গ. আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুক্তিঃ ইসলামী শরীয়া কর্তৃক শরীরের অভ্যন্তরে খাদ্য হিসেবে অপবিত্র বস্তু প্রবেশ নিষিদ্ধ করার স্বপক্ষে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান স্বীকৃত যৌক্তিক কারণও রয়েছে। সাধারণত খাদ্য পাকস্থলীতে পরিপাক হয় এবং এর সারাংশ রক্তের মাধ্যমে শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ধমনী বা শিরায় কোন কিছু প্রবেশ করানোর পর তা সরাসরি রক্তের মাধ্যমে দ্রুত ও সহজেই শরীরের সর্বত্র পরিচালিত হয়। এভাবে রক্তের মাধ্যমে জানা ও অজানা বিভিন্ন রোগের জীবাণু একজনের দেহ থেকে অন্যের দেহে প্রবেশ করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার আলোকে জানা যায় যে, প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমেও হেপাটাইটিস-বি ও সি, এইডস ও আরও অনেক জানা অজানা প্রাণঘাতী রোগ সংক্রমিত হয় এবং মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। কোন প্রাণী জবাই করার পর যে রক্ত বের হয়ে আসে তাতে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান, জমাট বাঁধার উপাদান (Heparin), Toxin ও বিভিন্ন Pathogenic micro-organism থাকে। এগুলো প্রাণীদেহের ভিতরে থাকা অবস্থায় প্রাণীদেহের সুস্থতায় ভূমিকা রাখে। কিন্তু এসব পদার্থ খাদ্য হিসেবে খুবই ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা রক্ত খাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন।
মূলত আল্লাহ তা’আলা এসব বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়ার জন্যই পশু-পাখি জবাই করে রক্ত বের করে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন। খাদ্য হিসেবে রক্ত নিষিদ্ধ হওয়ার এ বৈজ্ঞানিক কারণটি অনেক গবেষণার পর সুস্পষ্ট হয়েছে। তাই রক্ত সংস্পর্শের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডিম্পোসিবল্-সিরিঞ্জ ব্যবহৃত হচ্ছে। একজনের ব্যবহৃত সুঁচ যেন অন্যের দেহের সংস্পর্শে না আসে সেজন্য সেমিনার, ব্যানার, পোস্টার ও লেখালেখির মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে।
দুই. রক্তদান বৈধঃ বর্তমান সময়ের অধিকাংশ আলিম ও ফিকহ বোর্ডের সিদ্ধান্ত মতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তদান ও পরিসঞ্চালন বৈধ। এমত পোষণকারীদের মধ্যে রয়েছে, মিসরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাতওয়া কমিটি, সৌদী আরবের বিদগ্ধ আলিমগণের সংস্থা “হাইয়াতু কিবারিল উলামা”, রাবিতাতুল আলাম আল-ইসলামী অধিভুক্ত ফিকহ কমিটির সিদ্ধান্ত।
তাদের দলীল ও যুক্তিগুলো হলো- ক. জীবন রক্ষা একটি গুরুত্ব দায়িত্বঃ ইসলামী শরীয়ার একটি প্রধান লক্ষ্য হল ‘হিফজুন নাফ্স’ বা জীবন রক্ষা করা, যা চিকিৎসা বিদ্যার প্রাথমিক এবং মৌলিক উদ্দেশ্য। পবিত্র কুরআন মানুষের জীবন রক্ষাকে এক গুরু দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন- কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো লোককে হত্যা করে, যে লোক কাউকেও হত্যার অপরাধে অপরাধী নয়, কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেনি; সে (হত্যাকারী) যেনো পুরো মানব জাতিকেই হত্যা করলো। আর যে তাকে বাঁচিয়ে রাখে সে যেনো পুরো মানব জাতিকে বাঁচালো। পবিত্র কুর’আন এ আয়াতে একজন মানুষের জীবন রক্ষাকে পুরো মানবজাতির জীবন রক্ষার সমকক্ষ বলে ঘোষণা করেছে। অন্যকথায় কোনো মানুষ যদি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য চেষ্টা করে তাহলে সে পুরো মানব জাতিকে জীবিত রাখার কাজ করে।
খ. সংকট নিষিদ্ধতাকে বৈধ করেঃ ইসলামী শরীয়া জীবন নাশের হুমকি মোকাবিলায় সংকটময় সময়ের জন্য যে কোন নিষিদ্ধতাকে সাময়িকভাবে বৈধ করেছে। এরূপ পরিস্থিতিতে ‘ক্বাওয়ায়িদ আশ-শরীয়ায়’ বর্ণিত জরুরি’ অবস্থায় মৃত প্রাণীর গোশত খাওয়ার অনুমোদনের সাথে তুলনা করা যায়। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার বিধান অন্য স্বাভাবিক অবস্থায় নিষিদ্ধ বা নিরুসাহিতকৃত পদ্ধতিকেও অনুমোদন করে। তাই গুরুতরভাবে অসুস্থ ও দুর্বল কোন রোগীর জীবন রক্ষার্থে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেই রোগীর শরীরে রক্ত সরবরাহ অর্থাৎ ব্লাড ট্রান্সফিউশন করা অত্যন্ত জরুরি বলে পরামর্শ দিলে সংকটকালীন রক্তদান বৈধ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, কিন্তু যদি কেউ নিরুপায় হয়ে পড়ে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সীমালংঘনকারী না হয়, তাহলে তার কোন অপরাধ হবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়াবান।
গ. রক্তদানের পক্ষে হাদীসে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতঃ রাসূল স.-এর একটি হাদীসে দূষিত রক্তকে উত্তম রক্ত দ্বারা বদলে দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যক্তির অসুস্থতার পর যথাযথ চিকিৎসা প্রদান তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ সতেজ করে তোলে। আতা ইবনে ইয়াসার রা. হতে বর্ণিত, রাসূল স. বলেন, যখন কোন মানুষ রোগাক্রান্ত হয় তখন আল্লাহ তা’আলা তার কাছে দুজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন এবং তাদের বলেন, দেখ! অসুস্থ ব্যক্তি তার সেবাকারীদেরকে কি বলছে। যদি ঐ ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার শুকর করতে থাকে তবে ফিরিশতাদ্বয় আল্লাহ তা’আলার কাছে সে সংবাদ নিয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমি যদি তাকে মৃত্যু দেই তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যদি তাকে রোগ থেকে মুক্তি দেই তবে তার খারাপ গোশতকে ভাল গোশত দ্বারা এবং দূষিত রক্তকে উত্তম রক্ত দ্বারা বদলে দেব এবং তার গুনাহ ক্ষমা করে দেব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন