানিয়েছে।
সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুয়েতের তদন্তকারীরা বাংলাদেশের সংসদ সদস্য ও মারাফি কুয়েতিয়া প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী শহিদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে তদন্ত করে জানতে পেরেছেন যে দেশটিতে তিনি পাঁচ মিলিয়ন দিনার সম্পদ করেছেন।

তদন্ত চলাকালে পাপুল ও তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়েছিল উল্লেখ করে সংবাদ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সাক্ষীদের বক্তব্য থেকে জানা গেছে আসামি পাপুল একটি সংগঠিত চক্রের অংশ। এ চক্রটি এক কুয়েতি নাগরিক গড়ে তুলেছিলেন। এতে আরো বলা হয়েছে, পাপুল কুয়েতি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে শ্রমিক আনতেন। শ্রমিকদের কাছ থেকে সেই প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া ও ওয়ার্ক ভিসার কথা বলে অবৈধভাবে ২,৫০০ থেকে ২,৭০০ দিনার নেওয়া হতো।
আল কাবাস’র বরাত দিয়ে দ্য টাইমস’র প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক কুয়েতে এনে আসমিরা ৫০ মিলিয়ন দিনারের বেশি আয় করেছেন।

সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার কুয়েতে এমপি পাপুলকে মানব ও অর্থপাচারের দায়ে চার বছরের কারাদন্ডের সঙ্গে ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার জারিমানা দিয়েছে দেশটির আদালত। এতই সঙ্গে পাপুলের সহযোগী কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ বিভাগের অ্যাসিসটেন্ট আন্ডারসেক্রেটারি মেজর জেনারেল শেখ মাজেন আল-জারাহকেও একই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ মামলায় কুয়েতের এমপি সাদৌন হাম্মাদ ও দেশটির সাবেক এমপি সালাহ খুরশিদকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।

কুয়েতের স্থানীয় দৈনিকে বলা হয়েছে, এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে মানব ও অর্থপাচার, কুয়েতের আইন অমান্য করে কর্মী নিয়োগে জালিয়াতি ও ঘুষের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এতে আরো বলা হয়েছে, আইন অমান্য করায় সেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়ায় শ্রমিকরা কুয়েতে এসে দেখেন তাদের ভিসা নকল। তখন তাদেরকে জোর করে পাপুলের মালিকানাধীন অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ দেওয়া হয়।
প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়, সাক্ষী দেওয়া শ্রমিকরা জানিয়েছেন, চুক্তিতে যে বেতন ও আবাসনের কথা বলা হয়েছিল। সেটা না মেনে শ্রমিকদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় মানবেতর পরিবেশে কাজ করানো হতো। কোনো শ্রমিক এর প্রতিবাদ করলে তাকে মারধর করা হতো এবং মিথ্যা মামলার ভয় দেখানো হতো। আদালতে সাক্ষীরা আরো বলেছেন, বাংলাদেশে এমপি পাপুলের মালিকানাধীন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে তাদেরকে কুয়েতে আনা হয়েছিল।

প্রতিবেদন মতে, তদন্তে আরো জানা গেছে এমপি পাপুল অবৈধ উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করতেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আয়ের উৎস গোপন রাখতেন এবং কুয়েতের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে মানবপাচার করতেন।
২০২০ সালের ৬ জুন গ্রেফতারের পর পাপুল প্রথমে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন এবং কোনো অপরাধের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছিলেন। পরে তার বাসা ও প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালিয়ে এসব অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাপুল ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে’ তার বন্ধুদের উপহার (ঘুষ) দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এর বিনিময়ে তারা তার প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা দিয়েছিল বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পাপুল ‘মাফিয়া বস’র মতো কাজ করার অভিযোগেও অভিযুক্ত হয়ে ৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন উল্লেখ করে সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি গরিব ও স্বল্প আয়ের শ্রমিকদের থেকে অর্থ আদায় করতেন।
পাপুলের লোকেরা শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রতিদিন ৮ কুয়েতি দিনার করে ‘রয়েলটি’ আদায় করত বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার সাক্ষী ১১ বাংলাদেশি শ্রমিক আদালতকে জানিয়েছেন তারা শুধুমাত্র ভিসার জন্যই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেননি, ভিসা নবায়নের জন্যও অর্থ দিতেন।

প্রতিবেদন মতে, জেরা করার সময় পাপুল কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন দিনারের চেক দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। পাপুল আরো এক কর্মকর্তাকে ১ মিলিয়ন দিনার নগদ দিয়েছেন। অন্য এক কর্মকর্তাকেও কয়েক মিলিয়ন দিনার ভর্তি ‘ব্যাগ’ দিয়েছেন বলে কুয়েতের পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুয়েতের আদালত পাপুলের মাধ্যমে আসা বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাছ থেকে সাক্ষ্য নিয়েছেন। পাপুল ‘ভিসা বাণিজ্য’ করে যুক্তরাষ্ট্রে টাকা পাচার করেছেন বলেও প্রতিবেদনে রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, তদন্ত শুরুর আগে পাপুল যখন জানতে পারেন যে এই তদন্তে তার নাম রয়েছে তখন তিনি কয়েকটি সন্দেহভাজন অ্যাকাউন্ট থেকে কয়েক মিলিয়ন দিনার ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি ব্যাংকে পাঠিয়েছেন। সে সময় তিনি কুয়েত ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলেও সংবাদ প্রতিবেদনটিতে জানানো হয়েছে।

এদিকে মানব ও অর্থ পাচারের দায়ে পাপুলকে চার বছরের সশ্রম কারাদন্ডের প্রেক্ষিতে তাকে দুষছেন কুয়েতের প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কুয়েতে থাকা প্রবাসীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমপি পাপুলের তীব্র সমালোচনা করছেন। পাপুলের রায়ের প্রেক্ষিতে কুয়েত প্রবাসী এম ডি স্বপন ফেসবুকে লিখেছেন, দুই দিন আগে আর পরে, গরিবের হক মেরে কেউ বাঁচতে পারবে না। এই রায় এর ছোট্ট একটি প্রমাণ। কুয়েত প্রবাসী আল আমিন লিখেছেন, এই রায়ে আমি খুশি হতে পারলাম না। পাপুলের এমন একটা শাস্তি হওয়া উচিত ছিল যেটা দেখে পরবর্তীতে এই রকম কাজ কেউ করতে সাহস না পায়। পাপুলের রায়ের পর কুয়েত প্রবাসী ফুরকানের অভিমত, সাজা কম হয়ে গেছে, পনের বছর দেওয়া দরকার ছিল। মো. মনির ফেসবুকে লিখেছেন, দেশের বিরুদ্ধে কথা বললে দেশদ্রোহী হয়। প্রবাসীরা সেই দেশের সম্পদ। এই এমপি প্রবাসীদের রিজিকে আঘাত দিয়েছে, তাই বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীর মামলা করা হোক। মো. সাঈদ মন্তব্য করেছেন, সাজা এবং জরিমানা অনেক অনেক কম হয়েছে। জিহান সালিম পাপুলকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন, আমাদের যা কিছু অর্জন ছিল প্রবাসে, তা একে একে ধ্বংস করে দিচ্ছে। নুর ফিদুর মন্তব্য বাংলাদেশ হলে রায় দিতে লাগতো ছয় বছর! মো. কিরন পাপুলের রায়ের পর মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ হলে জামিন হয়ে যেত। সাজা তো পরের কথা। খুশি হলাম। এভাবেই সকল চোরদের সাজা দেওয়া হোক। ধন্যবাদ কুয়েত বিচার বিভাগ।

নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধের দায়ে দন্ড হওয়ার পরও পাপুলের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি-না, এটাই এখন প্রশ্ন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানে বলা আছে দুই বছরের অধিক কারাদন্ড হলে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে। বিচার দেশীয় আইনে হতে হবে কি-না, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এমপি পাপুলের এ বিষয়টি একেবারেই নতুন। এমন প্রশ্ন এর আগে আসেনি। এর ব্যাখ্যা জানতে যদি আদালতে যেতে হয়, তাহলে আদালতও বলবেন, যিনি জেল খেটেছেন, তিনি খারাপ লোক। ফলে তার এমপি পদ থাকতে পারে না। জাতীয় সংসদের স্পিকার ও নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন নিশ্চয়।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একজন সংসদ সদস্য যদি ফৌজদারি অপরাধ করেন, সাজা পৃথিবীর যেখানেই হোক, তাহলে তার এমপি পদ থাকবে না। তবে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অবশ্যই কুয়েতের আদালতের রায়ের অনুলিপি পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সংবিধানে সংসদ সদস্যপদ বাতিল-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে ৬৬ (২) (ঘ) বলা হয়েছে ‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি কোনো উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলিয়া ঘোষণা করেন; তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর যদি দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করেন; তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কমপক্ষে দুই বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হন; তিনি যদি প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন; সংসদের অনুমতি ছাড়া তিনি যদি একাদিক্রমে নব্বই দিন অনুপস্থিত থাকেন।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
J Alam ৩০ জানুয়ারি, ২০২১, ১:১২ এএম says : 0
পাপলু মানব পাচারের জন্য কুয়েতে সাজা হয়েছে। কিন্তু দেশের যে পরিবার গুলোকে নিঃস্ব করেছে তার জন্য কি দেশে কোনো আইন আছে?
Total Reply(0)
Azim Hossain ৩০ জানুয়ারি, ২০২১, ১:১৩ এএম says : 0
আমাদের দেশের আইনপনেতা অন্য দেশের কয়দি।
Total Reply(0)
Mohammad Morshed ৩০ জানুয়ারি, ২০২১, ১:১৪ এএম says : 0
উন্নয়নের জোয়ারে আজ আমাদের সাংসদের বিদেশের মাটিতে বিচার হচ্ছে আহ্ কি চমৎকার
Total Reply(0)
Anwar Hossain ৩০ জানুয়ারি, ২০২১, ১:১৫ এএম says : 0
পাপুলের সত্যি দূর্ভাগা কপাল, কুয়েতের মতো দেশে ব্যরিস্টার সুমন না থাকায় পাপুলের চার বছর জেল আমরা এর নিন্দা জানাই
Total Reply(0)
শান্ত ছেলে মুজাম্মেল ৩০ জানুয়ারি, ২০২১, ১:১৫ এএম says : 0
আমার মনে হয় বাংলাদেশের এম পি মন্ত্রীদের ধরে নিরপেক্ষ আদালতে বিচার করা হয় তাহলে সবার জেল হত, হাতে গুনা কয়েক জন ছাড়া।
Total Reply(0)
Ruhul Amin Zakkar ৩০ জানুয়ারি, ২০২১, ১১:০৫ এএম says : 0
পাপুলরাই আমাদের সোনার ছেলে। ওর কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ পরিচিত হয়েছে। যে মানুষটা ঠান্ডা মাথায় এ বিশাল জালিয়াতি করতে পেরেছে তাকে 'জালিয়াতিতে' নোবেল দেয়া হোক।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন