মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা সৃষ্টি করেছেন। মানবজাতির জন্য ভাষা খোদা প্রদত্ত দান, এক মহানেয়ামত। ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন: ‘পরম করুণাময় আল্লাহ, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে’ (সুরা রাহমান)। এই আয়াতে ভাব প্রকাশ করতে মাতৃভাষাকে বুঝানো হয়েছে, যা বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ ছাড়াই প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে নিজেই বলতে পারে এবং মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। পৃথিবীর সকল প্রাণীর নিজস্ব ভাষা আছে। সকল প্রাণী তাদের ভাব প্রকাশের জন্য ধ্বনি বা আওয়াজ দিয়ে থাকে। অন্য প্রাণির মুখ নিঃসৃত শব্দ অর্থাৎ তাদের মুখের ভাষা আমরা বুঝতে পারি না। তাদের নিজেরা পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারে। ভাষা মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। একমাত্র মানুষ অর্থবোধক শব্দ দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। সেটাই তার ভাষা। পৃথিবীর এক এক স্থানের ভাষা এক এক রকম। আল্লাহতায়ালা তার কুদরত প্রদর্শনের জন্য সুন্দর এই পৃথিবী, বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত মানুষ ও ভাষার সৃষ্টি করেছেন। এ সর্ম্পকে মহাগ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন: ‘এবং তাঁর (আল্লাহর কুদরতের) নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে’ (সুরা রুম-২২)। আল্লাহতায়ালা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এরশাদ করেছেন: ‘আমি কোন নবী এমন পাঠায়নি, যে তার মাতৃভাষায় (আমার বাণী মানুষের কাছে পৌঁছায়নি) যাতে করে সে তাদের কাছে (আমার আয়াত) স্পষ্ট করে দিতে পারে’ (সুরা ইব্রাহিম-৪)। মাতৃভাষা কত গুরুত্বপূর্ণ এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে যত নবী প্রেরণ করেছেন তাদের সবাইকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন, যাতে তারা আল্লাহর বিধান সহজভাবে বুঝাতে পারেন মানুষ ও আল্লাহর বিধান কে সহজভাবে বুঝতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: কুরআনকে আমি তোমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছি যাতে তোমরা বুঝতে পার। একথাটি আল কুরআনের সুরা ক্বামারের চার জায়গায় বলেছেন ১৭, ২২, ৩২, ৪০ নং আয়াতে। রাসুল (সা.) এর মাতৃভাষা ছিল আরবী। এ জন্যই মহান রব্বুল আলামিন কুরআনের ভাষাকে আরবী হিসাবে মনোনীত করেছেন, যাতে আরব সমাজের মানুষ কুরআনের বাণীকে সহজে অনুধাবন করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন: ‘হে নবী কুরআন কে আমি তোমাদের ভাষায় সহজ করে অবতীর্ন করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। (সুরা আদ-দোখান-৫৮)। মহানবী (সা.) নিজের ভাষা আরবীকে এত বেশি ভালবাসতেন যে, তিনি বলেছেন: আমি তিনটি কারণে আরবী এত ভালবাসি, তম্মধ্যে একটি হলো মাতৃভাষার কারণে। মহানবী ছিলেন স্বীয় মাতৃভাষায় ছিল অতুলনীয়। তিনি মাতৃভাষাকে শুদ্ধ এবং সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন। তিনি বলেছেন: ‘আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন’ (মুসলিম-৫২৩)।
আমরা বাঙালি। বাংলায় আমরা আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করি। তাই আমাদের ভাষার নাম বাংলাভাষা। বাংলা আজ আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা। পৃথিবীতে ৬ সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে আমাদের ভাষা ষষ্ঠ। আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে এতটাই ভালবাসি যে, ভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আমনা রক্ত দিয়েছি। সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছি ,যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। প্রত্যেক জাতির জীবনে কিছু গৌরব ও উজ্জ্বল দিন থকে। সেই দিনগুলো জাতীয় জীবনে তাৎপর্যমন্ডিত। বাংলাদেশের এরকম দিনের একটি দিন ২১ ফেব্রুয়ারি। এটি ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এদিন ঢাকার রাজপথে রফিক, জব্বার, বরকত, সালামসহ নাম না জানা অনেকে আত্মোৎসর্গ করেন। মহান একুশের বিশ্ব ইতিহাসে এক বীরত্ব গাঁথা নাম, যা বাঙালির ঐতিহ্য চেতনার অংশ নয়, সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ের অনন্ত প্রেরণার উৎস্য। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসে এর উত্তরণ আমাদের অর্জন কে করেছে আর ও মহান আর ও গৌরবসিক্ত। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেন্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ২১ ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তার মাতৃভাষা বাংলার মান রক্ষার জন্য প্রথম রক্ত দেয়। সে ঘটনার সাত চল্লিশ বছর পর দিবসটি আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি পায়। এ জন্য আমরা গৌরান্বিত। আমাদের ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ দিন আজ বিশ্ববাসীরর জন্যও স্মরণীয়। আমাদের মতো বিশ্ববাসী ও যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে এক আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। ১৭ নভেন্বর ১৯৯৯ সাল ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে ‘আন্তর্জজাাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের ব্যাখ্যা করে বলা হয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। মাতৃভাষার প্রচলন কেবল মাত্র ভাষাগত বৈচিত্র্য,বহু ভাষাভিত্তিক শিক্ষাকে উৎসাহিত করে না । তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুধাবন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবনের তাৎপর্য হলো প্রতিটি মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, বিশেষ করে দুর্বল ও জীর্ণ মাতৃভাষাগুলিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা। দুর্বল বলে কোনভাষার উপর প্রভূত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করা। এ দিবসে প্রত্যেকে বাংলা ভাষাভাষীকে যেমন ভালবাসবে, তেমনি অন্য জাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে। এভাবে একুশ কে ধারন করে মাতৃভাষাকে ভালবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন