শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

সন্তান প্রতিপালনে ইসলামের দিকনির্দেশনা

হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ ইসমাঈল | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৭ এএম

তরবিয়ত কি : সাংস্কৃতিক অর্থে তরবিয়ত একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, যা সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে তার আচার-ব্যবহার, বৈষয়িক জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিদ্যায় সমৃদ্ধ করে। তবে এক সমাজের সঙ্গে অন্য সমাজের পার্থক্যের কারণে তরবিয়তের ধরনে ব্যবধান হয়। কারণ প্রতিটি সমাজের বৈশিষ্ট্য এক নয়, ভিন্নও হয়। তরবিয়তের ক্ষেত্রে প্রদান ও গ্রহণ এ দুটি বিষয়ই হলো আসল। প্রদানটা হবে অভিভাবকের পক্ষ থেকে; আর গ্রহণটা হবে সন্তানের পক্ষ থেকে। অভিভাবকের প্রদান শুধু তখনই ফলপ্রসু হবে, যখন তা নির্ভুল পদ্ধতি ও সঠিক উপকরণসহ হবে। তাই দীক্ষা ও প্রতিপালন যদি অভিভাবক ও সন্তানের পরস্পর আদান-প্রদান তাদের গভীর সম্পর্কের মাধ্যমে না হয়, তাহলে তা হবে অসাড় ও নিষ্প্র্রাণ প্রচেষ্টা; যা কখনোই ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।

আজকের সন্তান আগামীর ভবিষ্যত। এদের সঠিক পরিচর্যা ছাড়া সমাজের বস্তুনিষ্ঠ পরিবর্তন, সার্বজনীন ও শাশ্বত কল্যাণ আসা করা যায় না। ইরশাদ হচ্ছে-‘আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।’ (সুরা রাদ : ১১)।
‘তরবিয়ত’ আরবি শব্দ। মূলধাতু হিসেবে এর অর্থ হলো- সুগঠিত করা, পরিপক্ক করে তোলা, প্রবৃদ্ধি ও পরিপূর্ণ করা, প্রতিপালন করা এবং অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা, ইত্যাদি। অর্থাৎ ব্যক্তির তরবিয়ত বা প্রতিপালন ও তার পরিচর্যা এমনভাবে হতে হবে, যা তাকে নিশ্চিত আত্মপ্রত্যয়ী ও রাসুল (সা.)-এর আদর্শ উম্মত হতে সাহায্য করে।
বড়দের চোখে সন্তান প্রতিপালন : মনীষীরা বলেন-‘ব্যক্তিকে তার বিশ্বাস, ইবাদত, চরিত্র, বুদ্ধি ও স্বাস্থ্য এবং তার আচার-ব্যবহার ও গতিবিধি তথা জীবনের প্রতিটি বাঁকে তাকে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতির ওপর নিয়ে আসা, যা ইসলাম অনুমোদন করে।’ আল্লামা ইসফাহানি (রহ.) বলেন- ‘রব’ শব্দটির মূল হচ্ছে ‘তারবিয়াহ’। তা হলো, কোনো বস্তুকে পর্যায়ক্রমে পূর্ণাঙ্গরূপ নিয়ে যাওয়া। ইমাম বায়জাবি (রহ.)-ও অনুরূপ অর্থ করেছেন-‘কোনো বস্তুকে ধীরে ধীরে পূর্ণতা দান করা।’ বিশিষ্ট হাদিসবিশারদ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন-‘তরবিয়ত হচ্ছে কোনো বস্তুর সংগঠন ও সংশোধনের দায়িত্বভার গ্রহণ। তরবিয়ত তার গ্রহিতার ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে থাকে, এমনকি তা সন্তানকে এক রণাঙ্গন থেকে বিপরীতধর্মী রণাঙ্গনে নিয়ে যেতে পারে।’ রাসুল (সা.) বলেন-‘প্রতিটি নবজাতক তার স্বভাবজাত ধর্ম ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইহুদি, খৃস্টান অথবা অগ্নিপূজক হিসেবে গড়ে তোলে। যেমন- কোনো চতুষ্পদ জন্তু পরিপূর্ণ সন্তান জন্ম দেয়। তখন কি তোমরা তাকে কান-কাটা অবস্থায় দেখতে পাও!’ (সহিহ বোখারি : ১৩৫৮)।
এ হাদিস থেকে অভিভাবকদের মন্দ ভ‚মিকার কুফল সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি তার চাল-চলন, চরিত্র ও সমাজের বিশ্বাসের অনুক‚ল দায়িত্ব পালনে যত্নবান হওয়ার গুরুত্বও প্রমাণিত হয়েছে। তাই একজন অভিভাবককে সঠিক ভিত্তির ওপর তৈরি করার কাজটা সর্বোচ্চ এবং সর্বাধিক গুরুত্বের দাবি রাখে। বস্তুত আল্লাহর মেহেরবানিতে প্রকৃত অভিভাবক তো সমাজের মেরুদন্ড; যে ব্যক্তিকে সংগঠন ও বিনির্মাণে কার্যকর ও সফল ভ‚মিকা রাখতে সক্ষম।
সন্তান অপার নেয়ামত : আল্লাহতায়ালা মানুষকে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন- সুস্থতা ও সম্পদের নেয়ামত, আখলাক ও ইবাদতের নেয়ামত। দিয়েছেন আরও অসংখ্য নেয়ামত। এসবের মাঝে একটি বড়ো নেয়ামত হলো- সন্তান। এ নেয়ামতের মূল্য অনুভুত হয় নবীদের কাছ থেকেই। তাদের সন্তান না হলে আল্লাহর কাছে এ নেয়ামত প্রার্থনা করেছেন। নেকসন্তান দানের দোয়া করেছেন। হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম বৃদ্ধ বয়সে দোয়া করলেন-‘হে আমার প্রতিপালক! আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। বার্ধক্যে আমার মস্তিষ্ক প্রায় নিস্তেজ। হে আমার প্রতিপালক! আপনার কাছে দোয়া চেয়ে কখনও ব্যর্থ হই নি। আমার পর আমার স্বগোত্রীয়দের সম্পর্কে আমি বড়ো শঙ্কিত। কিন্তু আমার স্ত্রী তো বন্ধ্যা। তাই আপনি আমায় এমন একজন উত্তরাধিকারী দান করুন, যে আমার ও ইয়াকুবের বংশের উত্তরাধিকারীত্ব ধরে রাখবে। হে আমার প্রতিপালক! তাকে করুন সন্তোষভাজন।’ (সুরা মারইয়াম : ৪-৬)। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামও আল্লাহর কাছে নেকসন্তান চেয়ে দোয়া করেছেন-‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে নেকসন্তান দান করুন।’ (সুরা সাফফাত : ১০০)। তার সেই নেকসন্তানই হলেন হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। যে নেকসন্তান ও আদর্শ বাবার মাধ্যমে আমরা কোরবানির মতো অপার মহিমার ইবাদতে ধন্য হয়েছি।
জীবনে ‘সন্তান’ অধ্যায়ের গুরুত্ব আলেমদের কাছ থেকেও অনুধাবন করা যায়। বড়ো আলেমদের প্রায় অধিকাংশই ‘দাম্পত্যজীবন’ বিষয়ে কোনো না কোনো বই অবশ্যই লিখেছেন। হজরত থানবি (রহ.), মুফতি তাকি উসমানি, আল্লামা আলী তানতাবি (রহ.), মাওলানা আবদুর রহিম (রহ.), মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ, আল্লামা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহ.), মুফতি আবদুল হামিদ মাদানি, মুফতি রুহুল আমিন যশোরিসহ অনেক আলেমের বই রয়েছে এ বিষয়ে। কারণ বর্তমানে সন্তান প্রতিপালনের ব্যাপারে পিতামাতার ভয়ঙ্কর রকম গাফলতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা নিজ সন্তানকে পশ্চিমা রঙে রাঙাতে চাচ্ছেন। সন্তানদের বৈধ-অবৈধ সমস্ত চাহিদাই রক্ষা করছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে সঠিক ও পূর্ণ দীনি শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত করছেন। এটা সন্তানের প্রতি ঘোর অন্যায় ও আল্লাহতায়ালার বিধানের প্রতি সীমালঙ্ঘন। গভীরভাবে দৃষ্টিপাত ও চিন্তা করলে আরও পরিষ্কার পরিলক্ষিত হয়, আজকের অধিকাংশ সন্তান বিগড়ে যাবার মূল কারণ, কোনো না কোনো দিক থেকে তার প্রতি পিতামাতার সঠিক পরিচর্যার অভাব ও তার সংশোধনে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে দুর্বলতা।
নানা অপরাধে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের সংখ্যা বৃদ্ধি : নিষ্পাপ ও ছোটো সন্তানদের ব্যাপারে সাধারণত মাতাপিতার বিশ্বাস থাকে- তারা এখনও অবুঝ ও নিষ্পাপ। যেহেতু তারা এখনও সবকিছু বোঝার বয়সে উপনীত হয় নি, তাই তাদের প্রতিটি বিষয়ে তারা সূ² নজরদারি করেন না। কিন্তু অভিজ্ঞতার নিরীখে দেখা গেছে, সন্তানের ব্যাপারে মা-বাবার সঠিক চিন্তা-চেতনার অভাবে এবং তাদের তরবিয়তে গাফলতি করার কারণে এরা এক পর্যায়ে বড়ো বড়ো অপরাধের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকা ও টিভি মিডিয়ার সংবাদ পর্যবেক্ষণ করে জানা গেছে, বর্তমান বিশ্বে চুরি, জিনা, নেশাদ্রব্য পান, মার্ডারসহ আরও বিভিন্ন অপরাধীর মাঝে ১৮ থেকে নিম্নবয়সীদের দখলদারি দিনদিন বাড়ছে। প্রতিবছর বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট থেকেও স্পষ্ট হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ বয়সী বাচ্চাদের সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০১৫-এর ৮ এপ্রিল, টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্ট সংসদের কাছে অনুরোধ জানায়, ‘বিভিন্ন অপরাধে বড়োদের চেয়ে বাচ্চাদের শাস্তি কম করা’ এ সিদ্ধান্তটিতে যেনো পূর্ণ দৃষ্টিপাত করা হয়। বিবেচনা করা হয়। কারণ তাদের ওপর এ কম শাস্তি প্রয়োগের ফলে দিনদিন বাচ্চাদের ভেতর অপরাধ বাড়ছে। এন.এস.ডি.ইউ.এস-এর একটি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, বারো থেকে পনেরো বছর বয়সী কিশোরদের ভেতর ৩৫ শতাংশ এমন, যারা জীবনে একবার হলেও মদপান করেছে। আর ৪৫ শতকরা কিশোর এমন, যাদের নেশাদ্রব্য অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। আর ১৪ শতকরা কিশোর এমন, যাদের পুরোপুরি অভ্যাস গড়ে উঠেছে। এদের রিপোর্ট অনুযায়ী আরও জানা যায়, দৈনিক ৫৫০০ বাচ্চা নতুন করে ধূমপান শুরু করছে। উইকিপিডিয়ার এক রিপোর্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে- পুরো দুনিয়ায় ১০ মিলিয়ন শিশু কিশোর এমন, যারা জিনাকারী হয়ে উঠেছে।
ছোটো থেকেই অপরাধী হয়ে ওঠা এ শিশু-কিশোররা ভবিষ্যতে তার বংশ পরম্পরাকে কোন পথ দেখাবে এবং তাদের সন্তানদের কতো অন্ধকারে ঠেলে দেবে, তা কল্পনাও করা যায় না। এই অপরাধী শিশু-কিশোররা কিভাবে তাদের কওমের রক্ষণাবেক্ষণ করবে? কিভাবে তাদের সন্তানদের সঠিক প্রতিপালন করবে? কারণ আজ তারাও অপরাধী হয়েছে তাদের প্রতি পিতামাতার উদাসীনতার কারণেই।
বোঝার বিষয় হলো, এ বাচ্চাদেরকে কারা অপরাধী বানাচ্ছে? কিভাবে অন্যায় জড়িত হবার সুযোগ তারা পাচ্ছে? কারণ সে তো নিষ্পাপ হয়ে জন্মেছিলো। এসব মন্দ কর্ম সম্পর্কে তার অবগতিই ছিলো না। এসব কোত্থেকে শিখছে সে?
১. সাইকোলজি বিশেষজ্ঞদের মতে বাচ্চারা বিগড়ে যাবার অসংখ্য কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো, সন্তান তরবিয়তের ক্ষেত্রে পিতামাতার উদাসীনতা। তাদের কারণেই একজন শিশু সন্তান তার ভবিষ্যৎকে নষ্ট করে ফেলেছে। বড়ো বড়ো গোনাহে লিপ্ত হচ্ছে।
২. মাতাপিতা যখন বাসায় অনুপস্থিত থাকেন, প্রয়োজনে বাইরে যান, আর সন্তানকে প্রতিবেশীর কাছে বা অন্য কারো কাছে রেখে যান, তখন সন্তানের মধ্যে মন্দ প্রভাব ও খারাপ চাওয়া দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ অনেক মা-বাবা চাকরি করেন বর্তমানে। যারা সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন না।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে থাকতে হয় তাদের। অনন্যোপায় হয়ে কাজের লোকের কাছে অথবা প্রতিবেশীর কাছে রেখে যেতে বাধ্য হন। দীর্ঘ সময় সে পিতামাতা থেকে দূরে থাকে। মা-বাবা ও নিজ ঘরের পরিবর্তে সে ভিন্ন পরিবেশের সঙ্গ পেয়ে নিজের মাঝে তার আসর গ্রহণ করে। সবসময়ের স্বাভাবিক পরিবেশের পরিবর্তে নতুন পরিবেশ পেয়ে সে আনন্দ উপভোগ করে এবং মা-বাবাকে তার অমঙ্গলকামীভাবে। সন্তানের এ নিষ্পাপ স্বভাব ও অবুঝ মনের অস্বাভাবিক পরিবর্তনের প্রতি মা-বাবা সিরিয়াস হন না। এভাবে তাদের উদাসীনতার কারণে অপ্রতিকূল পরিবেশে তার তরবিয়ত হতে থাকে। ধীরে ধীরে তার মেজাজের পরিবর্তন হয় এবং মাতাপিতার অবাধ্য হয়ে বিগড়ে যায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন