শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মেঘনা দখলমুক্ত করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

মেঘনা গ্রুপ নামের একটি শিল্প গ্রুপ নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায় মেঘনার জমি অবৈধভাবে দখল করে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে বলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। দু’বছর সরেজমিনে তদন্ত শেষে গত ১৪ জানুয়ারি কমিটি তার রিপোর্ট জমা দিয়েছে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে। কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য ও তদন্ত কমিটির আহবায়ক মো. আলাউদ্দিন ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসককে দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক নদীর জমি উদ্ধারে ব্যবস্থা নেবেন। ইনকিলাবের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, অবৈধ জমি এক মাসের মধ্যে উদ্ধার করে নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক, বিআইডব্লিউটিএ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। কমিশনের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মেঘনা গ্রুপ মেঘনার ২৪১ দশমিক ২৭ একর জমি অবৈধভাবে দখল করে শিল্প প্রতিষ্ঠান, জেটি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মাণ করেছে। সোনারগাঁও উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে এই জমি দখল ও নির্মাণ কাজ সম্পাদিত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে ভূমি অফিসের যে বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, সিএসএস রেকর্ড মতে, গ্রুপের সব জমি নদীর। এখানে ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ খাস জমি বিভিন্ন জনের কাছে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। ওই জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিক্রীমূল্যের ২৫ শতাংশ সরকারকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়নি। এখানে নীতিবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। নদীর বিশাল এলাকায় দখল ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে কারখানাসহ স্থাপনাদি নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের চোখের সমনেই হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষ এতে বাধা দিয়েছে কিংবা গ্রুপটিকে রহিত করার চেষ্টা করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইনকিলাবের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মেঘনা গ্রুপ প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারির সহযোগিতা পাচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতর, নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়, বিআইডব্লিউটিএ কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় এবং উপজেলা সহকারি কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের কর্মাকর্তা-কর্মচারিদের একাংশের সঙ্গে গ্রুপটির গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

রক্ষক যখন ভক্ষকের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তখন ভোগ্যসামগ্রির নিরাপত্তা বলতে আর কিছু থাকে না। এক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য হয়েছে। কর্তৃপক্ষগুলো নিরব থাকায় এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করায় মেঘনা গ্রুপের পক্ষে নির্বাধে নদীর জমি দখল করা সম্ভব হয়েছে। অন্যরাও দখলে প্ররোচিত হয়েছে। আল মোস্তফা নামের এক ব্যক্তিও নদী দখল করে কারখানা গড়ে তুলেছেন। ১০ বছর ধরে ধাপে ধাপে তিনি এই দখল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সঙ্গে মেঘনা গ্রুপের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। এরকম আরো অনেকেই মেঘনা দখল করে কারখানা-স্থাপনা নির্মাণ করেছে। তারা একই সঙ্গে দূষণের বিষ নদীতে ছড়িয়ে দিয়েছে। দখল ও দূষণে মেঘনা কার্যত শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পতিত হয়েছে। মেঘনা দখলমুক্ত করার অভিযানে তেমন কোনো গতি নেই। এক বছর মাত্র ৩৩ শতাংশ দখল উচ্ছেদ সম্ভব হয়েছে। উচ্ছেদকৃত এলাকা পুনরায় দখল হয়ে গেছে কিনা জানা যায়নি বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার ৫ নদী দখলমুক্ত করার অভিযান ফলপ্রসূ হয়নি। দখলমুক্ত করার অব্যবহিত পরে আবার তা দখল হয়ে গেছে। দখল ও দখল উচ্ছেদের এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। অন্যন্য নদীর ক্ষেত্রেও একই খেলা লক্ষ্য করা যায়। নদীদূষণ তো অপ্রতিরোধ্য। নদীগুলো কঠিন বর্জ্য, তরল বর্জ্য, রাসায়নিক বর্জ্য এবং সব ধরনের কলকারখানার বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বলা হয়, নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। নদী যেভাবে দখলে-দূষণে শেষ হয়ে যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশ কিভাবে বাঁচবে সেটাই প্রশ্ন। দেশের ৭৭০টি নদী দখলের শিকার। এটা কি কল্পনা করা যায়? এসব নদী দখলের সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যা ৫৭৩৯০ জন। এই দখল উচ্ছেদ করতে হবে। তেমনি দখলদারদের বিরুদ্ধে নিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা। একই সঙ্গে যাবতীয় দূষণ থেকে নদী রক্ষা করতে হবে।

উল্লেখের অপেক্ষা রাখেনা, দেশের এক শ্রেণীর মানুষের লোভের কোনো শেষ নেই, সীমা নেই। তারা নদীর জমি, সরকারি জমি, বনের জমি, রেলের জমি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জমি, এমন কি অন্যের জমি দখল বা গ্রাস করতে উম্মুখ হয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই দখল করে। তারা প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান এবং সরকার বা সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে বেপরোয়া। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, যারা জমির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত বা তত্ত¡াবধায়ক, তারা দখলদারদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় ভয়ে বা চাপে অথবা অবৈধ লেনদেনের কারণে। নদী দখলের ক্ষেত্রে প্রশাসন, ভূমি অফিস, বিআইডব্লিউটিরএ’র সহযোগিতা অপরিহার্য। নদী দখল করে কলকারখানা স্থাপনে সহযোগিতা দরকার পরিবেশ অধিদফতরের। দেখা গেছে, মেঘনা গ্রুপ যেসব কারখানা নির্মাণ করেছে তার পরিবেশগত সনদ দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। পরিবেশ অধিদফতর ও মন্ত্রণালয় পরিবেশ সুরক্ষায় বড় অংকের সরকারি অর্থ পেয়ে থাকে। বিদেশী বিভিন্ন সংস্থাও এজন্য অর্থ দিয়ে থাকে। অথচ এই বিভাগ ও মন্ত্রণালয় দায়িত্ব পালনে লাগাতার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। সাভার চামড়া শিল্প নগরীর বর্জ্যে ধলেশ্বরী ব্যাপকভাবে দূষণ কবলিত হয়েছে। অথচ পরিবেশ অধিদফতর তা রুখতে পারেনি। ঢাকার ৫ নদী দূষণসহ দেশব্যাপী নদী দূষণ মারাত্মক আকার নিলেও মন্ত্রণালয় বা বিভাগের বিকার নেই। দখল ও পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য যেসব বিভাগ, দফতর, অধিদফতর ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা দায়ী, দখলদার ও দূষণকারীদের সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা আশা করবো, মেঘনা গ্রুপের মেঘনা দখল নিয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশনা বাস্তবায়নে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন