শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিনোদন প্রতিদিন

নন্দিত অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের ইন্তেকাল

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

দর্শকনন্দিত, কিংবদন্তি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান গতকাল (২০ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টায় রাজধানীর সূত্রাপুরে নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যু কালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। মৃত্যুকালে স্ত্রী, তিন মেয়ে, দুই ছেলে ও অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী রেখে গেছেন। তিনি একাধারে ছিলেন অভিনেতা, লেখক, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক। বাদ আসর সূত্রাপুর জামে মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে জুরাইন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

বরেণ্য এ অভিনেতার মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যু গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণমাধ্যমে পাঠানো শোক বার্তায় প্রেসিডেন্ট বলেন, এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যু দেশের সংস্কৃতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলাদেশে অসা¤প্রদায়িক চেতনার বিকাশে তার অবদান মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। আলাদা এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনপ্রিয় এই শিল্পী তার অসাধারণ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

নন্দিত এ অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের ইন্তেকালে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। তথ্যমন্ত্রী তার শোকবার্তায় মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তথ্যমন্ত্রী তার বার্তায় বলেন, সর্বজননন্দিত শিল্পী এটিএম শামসুজ্জামান তার অনন্য অভিনয়শিল্পের মাধ্যমে দেশের মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

খ্যাতিমান এ অভিনেতার মৃত্যুতে গভীর শোকাহত হয়েছেন তার দীর্ঘদিনে সহকর্মীরা। প্রযোজক-পরিচালক ও নায়ক সোহেল রানা এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যুে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, শতবর্ষেও এটিএম শামসুজ্জামানের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। একজন সত্যিকারের মানুষ ছিলেন তিনি। অজাতশত্রু এক ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তার কোনো শত্রু ছিল না। এ টি এম শামসুজ্জামান ব্যক্তিজীবনে বেশ ধার্মিক ছিলেন। এই অভিনেতা ১১ বার হজে গিয়েছিলেন। একবার একসঙ্গে সোহেল রানার সঙ্গেও হজ পালন করেন। আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্তবাসী করেন সোহেল রানা এই প্রার্থনা করেন। এ ছাড়া তার মৃত্যুতে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তার মৃক্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।

প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করা এ অভিনেতার লাশ তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি) নেয়া হয়নি। শত শত সহকর্মী এখানে অপেক্ষায় ছিলেন তাকে শেষ বিদায় জানাবেন বলে। তবে তা তারা পারেননি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও সর্ব সাধারণের শেষ শ্রদ্ধার জন্য নেয়া হয়নি এটিএমের কফিন।
এটিএম শামসুজ্জামানের ইচ্ছানুযায়ী তার জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। বাদ জোহর নারিন্দার পীর সাহেব বাড়ি মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ অভিনেতার শেষ ইচ্ছে পূরণ করেই সম্পন্ন হলো জানাজা। এটিএম তার পরিবারের কাছে শেষ ইচ্ছেতে নারিন্দার পীর সাহেব যেন তার গোসল ও জানাজা পড়ান সে কথা ব্যক্ত করেছিলেন। তার কথা রেখেই সব সম্পন্ন করেছে তার পরিবার। নারিন্দার পীর সাহেব জানাজার ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এ অভিনেতার মেয়ে কোয়েল গণমাধ্যমকে বলেন, জীবদ্দশায় আব্বা নিজেই নিষেধ করে গেছেন তার মৃত্যুর পর লাশ নিয়ে কোথাও না যেতে। তার দাফন কাজ যেন দ্রুত শেষ করা হয়। শহীদ মিনার বা এফডিসিতে নিতেও নিষেধ করেছেন। তিনি নিজে তার জানাজা কে পড়াবেন, কোথায় তাকে দাফন করা হবে সব ঠিক করে গেছেন। আমরা তার আদেশ অনুযায়ীই সব করছি।
প্রথম জানাজা শেষে ভক্ত-অনুরাগীদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এটিএম শামসুজ্জামানের কফিন সূত্রাপুর কমিউনিটি সেন্টারে রাখা। এরপর বাদ আসর সূত্রাপুর মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে জুরাইন কবরস্থানে বড় ছেলে কামরুজ্জামান কবি’র কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

কিংবদন্তি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের পুরো নাম আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান। তিনি ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব কৈশোর কেটেছে পুরান ঢাকার দেবেন্দ্রনাথ দাস লেন এলাকায়। পড়ালেখা করেছেন ঢাকার পগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলে। ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর এটিএম জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চতর শিক্ষালাভ করেন। তার বাবা নূরুজ্জামান ছিলেন নামকরা উকিল এবং রাজনীতিবিদ। মা নুরুন্নেসা বেগম। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে শামসুজ্জামান ছিলেন সবার বড়।

অভিনেতা হিসেবে এটিএম শামসুজ্জামানের অভিষেক ১৯৬৫ সালে। তার অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। সে সময় তিনি বেশ কয়েকটি সিনেমায় কৌতুকাভিনেতার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। কৌতুক চরিত্রে তার অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জলছবি’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘রামের সুমতি’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’ ইত্যাদি

১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে খলনায়ক হিসেবে তিনি আলোচনা আসেন। নেতিবাচক ভূমিকায় এটিএম যেসব সিনেমায় অভিনয় করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘অনন্ত প্রেম’, ‘দোলনা’, ‘অচেনা’, ‘মোল্লা বাড়ির বউ’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘চোরাবালি’ ইত্যাদি। তার অভিনীত সিনেমার তালিকা অনেক দীর্ঘ। সেই তালিকায় সফল সিনেমার সংখ্যাই বেশি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি হলো- ‘ওরা ১১ জন’, ‘লাঠিয়াল’, ‘নয়নমনি’, ‘বড় বউ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘সুর্য দীঘল বাড়ি’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘লাল কাজল’, ‘দায়ী কে?’, ‘রাজলক্ষী শ্রীকান্ত’, চাঁপাডাঙ্গার বউ, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘আমার স্বপ্ন তুমি’, ‘দাদীমা’, ‘ডাক্তার বাড়ি’, ‘চাঁদের মতো বউ’, ‘গেরিলা’, ‘লাল টিপ’ ইত্যাদি

অভিনয়ের পাশাপাশি এটিএম শামসুজ্জামান ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তের মতো বিখ্যাত পরিচালকদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি প্রথম কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ‘জলছবি’ সিনেমার জন্য। ২০০৯ সালে ‘এবাদত’ নামের প্রথম সিনেমা পরিচালনা করেন এটিএম শামসুজ্জামান।

১৯৮৭ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘দায়ী কে’ চলচ্চিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য এটিএম শামসুজ্জামান শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১২ সালে রেদওয়ান রনি পরিচালিত ‘চোরাবালি’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এটিএম শামসুজ্জামান। ৪২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননায় ভ‚ষিত হয়েছেন এই দর্শকনন্দিত অভিনেতা। এছাড়া শিল্পকলায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন