বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চীনাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা

অজয় কান্তি মন্ডল | প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

ব্যক্তিগত এবং সামাজিক নিরাপত্তার ব্যাপারে চীনাদের বেশ সুনাম আছে। নিজস্ব বাসার গেট থেকে বের হয়ে আবার বাসায় প্রবেশ করার আগ মুহূর্তে প্রতিটা ব্যক্তির চলাফেরা, কাজকর্ম এখানে সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড হতে থাকে। প্রতিটা অলিগলি, রাস্তাঘাট, পাহাড়পর্বত, নদীনালা এককথায় যে জায়গাগুলোতে মানুষের চলাচল সম্ভব সবখানেই ক্যামেরা সেট করা আছে। তাই এখানে কেউ কোনো রকম অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে রেহায় পায় না। সাথে সাথে সামাজিক নিরাপত্তার ব্যাপারেও কারো মনে কোনো সন্দেহ জাগে না। সারারাত ধরে যেকোন বয়সী একজন মহিলা একাকি নির্ভয়ে রাস্তা দিয়ে সাইকেল, ইবাইক, ট্যাক্সি ক্যাবে চলাচল করতে পারে।

এখানে প্রকাশ্যে ধর্ম পালন অনেক আগে থেকেই নিষিদ্ধ। বেশিরভাগ চীনা কে কোন ধর্মের অনুসারী তা তারা নিজেরা জানে না। তাদের ধর্মীয় সূ² অনুভূতিগুলো একেবারেই অকেজো বললেও ভুল হবে না। ছোট থেকে এদের কোনো ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয় না। অনেক পরিবার নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে সপরিবারে তাদের পছন্দের ধর্ম গ্রহণ করতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে পরিবারের অন্যন্য সদস্য যেমন বাবামা, ভাইবোন তাদেরকে কোনো প্রকার বাধা প্রদান করে না, বরং তাদেরও স্বইচ্ছায় ওই একই ধর্ম গ্রহণে আগ্রহ দেখা যায়। পরকালের কথা মাথায় না এনে বর্তমানকে উপভোগ করতে সবাই ব্যস্ত থাকে। তাদের ভিতর এমন কিছু বিশ্বাসের প্রচলন আছে যে, ধর্ম পালন অর্থ সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না। সৎ পথে চলে, সৎ উপায়ে উপার্জন করে সেটার সদ্বব্যবহার করাকে মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম বলে তাদের কাছে প্রতীয়মান।

প্রাকাশ্যে বা জনসমক্ষে ধর্মীয় আয়োজন নিষিদ্ধ থাকলেও বেশিরভাগ নির্জন এলাকায়, পাহাড়ের চূড়ায় অনেক দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধদের প্রার্থনার মন্দির চোখে পড়ে। মন্দিরগুলো দেখভাল করা এবং সকাল সন্ধ্যা প্রার্থনার জন্য সেখানে নিয়োজিত আছে বহু ব্যক্তি। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে চীনাদের অনেককে এসব মন্দিরে প্রার্থনার জন্য পরিবারের সকল সদস্য সহ হাজির হতে দেখা যায়। এছাড়াও প্রতিটা প্রধান শহরে মুসলমানদের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদও চোখে পড়ে। এসব অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত মসজিদ চীনের মুসলিম ধর্মের অনুসারীদের এবং বাইরের দেশ থেকে ব্যবসা, চাকরি বা পড়াশুনার উদ্দেশ্যে আসা মুসলিম ধর্মাবলম্বিদের নামাজসহ যেকোন ধর্মীয় কাজে অহরহ ব্যবহৃত হয়। সুপারশপগুলোতে মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন মাংস, বাটার, রুটি, বিস্কুট, দুধ, দইতে হালাল চিহ্ন দিয়ে বিক্রি করার পাশাপাশি প্রায় সব শহরেই হালাল খাবারের রেস্তোরাঁ আছে। সেজন্য চীনে বসবাসরত মুসলিমদের হালাল খাবার পেতেও কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না।

প্রার্থনার জন্য নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে যেকেউ প্রার্থনা করলে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ধর্মীয় উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কোনো জমায়েত, সভা, বক্তব্য এখানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মীয় যুক্তিকে সামনে নিয়ে মানুষ হত্যা, অন্য ধর্মকে ছোট করে দেখা এসব কখনো ঘটে না। এদের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য অনেক বেশি সে যেকোন ব্যক্তি হোক না কেন। তাই রাস্তা ঘাটে গাড়ি দুর্ঘটনা, আগুনে পুড়ে বা জলে ডুবে মানুষ মরতে খুব একটা শোনা যায় না। রাস্তাঘাটে সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলে। খুবই ব্যস্ততম সড়কগুলোতে মাঝেমধ্যে এক প্রাইভেট কারের সাথে, অন্য প্রাইভেট কার বা ই-বাইকের সামান্য ধাক্কা লাগতে দেখেছি। সেক্ষেত্রে ধাক্কার পরে যদি উভয় চালকের নিজেদের ভিতরে কোনো প্রকার পারস্পরিক সমঝোতা না হয় তাহলে উভয়ে যে অবস্থায় গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছে সেঅবস্থায় সেস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। অল্প কিছুক্ষণের ভিতরে সেখানে পুলিশ এসে হাজির হলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে যে চালকের দোষ তাকে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। চালকের অপরাধের নমুনা দেখে শাস্তির বিধান আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিলসহ মোটা অংকের টাকা জরিমানা করতে দেখা যায়। সেজন্য চালকেরা কোনো রকম তাড়াহুড়ো না করে সর্বক্ষেত্রেই ট্রাফিক আইন মেনে চলে।

সচারাচার কর্মক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীদের উপস্থিতি বেশি চোখে পড়ে। সেটা ড্রাইভিং, বিপনী বিতান থেকে শুরু করে নির্মাণ কাজের শ্রমিক পর্যন্ত যেকোন ভারী কাজেও হতে পারে। ব্যাংক পাড়াসহ অন্য অফিসগুলোতেও নারীদের উপস্থিতিও নজর কাড়ার মতো। নারীদের কর্মক্ষেত্রে কোনরকম হয়রানিমূলক কর্মকান্ডের শিকার হতে কখনো দেখা যায় না। সরকারের আইনের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল হওয়ায় নারীদের প্রতিও সবাই সম্মান দেখায়। কোন নারীর প্রতি কেউ খারাপ আচরণ বা কুদৃষ্টি দিছে এমনটি সচারাচার শোনা যায় না। কেননা, অপরাধকারী জানে সে অপরাধ করে কোনভাবেই পার পাবে না। এখানে ধর্ষণের শাস্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডের বিধান বহাল আছে। তাই এইধরনের অপরাধ কাউকে করতে দেখা যায় না। তবে অল্প কিছুসংখ্যক লোককে দেখেছি, সরকারের আইনের প্রতি একটু দ্বিমত পোষণ করতে। তবে বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, যদি তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, জীবনের নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং আর্থিক নিরাপত্তা বজায় থাকে তাহলে সরকারকে কেন দোষারোপ করব?

চীনারা সহজ-সরল এবং সুখ-শান্তিময় জীবনযাপনে অভ্যস্ত। যেকোন কাজেও তারা সবসময় বৈধ পথে অগ্রসর হয়। যেকোন ব্যক্তির স্বাভাবিক সেবা পেতে কখনো হয়রানি হতে শোনা যায় না। দাপ্তরিক কাজে যদি দরকারি কাগজপত্র ঠিক থাকে তাহলে অন্যকারও সাহায্য ছাড়াই সবাই তার প্রয়োজনীয় সেবা পেয়ে থাকে। তবে কাগজপত্রের ঘাটতি থাকলে সেক্ষেত্রে শত চেষ্টায় অর্থাৎ অবৈধ উপায়ে কেউ কোনো সেবা পায় না। আইন এবং নিয়ম সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, এই কথাটা চীনারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। যেকোন ব্যক্তি সে যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন সাধারণ মানুষের সাথে যেমন, ব্যাংকের লেনদেনের সময়, পাব্লিক পরিবহনে ওঠার সময়, যেকোন সেবা গ্রহণের সময় কোনো রকম তাড়াহুড়ো না করে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

ব্যক্তি মালিকানাধীন কারও কোনো জমাজমি না থাকায় সরকারের তাৎক্ষণিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে কোনো বাধা আসে না। এজন্য কর্তৃপক্ষ মনে করলেই যত্রতত্র হাইওয়ে রাস্তা, বহুতলা ভবন তৈরি করতে পারে। মাঝেমধ্যে শহর থেকে বেশ দূরে পাহাড়ের পাদদেশে বা নড়বড়ে অবস্থায় বেশ কিছু গরীব, দিনমজুরদের বসবাস করতে দেখা যায়। এসব ব্যক্তি সরকারের দৃষ্টি গোচরের সাথে সাথে তাদের স্থানান্তর করা হয় সদ্য নির্মাণকৃত বহুতল বিশিষ্ট অত্যাধুনিক ভবনে। এসব বহুতল ভবনের সুন্দর ফ্ল্যাট বসবাসের জন্য তাদেরকে একেবারে বিনা পয়সায় দিয়ে দেওয়া হয়। সেজন্য এখানে গরীব দুঃখী সবাই সরকারকে মান্য করে।

চীনারা অনেক পর উপকারী হয়ে থাকে। বিদেশিদের প্রতি চীনারা সর্বদায় অনেক পজিটিভ মনোভাব পোষণ করে। ইংরেজি সবাই না পারলেও বিদেশি দেখলে সবসময় নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে। যেকোন দোকানে কোনো পণ্য কিনতে গেলে বিদেশি দেখে জিনিসের দাম না বাড়িয়ে যথাসম্ভব কম রাখার চেষ্টা করে। তারা চায় অন্তত পক্ষে ন্যূনতম লাভে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেনা দামে হলেও বিদেশিদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে। এদের কাছে নিজেদের মুখের কথার মূল্য অনেক বেশি। যদি কোন চীনা ব্যক্তি একবার মুখ দিয়ে কারও উপকারের জন্য কোন কথা বলে থাকে তাহলে সেটা তারা করেই ছাড়ে।

যেকোন পরিবারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত না থাকলে তাদের পারিবারিক গোলযোগ সম্পর্কে ভালোভাবে জানা বা বোঝা কষ্টকর। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ থাকলেও স্বাভাবিকভাবেই সম্মুখে কখনো পারিবারিক গোলযোগ চোখে পড়িনি। সামাজিক গোলযোগ মাধ্যমেও কখনো দেখিনি। রাস্তাঘাটে মহিলাদের শ্লীতাহানি, চুরি, ছিনতাই, মারামারি এগুলো এদের সাথে যায় না। বিভিন্ন পাব্লিক পরিবহনে ভাড়া নিয়ে, চালকের অধিক সংখ্যক যাত্রী উঠানো নিয়ে, যাত্রীদের বসার আসন নিয়ে, চালকের ইচ্ছাকৃত কালক্ষেপণ নিয়ে গোলযোগ এখানে খুবই বেমানান। মানুষকে ঠকানো, অবৈধ উপায়ে আয় উপার্জন আগে থাকলেও এগুলো এখন আর দেখা যায় না।

তবে মানুষের মতামতের স্বাধীনতা এখানে খুব বেশি নেই বলে আমার মনে হয়। এটা নিয়ে কারো কারো মধ্যে ক্ষোভ আছে। মিডিয়া বা সংবাদপত্রের সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও বেশ কড়াকড়ি লক্ষ করা যায়। সরাকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় এমন সংবাদ প্রকাশে বেশ বাধা আছে। কিন্তু যেকোন ভালো সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনরকম বিধিনিষেধ নেই। যেকোন অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার সংবাদ মিডিয়া প্রচারিত করতে গেলে অবশ্যই নিয়ম নীতি মেনে প্রচার করা লাগে। তাই ছোট খাট অনেক প্রকার খারাপ ঘটনার সংবাদ জনগণের অজানা থেকে যায়।

সরকারের গৃহীত যেকোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষে এবং বিপক্ষে দুধরনের মতামত আসবে সেটাই স্বাভাবিক। এ মতামতের পাল্লা পক্ষে বা বিপক্ষে যেকোন দিকেই ভারী হতে পারে। কিন্তু চীনা প্রশাসন এ ব্যাপারে সর্বক্ষেত্রে খুবই কড়া অর্থাৎ যেটা সরাকারের থেকে সিদ্ধান্ত আসে সেটা মুষ্টিমেয় জনগণের অমত থাকলেও প্রশাসন সেটা করেই ছাড়ে। এক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে অনেক মানুষকে সরকারের আইনের প্রতি একটু হলেও অখুশি থাকতে দেখা যায়। কিন্তু তারা জনসমক্ষে সেসবের প্রতিবাদ করে না বা করার সাহস পায় না। কারণ এসব ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কড়া নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রতিবাদকারীদের বিপক্ষে যখন তখন যেকোন সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে আসে। তাই হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর, ঘেরাও, মিছিল, মিটিং এগুলো এখানে কাউকে করতে দেখা যায় না।
লেখক: গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন।
ajoymondal325@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন