সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভাষা আন্দোলন হয় যেভাবে

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৪ এএম

এখন ফেব্রুয়ারি মাস। বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারিকে ভাষা আন্দোলনের মাস বলা হয়। এই ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখে সালাম, বরকত, রফিক প্রমুখ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেন। তাদের এ রক্ত দানের পর কেউ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়নি। পরবর্তীকালে এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

ইতিহাসের কোনো বড় ঘটনাই হঠাৎ করে রাতারাতি ঘটে না। ভাষা আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ সালে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে। বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ যদি অবিভক্ত অবয়বে স্বাধীন হতো তাহলে হয়তো ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নই উঠতো না। কিন্তু তা না হয়ে বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে। এর একটি ছিল ভারত। আরেকটি পাকিস্তান। এর মধ্যে আবার পাকিস্তান ছিল ভারতবর্ষের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম-অধ্যুষিত দুটি ভৌগোলিকভাবে বিছিন্ন জনপদ। দুটি অঞ্চল সাধারণভাবে পরিচিত ছিল পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান হিসাবে। এছাড়া আরেকটি ব্যাপার ছিল, যার উল্লেখ না করলেই নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মোট জনসংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানের একটি প্রদেশের জনসংখ্যার চাইতেও কম ছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানী; সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী তথা সমগ্র প্রতিরক্ষাবাহিনীর সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। এর উপর গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো হাজার হাজার অবাঙ্গালী ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে হিজরত করে। পাকিস্তানিদের পাশাপাশি এ অবাঙ্গালী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে শামিল হয়।

এই ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায় নবসৃষ্ট রাষ্ট্রের পোস্টকার্ড, এনভেলপ, মানি অর্ডার ফরমে ইংরেজির সাথে অন্যান্য এমন কি মৃত ভাষা সংস্কৃতির স্থান থাকলেও সেখানে বাংলার স্থান হয়নি।

ভাষা আন্দোলন শুরু হয় তমদ্দুন মজলিস নামের এক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। এই সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতারা সবাই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। ভাষার দাবির পেছনে তাদের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। অথচ তাদের এ দাবির বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছিল নিছক কল্পনাপ্রসূত।

পূর্বে উল্লেখিত সাংস্কৃতিক পরিষদ তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে ভাষা আন্দোলন দাবিতে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর যে পুস্তিকা প্রকাশ করা হয় তার শিরোনাম ছিল: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু? এই পত্রিকায় তিনজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর লেখা স্থান পায়। তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক ড. কাজী মোতাহার হোসেন এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ।

অধ্যাপক আবুল কাসেম তাঁর লেখায় ভাষা আন্দোলনের দাবি তুলে ধরেন এভাবে: (ক) পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত অফিস-আদালতের মাধ্যম হবে বাংলা। (খ) পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা (গ) পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি: বাংলা ও উর্দু। গোটা ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয় এই তিন দাবির ভিত্তিতে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সমগ্র পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশই ছিলো পূর্ববঙ্গবাসী এবং তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। সে হিসাবে তারা বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করতে পারতো। তা না করে তারা বাংলার সাথে উর্দুকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলো, তাতে তাদের যে উদারতা প্রকাশ পায়, সেটার দিকে নজর না দিয়ে সরকারের তরফে উল্টো ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়।

ভুল বুঝে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বয়ং কায়েদে আজম একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে অবস্থান ঘোষণা করেন। পরে কায়েদে আজম মৃত্যুশয্যায় তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের কাছে এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তিনি অন্যের কথায় বিশ্বাস করে ঢাকায় তার ১৯৪৮ সালে প্রথম সফরের এসে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সংকল্প প্রকাশ করেন। আগে জানলে তিনি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে এমন একপেশে সংকল্প প্রকাশ করে ছাত্র সমাজের ভুল বোঝাবুঝির শিকার হতেন না। কায়েদে আজমের মৃত্যুশয্যায় এ দুঃখ প্রকাশের তথ্য আমরা জানতে পারি বিখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কায়েদে আজম ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকা সফরকালে রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় এবং কার্জন হলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দেন এবং উভয় স্থানে তিনি রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে যে বক্তব্য দেন তার প্রতিবাদ ওঠে। রেসকোর্সের বিক্ষুব্ধ জনসভায় তার প্রতিবাদ ওঠে। তবে বিপুল জনসমাগমের মধ্যে কে কোন দিক থেকে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তা বুঝতে না পারলেও কার্জন হলে সীমিত লোকজনের সভায় তার বক্তব্যের প্রতিবাদ উঠলে তিনি অবাক হয়ে বক্তৃতা থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে হল ত্যাগ করেন। তিনি অবাক হন এ কারণে যে, এই ছাত্রসমাজ মাত্র কিছুদিন আগে পাকিস্তান আন্দোলনে তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সম্ভব করে তোলে, তাদের মধ্যে হঠাৎ এ পরিবর্তন কী করে হলো? পরে তিনি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন, এ বিষয়ে আলোচনা করেন। একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, তিনি ঐ ১৯৪৮ সালেরই ১২ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু পর্যন্ত এ বিষয়ে আর প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দেননি; বরং মৃত্যুশয্যায় তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্নেল এলাহি বক্সকে বলেন, অন্যের কথায় তিনি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বক্তব্য দিয়ে ভুল করেছেন। এ বিষয়টি তার গণপরিষদের উপর ছেড়ে দেয়া উচিৎ ছিল।

পরবর্তীকালে পাকিস্তান গণপরিষদে পাকিস্তানের যে সংবিধান অনুমোদিত হয়, তাতে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের দু’টি রাষ্ট্রভাষা করা হয় এবং এ সম্পর্কিত ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তিস্বরূপ ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবও সক্রিয় বিবেচনায় আসে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এবং এর ফলে তদানীন্তন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার বিবেচনায় প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং আরও পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বাধিকার চেতনা জোরদার হতে থাকে।

এর মধ্যে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠতে থাকে। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকার চেতনা জোরদার হয়ে উঠতে থাকে। এসময় ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের গণসমর্থন প্রাপ্ত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ একচেটিয়া সাফল্য লাভ করার পর নির্বাচনজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দেশে সামরিক আইন জারি করে জনগণের স্বাধিকার চেতনাকে পশু বলে ধ্বংস করে দেবার চেষ্টা চালায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সফলতা লাভ করে। এই মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি প্রথমে পাকিস্তান থেকে লন্ডন গমন করেন। তখনই জানতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি ঘটার পরও কিছু ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে রয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে তার ইতিকর্তব্যও ঠিক করে ফেলেন। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি দিল্লিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে প্রথম সুযোগেই প্রশ্ন করে বসেন: ম্যাডাম, বাংলাদেশ থেকে আপনার বাহিনী কখন ফেরৎ আনবেন? জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন: আপনি যখন বলবেন, তখনই। এভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী অপসারন সহজ হয়ে ওঠে। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিশ্বব্যাপী এমন ইমেজ যে, অন্য কোনো রকম জবাব দেয়াই ইন্দিরাগান্ধীর পক্ষে সম্ভব ছিল না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন