শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

হজযাত্রা ও কোরবানী হোক আরো স্বস্তিময়

প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : সারা দুনিয়ার হজযাত্রী মুসলমান এখন পবিত্র ভূমিতে সমবেত। আর দু-চার দিনের মধ্যে তারা সবাই পৌঁছে যাবেন মক্কা শরীফে। কারণ, চলতি সেপ্টেম্বরের দশ তারিখের পর এবারকার হজের সম্ভাব্য সময়। বাংলাদেশ থেকে এ বছর এক লাখ এক হাজারের বেশি হজযাত্রী গিয়েছেন। অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য বিখ্যাত এই দেশে বরাবরের মতো এবারও হাজীদের সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হয়েছে। নিবন্ধন, বাড়ি ভাড়া, ভিসা, টিকেট ও ফ্লাইটে ওঠা পর্যন্ত অধিকাংশ হজযাত্রীকে এত অনিশ্চয়তা ভোগান্তি হয়রানি সহ্য করতে হয়েছে যার নজির দুনিয়ার কোথাও নেই। এমনকি অতীতে বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে প্রায় সকল হজযাত্রীর এভাবে নাস্তানাবুদ হওয়ার ঘটনা দেখা যায় না।
এ বিষয়ে চিন্তাশীল মহল মন্তব্য করেছেন, একশ্রেণির নাস্তিক-মুরতাদ মহান ইসলাম ও মুসলমানদের পবিত্র ইবাদত হজের প্রতি বিদ্বেষ থেকেই কৌশলে প্রতিটি জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে বিপত্তি সৃষ্টি করেছে; যেন মানুষ হজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আর না হয় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিন-চারবার হজ-ব্যবস্থাপনা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হওয়ার পর, একবার সউদী সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ এশিয়ার সেরা হজ-ব্যবস্থাপনাকারী দেশ বলে আখ্যায়িত হওয়ার পর এবং হজযাত্রী সত্তর আশি হাজার থেকে লাখের ওপরে পৌঁছে যাওয়ার পর হঠাৎ করে গত দু-বছর হজ-ব্যবস্থাপনায় চরম বিপত্তি হওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা ইসলামবিদ্বেষী শক্তির কূটচালেই হজযাত্রীদের এ দুরবস্থা। তাদের ব্যাপারে সরকারের দু’মেয়াদের গত ৮ বছর ধরেই আমরা প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করে এসেছি। ধর্মপ্রাণ জনগণ এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছেন। আশা করি প্রধানমন্ত্রী নিজে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। প্রয়োজনে হজ-সংক্রান্ত অফিসগুলো ইসলামপ্রিয় কর্মকর্তাদের দিয়ে ঢেলে সাজাবেন। একজন প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও সক্রিয় মন্ত্রীও সংশ্লিষ্ট দফতরে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কেননা, গত দু’বছর, বিশেষ করে চলতি বছর, হজের প্রাক্কালে মাসব্যাপী হাজার হাজার হজযাত্রীর যে পরিমাণ দুর্গতি, হতাশা, ক্ষোভ ও কান্না বাংলাদেশের বাতাসে জমাট বেঁধেছে একটি সরকারের জন্য মন্দ পরিণতি ডেকে আনতে এটুকুই যথেষ্ট।
প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, মুসলমানদের ওয়াজিব ইবাদত কোরবানী নিয়েও কতিপয় ইসলামবিদ্বেষী লোক অহেতুক নেতিবাচক ও তিক্ত বাতাবরণ তৈরি করতে সচেষ্ট রয়েছে। জীবনভর চলে আসা এ ধর্মীয় অনুষ্ঠানটির কঠোর সমালোচনা ও ছিদ্রান্বেষণে তারা সারা বছরই বগল বাজিয়ে চলেছেন। কোরবানীর বর্জ্য মনে হয় তাদের মাথায় স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। বছরের যে তিনটি দিন কোরবানীর হুকুম সে তিনদিন প্রতিটি ব্যক্তি ও পরিবার তাদের নিজ উদ্যোগে কোরবানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সহায়তা করলে মানুষের কষ্ট লাঘব হয়। তারা দ্রুত বর্জ্য অপসারণের বাড়তি ব্যবস্থা নিতে পারেন। সম্ভব হলে বাড়ি বাড়ি প্লাস্টিকের ব্যাগ সরবরাহ করতে পারেন। এমনকি যত্রতত্র রক্ত ও বর্জ্য যেন কেউ ফেলে না রাখে সেজন্য প্রচারণা, মোটিভেশন ও প্রয়োজনে সাজার ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু কোরবানীর মতো ইবাদতকে কেউ নিরুৎসাহিত ও বাধাগ্রস্ত করতে পারেন না। এখানেও ধর্মের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ ও ধর্মপালনে অগ্রসর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারের ভেতর লুকিয়ে থাকা বর্ণচোরা ধর্মহীন নাস্তিক-মুরতাদ চক্রই কৌশলে কলকাঠি নাড়ছে।
কোরবানী নিয়ে এমন কিছু নির্দেশনা আলোচনায় এসেছে যার বিষয়ে অভিজ্ঞ মহল তাদের হতাশা ব্যক্ত করেছে। তাদের মতে, কোরবানীর মতো ইবাদতকে সাধারণ গরু জবাই মনে করে যারা এজন্য স্থান নির্ধারণ করেছেন তাদের এ চিন্তা নিতান্তই ভুল ও অবাস্তব। সব পরিবারের রান্না, সব আয়োজনসহ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত রন্ধনশালায় গিয়ে যদি নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করার আইন জারি করা হয়, তাহলে ঈদের দিনে আমাদের নারীসমাজ বিশেষত সমস্ত মুসলিম পরিবারগুলোর যে দুরবস্থা হবে এবং এ সিদ্ধান্ত যতটা অবাস্তব ও নিবর্তনমূলক হবে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে সারাদেশের কোরবানী সম্পন্ন করার আইন এর চেয়ে কম অবাস্তব নয়। কেননা, দুনিয়ার কোথাও এমন কোনো নিয়ম নেই। যেসব দেশে এ ধরনের নিয়ম চালু হয়েছে সেসব দেশের গোটা সংস্কৃতিই এ ধরনের উন্নতি ও শৃঙ্খলার দ্বারা আবদ্ধ। সেখানকার পরিবেশে সারা বছর আবর্জনার গন্ধ থাকে না। মল, মূত্র ও বর্জ্য চারপাশে নিয়ে তাদের বসবাস করতে হয় না। সেখানে বৃষ্টিতে পানি জমে না, ড্রেন ও ম্যানহোল উপচে পড়ে নাগরিকদের জীবন ওষ্ঠাগত করে তোলে না। রাজপথ ও অলিতে গলিতে ময়লা পানি ও মানববর্জ্য পরিদৃষ্ট হয় না। আমাদের দেশে সাধারণ পরিবেশ উন্নত ও দূষণমুক্ত না করে কোরবানীর তিন-চার দিন কেবল স্বাভাবিক ও চিরন্তন এ কাজটির পেছনে লেগে কতটুকু কী তারা করতে পারবেন সেটাই প্রশ্ন।
একটি গরু কয়েকজনে কোরবানী দিলে সেখানে কোনোরকম ছাড় বা সমঝোতা চলে না। নিখুঁতভাবে পরিমাপ করে এটি বণ্টন করা শরিয়তের নির্দেশ। বণ্টন সম্পন্ন হওয়ার আগে তা থেকে কিছু নেয়া বা দান করাও বৈধ নয়। একই প্রশ্ন শরিকানা পশুর চামড়া নিয়েও। ব্যক্তিগত কোরবানী বা একজনে একাধিক পশু কোরবানীর ক্ষেত্রেও কিছু পারিবারিক করণীয় থাকে। গোশত কীভাবে কাটা হবে, কীভাবে বিন্যস্ত করা হবে, সামাজিক ও ধর্মীয় চাহিদা পূরণে কীভাবে তা বণ্টন বা বিতরণ করা হবে ইত্যাদি প্রসঙ্গে কেবল জবাইকারী বা কসাইর উপস্থিতি যথেষ্ট নয়, সেখানে মালিক শরীক পরিবারের কর্তা ও ছোট-বড় নারী-পুরুষ সদস্যদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি সংশ্লিষ্টতা ও অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে থাকে। অতএব, হাজার হাজার পশু নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে কোরবানী করার যে বিধান তা কোনো সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নয়। তা ছাড়া এতে কোরবানী দাতাদের বাড়তি লোকবল, যানবাহন, নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলার সমস্যা থেকেই যায়।
অনেক সময় দেখা যায় কোরবানীর চামড়ার ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ ও সিন্ডিকেটের খবরদারি। সে চামড়া দিয়ে দেশের লক্ষ লক্ষ অনাথ, এতীম, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু আবহমানকাল থেকে দীনি শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও আশ্রয় পেয়ে এসেছে একশ্রেণির ইসলামবিদ্বেষী এ ঐতিহ্য ও অবদানটির প্রতি শ্যেনদৃষ্টি ফেলেছে। এ চক্রটি কোরবানীর চামড়া লিল্লাহ-বোর্ডিংয়ে না দিয়ে অন্যকিছু করার জন্য মানুষকে বাধ্য করছে, যা শরীয়তের অনেকগুলো বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নির্দিষ্ট লোক ছাড়া যে কেউ পশু জবাই করতে পারবে না বা ১৮ বছর হয়নি এমন কেউ জবাই করতে পারবে না, এ সব বিধি-নিষেধও কোরবানীবান্ধব নয়। শরীয়তের কাজ শরীয়ত অনুযায়ীই করতে দেয়া উচিত। নতুন আইন এখানে নিষ্প্রয়োজন। কেউ কেউ আবার এক্ষেত্রে পবিত্র হজের পশুর কোরবানীর উদাহরণ দিয়ে থাকেন। এদের উদ্দেশ্যও মহৎ নয়। তাদের জানা উচিত যে, মিনা প্রান্তরে লাখো হাজী যে ‘দমে শোকর’ বা অন্যান্য দম দিয়ে থাকেন তা পারিবারিক বা সামাজিক কোরবানী নয়। সেখানে গোশত সংগ্রহ, তিন ভাগে বিভক্ত (ঐচ্ছিক), রান্না-খাওয়া, ঈদ উৎসব ইত্যাদি কিছুই করার সুযোগ থাকে না। মিনার কোরবানী রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্দিষ্ট স্থানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করা হয়। কিন্তু হজযাত্রী ছাড়া সাধারণ সউদী নাগরিকদের ওয়াজিব কোরবানী মিনার জবেহখানায় হয় না। সেসব ঘরে ঘরে মহল্লায় মহল্লায় সামাজিকভাবেই হয়। সুতরাং বাংলাদেশের কোরবানীর সাথে তুলনা হজের অঙ্গ কোরবানীর করা মোটেও ঠিক নয়।
আমরা আশা করব, সারাদেশের জনজীবন ও পরিবেশ আধুনিক ও উন্নত করার পাশাপাশি কোরবানীর বর্জ্য-ব্যবস্থাপনাও আধুনিক করা হোক। তাই বলে এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে মানুষ কোরবানী দিতে দ্বিধান্বিত হয়, পশু জবাই ব্যবস্থাপনায় বিরক্ত ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, পশুর চামড়া নিয়ে বিপন্ন ও আক্রান্ত হয়। রক্ত ও বর্জ্য সঠিক নিয়মে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা বা পৌঁছে দেওয়া বাধ্যতামূলক করলে এবং কর্তৃপক্ষ বাড়তি লোকবল ও ব্যবস্থা নিলে তিন থেকে পাঁচদিন পর বাংলাদেশে কোরবানীর কোনো চিহ্নই পাওয়া যাবে না, যা এমনিতেও পাওয়া যায় না। এখানে সমস্যা রক্ত, বর্জ্য বা পরিবেশ নয়, সমস্যা নাস্তিক, মুরতাদ ও ধর্মবিদ্বেষী কতিপয় ব্যক্তির সংকীর্ণ মন। আশা করি, সরকার ও বিশেষ করে নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার সচেতন প্রধানমন্ত্রী বিষয়টির প্রতি সুদৃষ্টি দেবেন। হজ ও কোরবানীর প্রতি তার দায়িত্বশীলতা ও মমত্ববোধ মহান ইবাদত দুটিকে সহজ ও গতিশীল করবে। দুষ্টচক্র দ্রুত চিহ্নিত ও অপসৃত হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
হারুন ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ৫:০৫ পিএম says : 0
সকল মুসলমানদের এটাই প্রত্যাশা করে।
Total Reply(0)
সাইফুল ইসলাম ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ৫:০৬ পিএম says : 0
এই বিষয়গুলো নিয়ে লেখায় লেখক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী সাহেবকে অসংখ্য মোবারকবাদ।
Total Reply(0)
নাসিম ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ৫:০৮ পিএম says : 0
হজযাত্রীরা যেন কোন ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দিতে হবে।
Total Reply(0)
আবু রায়হান ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ৫:০৯ পিএম says : 0
সারাদেশের জনজীবন ও পরিবেশ আধুনিক ও উন্নত করার পাশাপাশি কোরবানীর বর্জ্য-ব্যবস্থাপনাও আধুনিক করা হোক।
Total Reply(0)
মামুন ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ৫:১১ পিএম says : 0
মুসলমানদের ওয়াজিব ইবাদত কোরবানী নিয়েও কতিপয় ইসলামবিদ্বেষী লোক অহেতুক নেতিবাচক ও তিক্ত বাতাবরণ তৈরি করতে সচেষ্ট রয়েছে। এদের ব্যাপারে সকলকে সজাগ থাকতে হবে।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন