ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মার্কেটে নকশা বহির্ভূত অবৈধ দোকান উচ্ছেদ অভিযান থমকে আছে। ডিএসসিসির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে ফুলবাড়িয়া-২ মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলুর করা মামলার পর থেকে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রয়েছে। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর মামলার পর সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন ও বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের মধ্যে বাহাস সৃষ্টি হলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। পরবর্তীতে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। সে সময় থেকে মার্কেটের অবৈধ দোকান উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রয়েছে।
গত ৮ ডিসেম্বর ফুলবাড়িয়া-২ মার্কেটের এ, বি ও সি ব্লকের সিটি প্লাজা, নগর প্লাজা ও জাকের মার্কেটে অভিযানের মধ্য দিয়ে উচ্ছেদ শুরু হয়। এরপর ২৩ ডিসেম্বর সুন্দরবন স্কয়ার মাকের্টের অবৈধ দোকান উচ্ছেদ অভিযান চালায় ডিএসসিসি। অভিযানে ফুলবড়িয়ার-২ এর তিন মার্কেটে ৯১১ এবং সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে ৬৬৯টি অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করা হয়।
উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়ে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের ইনকিলাবকে বলেন, উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ নয়, সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত রয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর ওয়াসার খাল সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আগামী বর্ষায় যেন পানিবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় তাই খাল উদ্ধার ও পরিষ্কারে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। সংস্থার কর্মকর্তারা খাল উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন। এই কাজ শেষ হলে আবারও মার্কেটগুলোতে নকশা বহির্ভূত অবৈধ দোকান উচ্ছেদ শুরু করা হবে।
এদিকে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির নেতা ইনকিলাবকে বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ অভিযান এখানেই শেষ। কিন্তু যাদের দোকান ভাঙা হল তারা নিঃস হয়ে গেল।
এদিকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দোকান ভাঙার বিপক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের মতে, যারা লাখ লাখ টাকা দিয়ে দোকান কিনেছে, দোকান ভাঙা হলে তারা নিঃস হয়ে যাবে। কিন্তু যারা টাকা নিয়েছে তাদের কিছুই হবে না। শুধু শুধু এতগুলো মানুষকে নিঃস করে কী লাভ? তারা আরো বলেন, মার্কেটের বিল্ডিংয়ে নতুন ছাদ দিয়ে সেখানে নকশা বহির্ভূতদের পুনর্বাসন করে এরপর দোকান উচ্ছেদ করে সিড়ি, এস্কেলেট, লিফট, ওয়াশরুম, কার পার্কিং ঠিক করলে ভাল হবে। তাহলে মার্কেটের নকশা পুনঃরায় ঠিক হবে, সুন্দর পরিবেশ থাকবে এবং কেউ নিঃসও হবে না। আর যারা অবৈধভাবে দোকান বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) রাজস্ব বিভাগের মার্কেট শাখার যাচাই-বাছাইয়ের তথ্যে ৯৩টি মার্কেটের নকশাবহির্ভূত অবৈধ দোকান ছিল তিন হাজারের বেশি। এর মধ্যে চার ফুলবাড়িয়া-২ ও সুন্দরবন মার্কেটের অভিযানে প্রায় দেড় হাজার অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারে (পুরান বাজার মার্কেট) প্রায় ছয়শত, নিউ সুপার দক্ষিণ মার্কেটে ২০টি, নিউ সুপার উত্তর ডি-ব্লক মার্কেটে ৪১টি, চকবাজার পাবলিক টয়লেট মার্কেটে ১টি নকশা বহির্ভূত দোকান রয়েছে। নিউমার্কেট এলাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ সংলগ্ন দুই পাম্প স্টেশনের মাঝখানে নিজ খরচে সেমিপাকা ঘর তুলে নেয়ার শর্তে ৮৪টি দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। পরে সেখানে অবৈধভাবে তিন তলা মার্কেট নির্মাণ করে বরাদ্দকৃত দোকানের চেয়ে আয়তনে অনেক বড় দোকান তৈরি করা হয়েছে এবং অবৈধভাবে ১১২টি দোকান তৈরি করে বিক্রি করেছে মার্কেট সমিতির নেতা এবং স্থানীয় পর্যায়ের সরকারদলীয় রাজনৈতিক দলের অসাধু নেতারা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন মার্কেটে নকশাবহির্ভূত দোকান সংখ্যা ৯টি, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ হকার্স মার্কেটে দোকান ২৫০টি, নর্থসাউথ রোড সাইড মার্কেটে ৪টি, পুরান ঢাকার নওয়াব ইউসুফ মার্কেট, ভবন-১, ২, ৩, ৪, ৫-এ দোকান ৩৬টি, নওয়াব ইউসুফ এক্সটেনশন মার্কেটের অবৈধ দোকান ৭টি। কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্স ১ নম্বর ভবনের অবৈধ দোকান সংখ্যা ৪৫১টি। কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্স ২ নম্বর ভবনের অবৈধ দোকান সংখ্যা ৪৪৭টি। আহসান মঞ্জিল সুপার মার্কেটের অবৈধ দোকান সংখ্যা ৩৮টি। লক্ষীবাজার মার্কেটের অবৈধ দোকান সংখ্যা ৩৫টি এবং সূত্রাপুর কমিউনিটি সেন্টার মার্কেটের অবৈধ দোকান সংখ্যা ৪৭টি।
সূত্র জানায়, প্রায় দু’দশক ধরে এসব দোকান তৈরি করে বিক্রি করা হয়েছে। প্রতিটি দোকানের ন্যূনতম গড়মূল্য অন্তত ১৩ লাখ টাকা। কিছু দোকান ৫০ লাখ টাকার অধিক মূল্যেও বিক্রি করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে মার্কেটের মালিক সমিতির নেতাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল অসাধু চক্র। ফলে প্রকাশ্যে ডিএসসিসির এসব মার্কেটের নকশা লঙ্ঘন করে অবৈধ দোকানপাট নির্মাণ করলেও নির্বিকার ছিল কর্তৃপক্ষ। এসব মার্কেটের অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করতে আগের কোনো মেয়র বা প্রশাসক কোনো উদ্যোগ নেননি।
তবে ডিএসসিসির বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ডিএসসিসিকে বদলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। প্রথম দিন থেকে তিনি সংস্থার অনিয়ম বন্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। দায়িত্ব নিয়েই অসাধু কয়েক কর্মকর্তাকে চাকুরি থেকে বাদ দেন। তারই ধারাবাহিকতায় মার্কেটের নৈরাজ্য বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এ প্রসঙ্গে মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ডিএসসিসির অনেকগুলো মার্কেটে কয়েক হাজার অবৈধ দোকান রয়েছে। যেগুলো নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর এসব দোকানপাট অপসারণ কাজ শুরু করেছি। সব অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করা হবে। কে কখন, কী উদ্দেশ্যে এসব অবৈধ দোকানপাট বরাদ্দ দিয়েছে-এখানে সেটা বিবেচ্য হবে না। এখানে মূল্য বিবেচ্য বিষয়। নকশাবহির্ভূত দোকান ডিএসসিসি বরাদ্দ দেয়নি। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অনড়। ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় সব মার্কেটের অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা হবে। মার্কেটের মূল বরাদ্দ প্রাপকদের ব্যবসার পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন