বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সুশাসন নিশ্চিত করাই হচ্ছে দুর্নীতিমুক্তির বড় শর্ত

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরায় প্রকাশিত রিপোর্ট নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। পপশাদারিত্বের মানদন্ডে এই রিপোর্টের সত্যতা, গ্রহণযোগ্যতা, বস্তুনিষ্টতা সম্পর্কে অনেকেই অনেক প্রশ্ন তুলতে পারেন। সে অবকাশ হয়তো আছে। আল জাজিরার রিপোর্টের পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব কথাবার্তা ও প্রচারনা চলছে তার কোনোটাই বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর পক্ষপাতহীন নয়। বাংলাদেশ সরকার আল জাজিরার রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রাথমিক সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। তবে বিষয়টি ইতিমধ্যে অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘেরও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে স্বচ্ছ ধারণায় পৌঁছতে হবে। কয়েক বছরের চেষ্টায় ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে এই প্রতিবেদনটি তৈরী করা হয়েছিল বলে আল জাজিরার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। আগামীতে এই প্রতিবেদনের আরো কয়েকটি পর্ব প্রচারের জন্য আসছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে। তবে প্রতিবেদনের নাম ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ হলেও রিপোর্টে বর্ণিত চরিত্রগুলোর কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্য পাওয়ার বয়ান দিলেও তা প্রমাণীত নয়। আমি ওমুকের লোক দাবি করলেই কেউ তার লোক হয়ে যায় না। সরকারের তরফে আল জাজিরার রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে চ্যানেলটির বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথাবার্তা চালু থাকলেও এমন একটি স্পর্শকাতর রিপোর্টের পরও সরকার বাংলাদেশে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধের মত কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এটা আমাদের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তির বিষয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ধাপই হচ্ছে সরকারের কাজের ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অবারিত করা।

ইউরোপীয় রেঁনেসার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব অষ্টাদশ শতকের ফরাসী দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানি (ফ্রান্সিস মারি আরোয়েত) ভল্টেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তিটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও শাসন ব্যবস্থায় ভিন্নমতের সহাবস্থান ও নিরাপত্তার মূল বৈশিষ্ট্যরূপে গণ্য করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমার মতামত সমর্থন নাও করতে পারি, তবে তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত’। এটি কোনো ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি নয়, প্রত্যাশিত আধুনিক সমাজের প্রতিটি মানুষ এবং সমাজব্যবস্থার কেন্দ্রীয় শক্তির অভিপ্রায় এমনই হওয়ার কথা। ভল্টেয়ারের যুগ থেকে আমরা তিনশ’ বছর পেরিয়ে এসেও সেই কাক্সিক্ষত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের পূর্ব পুরুষরা একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন বরখেলাফ হওয়ার পেছনের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নের সদিচ্ছা রাষ্ট্রশক্তি বা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। আল জাজিরা যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তা কোনো নতুন বিষয় নয়। এ দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসেছে। যেকোনো দÐিত আসামিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেয়ার আইনগত বিধান প্রায় সব দেশেই আছে। তবে সে বিধান কোন ক্ষেত্রে কিভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে তাই হচ্ছে জনগণের বিবেচ্য বিষয়। সেনা প্রধানের ভাইদের সম্পর্কে কথিত সেসব কাহিনীর কতটা বাস্তব আর কতটা অতিরঞ্জিত তাও বিচার্য বিষয়। তবে দেশের মিডিয়া যদি এসব বিতর্কিত ঘটনাবলী নিয়ে স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন ও পর্যালোচনা প্রকাশ করতো তাহলে হয়তো বিদেশি মিডিয়ার প্রতিবেদন ও প্রচারণা এতটা তোলপাড় সৃষ্টি করতে পারত না। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চেয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভাব-মর্যাদা ও জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতির দায়ে দেশের ক্ষমতাসীন, মন্ত্রী-এমপি, এমনকি প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ ও গ্রেফতারের ভুরি ভুরি উদাহরণ বিশ্বে আছে। বিরোধীদলের নির্বাচনী অফিসে আড়িপাতার যন্ত্র বসিয়ে নজরদারির অভিযোগ ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত কেলেঙ্কারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতার অগ্রসৈনিকদের অন্যতম ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহেরলাল নেহেরুর কন্যা এবং ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ইন্দিরা গান্ধীও ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর ১৯৭৭ সালে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তবে সেই গ্রেফতার তার ব্যক্তিগত ইমেজকে ¤øান করতে পারেনি। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তিনি আবারো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রীয় আইনকানুন, আদালত, নিরাপত্তা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ হচ্ছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সব নাগরিকের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তা সংরক্ষণ করা। সংগত কারণেই এসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্র ও সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী মহলের টার্গেটে পরিনত হতে হয়। ক্ষমতার অংশীদার রাজনৈতিক দল, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং আঞ্চলিক ও আন্তজার্তিক ভূ-রাজনীতির কুশীলবদের স্বার্থের প্রশ্নে জনস্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোকে সরকার এবং আইন আদালতের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে গণমাধ্যম সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং গণবিরোধী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়া ও পৃষ্ঠপোষকতায় গণমাধ্যমের মতলবি ভূমিকা রাষ্ট্র ও জনগণের যত ক্ষতি করতে পারে আর কোনো শক্তি এত ক্ষতি করতে পারেনা। দেশে দেশে সা¤্রাজ্যবাদের অনৈতিক যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, কোটি কোটি মানুষের উদ্বাস্তু জীবন এবং হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার সম্পদের অপচয়ের পেছনে পশ্চিমা মেইনস্ট্রীম মিডিয়াগুলো অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। এসব মিডিয়া সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থে প্রচারিত মিথ্যা প্রপাগান্ডার প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দিলে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন বা লিবিয়ায় রক্তক্ষয়ী সংঘাতের যৌক্তিক কোনো কারণ ছিল না। যুদ্ধবাজ প্রশাসন ও মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কন্ট্রাক্টরদের পাতানো খেলায় মিথ্যার বেসাতি করে কর্পোরেট মিডিয়াগুলো পুরো মানব সভ্যতার জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। মিডিয়াগুলো গোয়েবল্সীয় কায়দায় মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করে রিজিম চেঞ্জের পাতানো খেলায় সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই না করলে বিগত দশকে দেশে দেশে ন্যাটো জোটের এমন অসম অপ্রয়োজীয় যুদ্ধাভিযান হয়তো সম্ভব হতো না। মধ্যপ্রাচ্যে বিগত দশকে পশ্চিমা যুদ্ধাভিযানগুলো যে মিথ্যা প্রচারনার উপর শুরু হয়েছিল এখন তা প্রায় সবাই স্বীকার করতে বাধ্য।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। সাধারণত একজন দলীয় প্রেসিডেন্ট পরপর দুইবার ক্ষমতায় থাকার একটা ট্রাডিশন থাকলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বেলায় তা হয়নি। একশ্রেণীর শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীর বর্ণবাদী মনোভাব এবং অন্ধ দেশপ্রেমের জিকির তুলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৈষম্য ও বিভাজনের রাজনীতি শুরু করেছিলেন। মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন তকমা সামনে রেখে তিনি মূলত আমেরিকাকে বিশ্বসম্প্রদায়ের নেতৃত্ব থেকে বিচ্যুত করেছিলেন। তার এহের ভূমিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো মেইনস্ট্রীম মিডিয়া মেনে নিতে পারেনি। সিএনএন’র মত টিভি চ্যানেল পুরো ৪ বছর ধরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত পদক্ষেপগুলোর কঠোর সমালোচনায় উচ্চকণ্ঠ ছিল। ট্রাম্প কখনো কখনো তার সংবাদ সম্মেলনে সিএনএন প্রতিনিধির প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ বা প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে গেলেও সিএনএন’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা কখনো হয়তো ভাবারও সাহস পাননি। সেখানে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের সমান্তরাল শক্তি। ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করলেও উডওয়ার্ড কখনোই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেননি। তাকে মিথ্যা মামলায় হেনস্তা করার সুযোগ সে দেশের বিচারব্যবস্থায় নেই। জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে হোয়াইট হাউজ ছাড়তে বাধ্যই শুধু হননি, অবৈধ-অনৈতিকভাবে ক্ষমতায় থাকার অপচেষ্টা এবং দাঙ্গার উস্কানির অভিযোগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিসংশন এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। শুধু ডেমোক্রেটরাই নয়, বেশ কিছু রিপাবলিকান সিনেটরও ট্রাম্পের অভিসংশনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। নিজ দলের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে তারা প্রমান করেছেন তাদের কাছে দলের চেয়ে দেশ বড় এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনেক বড় বিষয়। রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের সংরক্ষণ করে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলো যদি ঠিকভাবে কাজ করে তবেই রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।

গত এক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে শত শত স্টেট সিনেটর, স্টেট রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং এসেম্বলি মেম্বার্স, মেয়র ও গর্ভনর দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত ও গ্রেফতার হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের। দুর্নীতি দমনে নিয়োজিত সংস্থাগুলো ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের উপর বেশি নজর রাখবে এবং উপযুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার ও বিচারের সম্মুখীন করবে, এটাই স্বাভাবিক। যে রাষ্ট্রে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালীরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার সুযোগ পাবে, সে রাষ্ট্র তত বেশি দুর্বল, ভঙ্গুর ও ব্যর্থ। রাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাসের দিকে তাকালেই তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। গত এক দশকে জাপানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ৬ জন। সদ্য বিদায়ী জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে হচ্ছেন দেড় শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী। সামান্য বিতর্ক হলেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়তে হচ্ছে। এভাবেই তারা নির্বাহী ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনটিকে নিষ্কলুষ মর্যাদার আসনে রাখতে সর্বদা সচেষ্ট। এ ধরনের মূল্যবোধ জাতির উন্নত মানসিকতার পরিচয় বহন করে। এর মানে এই নয় যে, যেখানে প্রেসিডেন্ট বা দলীয় প্রধানমন্ত্রীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকছেন, সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল বা অকার্যকর। তবে নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা এবং ক্ষমতার চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকলেই কেবল এ ধরনের রিজিম নিজেদের পক্ষে জনসমর্থন টিকিয়ে রাখতে পারে। বিগত দুইটি জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশে নির্বাচনের যে হাল দেখা গেছে তাতে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র নিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে জাতি হিসেবে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ ও বিব্রত।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিক তৃতীয়বার এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চতুর্থ দফায় ক্ষমতায় এসে উপমহাদেশের রাজনীতিতেই শুধু নয়, বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন শেখ হাসিনা। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তৃতীয় দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালীন নিজ দেহরক্ষির হাতে নিহত হয়েছিলেন। উপমহাদেশে দীর্ঘস্থায়ী ও রাজনৈতিকভাবে একচ্ছত্র প্রভাবশালী শাসকদের পরিসমাপ্তির ইতিহাস সুখকর নয়। নারীদের মধ্যে ইন্দিরাগান্ধী, বেনজির ভুট্টো, খালেদা জিয়া, অং সান সুচির ইতিহাস তো চোখের সামনেই আছে। এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা এবং শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে ব্যতিক্রম। তবে চন্দ্রিকার বাবা এবং শ্রীমাভো বন্দরনায়েকার স্বামী সলোমন বন্দরনায়েকে ১৯৫৯ সালে এক বৌদ্ধ সন্যাসীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার স্বামী ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও অনুরূপভাবে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিপদগামী সেনা সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। ‘পাওয়ার করাপ্টস, এবসোলিউট পাওয়ার করাপ্টস এবসোলিউটলি’ বৃটিশ রাজনীতিবিদ লর্ড অ্যাক্টনের এই প্রবাদবাক্য সবদেশে সবকালেই যথার্থ বলে প্রমানীত হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার খর্ব করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে, দেশে শক্তিশালী বিরোধীদল না থাকলে, শক্তিশালী ও স্বাধীন গণমাধ্যম না থাকলে ক্ষমতাকে নিষ্কলুষ রাখা প্রায় অসম্ভব। অনুন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্র যদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে দেশে বিদেশে ওঁত পেতে থাকা সরকারের সমালোচকরা গুজবের ডালপালা ছড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। একটা কথা সকলের মনে রাখা দরকার, যা কিছুই ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হোক, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে কোনো তথ্যই আর চেপে রাখা যায় না। অতএব সবকিছু স্বচ্ছতার আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার সুযোগ রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে সে ব্যবস্থা অবারিত করতে হবে।

গত এক দশকে দেশ থেকে অন্তত ৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। এ ধারা এখনো বন্ধ হয়নি। একশ্রেণীর আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা কানাডা, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইউরোপের দেশগুলোতে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বাংলাদেশ মহা হিসাব নিরীক্ষক দফতরের এক নির্বাহী আদেশে প্রায় লাখ লাখ অডিট আপত্তি নিস্পত্তি করা হয়েছে যেখানে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার হিসাব অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ধামাচাপা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আল জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের চেয়ে এসব তথ্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এসব নিয়ে দেশে হরহামেশাই লেখালেখি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সরকারি দলের বেশকিছু হোমড়া-চোমড়া নেতাও গ্রেফতার হয়েছেন এবং দলীয় পদ হারিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত সপ্তাহেও জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে দেয়া বক্তব্যে দুর্নীতি দমনকে আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করতে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি বিরোধী ভূমিকায় কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হলে দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা এবং গণমাধ্যমের ভূমিকাকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিষ্ঠান চলবে আইনী প্রক্রিয়ায়। সেখানে যেকোনো এমপি, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীও যদি অভিযুক্ত হোন, প্রতিষ্ঠান যেন তার বিরুদ্ধেও সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, এই প্রক্রিয়া থাকা অপরিহার্য। আগামী ১৩ মার্চ বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কার্যকাল শেষ হবে। ইতিমধ্যে সার্চ কমিটি নতুন দুদক চেয়ারম্যান নিয়োগের জন্য সম্ভাব্য ব্যক্তিদের যাচাই বাছাই করতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে। রাষ্ট্রের লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পদ পাচার, জনগণের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার সুযোগ চিরতরে বন্ধ করতে হলে সরকারের প্রভাবমুক্ত, স্বাধীন ও শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকর ভূমিকা থাকতে হবে। এবারের দুদক পুর্নগঠনের মধ্য দিয়ে মানুষ প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি বিরোধী অঙ্গীকারের বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে, এটাই প্রত্যাশিত। কোনো মেরুদÐহীন, দলকানা ও অসৎ ব্যক্তি দিয়ে দুদক বা নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর রাখা অসম্ভব। 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack+Ali ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১১:৫০ এএম says : 0
All the crime and problem will flee if our country ruled by Qur'an. Allah has sole authority to Legislate the Law for human. Human being is created by Allah and He know what is bad or good. Human being manufacture car, car cannot legislated law for for.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন