শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অবিভক্ত ভারতে মুসলমানদের উপেক্ষা ও বঞ্চনার খতিয়ান

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

আজকের লেখার লিখতে গিয়ে তিনটি বাংলা প্রবাদ প্রবচন মনে পড়লো। এইগুলি হলো, ‘হাতি ঘোড়া গেল তল/ ভেড়া বলে কত জল’, ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ ও ‘কোদালকে কোদাল বলো’। শেষের প্রবচনটির ইংরেজী হলো, Call the spade a spade. এই কয়েক দিন ভারতের প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী ও বিজেপির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট লাল কৃষ্ণ আদভানী, ভারতের প্রাক্তন প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিং এবং বাংলাদেশের ভাষা সৈনিক আহমদ রফিক সম্পর্কে ইন্টারনেট এবং আমার পেপার কাটিংয়ের দু’একটি ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। এটি করতে গিয়ে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেলাম। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ভাষা সৈনিক আহমেদ রফিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের একজন প্রবক্তা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতারও একজন প্রবক্তা। এই মতবাদের সমর্থক ব্যক্তি যখন বলেন যে দেশ ভাগ অনিবার্য ছিল না তখন তাকে পাল্টা প্রশ্ন করতে হয়। তা হলো, বিকল্প কি ছিলো? যদি ভারত বিভক্ত না হতো তাহলে কি হতো? স্বাধীন বাংলাদেশ কি পেতেন? একজন অপগন্ড মুর্খও তো বলবেন যে, ভারত ভাগ না হলে আমরা ভারতের অন্তর্ভুক্ত থেকে বাংলা নামে একটি প্রদেশ হিসাবে থাকতাম। তাহলে কোথায় পেতেন এই স্বাধীন বাংলা? কোথায় পেতেন এই রাষ্ট্রভাষা বাংলা? বলাবাহুল্য নৃতাত্তি¡কভাবে বাঙ্গালী হলেও জাতীয়তার দিক দিয়ে আমরা ভারতীয়ই থাকতাম। সেটি কি তাদের সুপ্ত মনোবাঞ্ছা? বাংলাকে অখন্ড রেখে স্বাধীন রাষ্ট্র করার জন্য সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু, আবুল হাশিম এবং কিরণশংকর তো অনেক চেষ্টাই করেছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। বাংলাকে তো কেটে দুই ভাগ করতেই হলো। এই বাংলা ভাগের ভিলেন কে? যতই দিন যাচ্ছে ততই ভারতীয়দের মধ্যে থেকেও এ সত্যটি বেরিয়ে আসছে যে ভারত বিভক্তি, বিশেষকরে, বাংলা বিভক্তির খলনায়ক হলো পন্ডিত জওহর লাল নেহেরুর কূটবুদ্ধি, কংগ্রেস নেতা সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের একগুয়েমি এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সুস্পষ্ট অবস্থানের অভাব। তবে ভারত ভাগের জন্য কে দায়ী সেটি আমার আজকের মূল আলোচ্য বিষয় নয়। আমি শুধু আহমেদ রফিকদের মতো বুদ্ধিজীবিদের বক্তব্যের স্ববিরোধিতা দেখানোর জন্যই ‘প্রথম আলোয়’ প্রকাশিত তার সাক্ষাৎকারের কথা বললাম। এই সাক্ষাৎকারেই শেষের দিকে তিনি বলেছেন, ‘আরেকটি কথা। ৩৭-এর নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে জিন্নাহ এগিয়ে এসে কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন চাইলেন। মওলানা আজাদ খুব চেষ্টা করলেন। কিন্তু হলো না মূলত নেহেরুর জন্যই। এই না হওয়ার পর জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘তাহলে এখান থেকে আমাদের পথ ভিন্ন হয়ে গেল’।’
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন পর্যন্ত মুসলমানেরা কংগ্রেসের সাথেই ছিলেন। ১৮৯২ সালে যে আইনসভা গঠিত হয় সেই নির্বাচনে সারা ভারতের একজন মুসলমানও নির্বাচিত হতে পারলেন না। বৃটিশ শাসনের শুরু থেকেই মুসলমানদের প্রতি বঞ্চনা শুরু হয়। মুসলমানদের, বিশেষকরে বাংলার মুসলমানদের, কিছুটা সুবিধা দেওয়ার জন্য ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলাকে দুই ভাগ করেন, যেটি বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন। পক্ষান্তরে বাংলার মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেন।

দুই
ঠিক এই স্থানে আমি পাঠক ভাইদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। কংগ্রেস যখন বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু করে তখন তরুণ ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯০৬ সালে কংগ্রেসে যোগদান করেন। বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য হিন্দু সম্প্রদায় রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় লিপ্ত হয়। ১৯১০ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ ভারতের বড়লাট হয়ে আসেন। বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য যারা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছিল তারা তাকে হত্যা করার জন্য তার প্রতি বোমা নিক্ষেপ করে। হার্ডিঞ্জ আহত হন, কিন্তু বেঁচে যান। তার এক অনুচর নিহত হন। এই ঘটনায় ভয় পেয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ মনে করেন যে, বঙ্গভঙ্গই যত অনর্থের মূল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই ‘সন্ত্রাসী তৎপরতাকে’ কংগ্রেস ‘বিপ্লবী কর্মকান্ড’ বলে অভিহিত করে। বিপ্লবী কর্মকান্ডই বলুন আর সন্ত্রাসী তৎপরতাই বলুন, এসব তৎপরতার নেতৃত্ব দেন মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক, বাংলায় বিপিনচন্দ্র পাল ও মতিলাল ঘোষ এবং পাঞ্জাবে লালালাজপথ রায়। ভীত সন্ত্রস্ত লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১১ খৃষ্টাব্দের ২০ আগস্ট বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য বিলাত কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেন। তদনুযায়ী ১৯১১ খৃষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ বাতিল করা হয়। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ আবার একটি প্রদেশে পরিণত হয়। বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর সমবায়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হয়। স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসাবে আসামের মর্যাদা অব্যাহত থেকে যায়।

১৯০৫ থেকে ১৯১১ এই ৬ বছর পূর্ববঙ্গ আলাদা প্রদেশ হওয়ায় মুসলমানদের অগ্রগতি এবং বিপ্লবী তথা সন্ত্রাসীদের সহ্য হচ্ছিল না। তাই বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে মুসলমানদের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় কংগ্রেস তথা হিন্দু সম্প্রদায় ও ভারতের ইংরেজ শাসকদের ওপর রুষ্ট হয়। এই পটভ‚মিতে ১৯১৩ সালের শেষ দিকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগে যোগদান করেন।

মি. জিন্নাহ মুসলিম লীগে যোগদান করেন বটে, কিন্তু তার সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ছিলো হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে মিলন ঘটানো। এই সময় মুসলিম লীগও স্বায়ত্তশাসন দাবী করে। জিন্নাহর প্রচেষ্টায় ১৯১৬ সালে উত্তর প্রদেশে লক্ষ্ণেী শহরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যুক্ত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিখ্যাত লক্ষ্ণেী চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি উপমহাদেশের রাজনীতিতে একটি স্মরণীয় ঘটনা। ১৯১৬ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ সমঝোতার সাথে কাজ করতে থাকে। এর আগেও বোম্বাই নগরে ১৯১৫ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অধিবেশন হয়। এই সময় ব্যারিস্টার মি. গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে আসেন এবং কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দেন। ১৯২১ সালে তিনি কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

লক্ষ্ণেী চুক্তিতে কংগ্রেস মুসলিম লীগকে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন হিসাবে স্বীকার করে নেয়। চুক্তিতে মুসলমাদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবী মেনে নেওয়া হয়। পাঞ্জাব, বাংলা প্রভৃতিতে মুসলমানদের আসন সংখ্যা কিছুটা বাড়ানো হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ১১ বছর পর জওহরলাল নেহেরুর পিতা মতিলাল নেহেরু একটি রিপোর্ট পেশ করেন। এই রিপোর্টে লক্ষ্ণেী চুক্তিতে মুসলমানদের জন্য যে স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেটি বাতিল করা হয় এবং পাঞ্জাব ও বাংলায় মুসলমানদের সংরক্ষিত আসনও বাতিল করা হয়। এভাবে কংগ্রেস মুসলমানদের স্বার্থের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা করে। লক্ষ্ণেী চুক্তিতে হিন্দু মুসলমানদের সম্প্রীতির ব্যাপারে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে ভূমিকা পালন করেন তার জন্য কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বলেন যে, হিন্দু মুসলমানদের ঐক্যের দূত হওয়ার সমস্ত উপকরণ জিন্নার মধ্যে রয়েছে। জিন্নাহ এক জায়গায় বলেছেন, “একজন মুসলমান গোখলে হওয়ার আকাক্সক্ষা আমার রয়েছে”। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে কংগ্রেসের অপর একজন শীর্ষ নেতা সরোজিনী নাইডু জিন্নাহকে হিন্দু মুসলিম মিলনের দূত হিসাবে আখ্যায়িত করেন। অথচ সেই জিন্নাহকেই বাংলাদেশের এক শ্রেণীর সেক্যুলার পলিটিশিয়ান ও বুদ্ধিজীবি সাম্প্রদায়িক বলে অভিহিত করেছেন। সেই জিন্নাহই তার ঐতিহাসিক ১৪ দফায় ভারতের সকল প্রদেশকে সমানভাবে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার দাবী করেন। ১৪ দফায় আর যেসব দাবী ছিলো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বাংলা পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা নষ্ট করা চলবে না, সিন্ধুকে বোম্বাই প্রদেশ থেকে আলাদা করে একটি প্রদেশ করতে হবে, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ মুসলমান সদস্য ছাড়া গঠিত হতে পারবে না। জিন্নাহ এবং মুসলমানদের কোনো দাবীর প্রতি কর্ণপাত না করে কংগ্রেস ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস পালন করে। ১৯৩০ সালের ৬ এপ্রিল মি. গান্ধী অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার জন্য আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেন। এই সময়ই সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করা হয়। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দিনটি ছিল ১৮ এপ্রিল।

ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার পর থেকে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিশেষকরে মি. গান্ধী, পন্ডিত মতিলাল নেহেরু, তদীয় পুত্র জওহরলাল নেহেরু প্রমুখ কেউই মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের প্রতি বিন্দুমাত্র নজর দেননি।

মুসলমানদের প্রতি সীমাহীন বঞ্চনা ও উপেক্ষার পটভুমিতে ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হয়। এই আইনে ভারতকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র করার কথা বলা হলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। এই আইনে বোম্বে থেকে সিন্ধু এবং বিহার থেকে উড়িষ্যাকে আলাদা করে দুটি পৃথক প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। এই আইন মোতাবেক প্রত্যেক প্রদেশের নির্বাচিত সংখ্যাগুরু নেতাকে প্রাদেশিক সরকার গঠনের আহবান জানানোর ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্ণেী অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয় যে ‘বন্দে মাতারাম’ শীর্ষক সাম্প্রদায়িক সংগীতকে ভারতীয় জাতীয় সংগীত করা যাবে না। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর যে সকল প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠিত হয় সে সকল প্রদেশে ‘বন্দে মাতারাম’ সংগীতে মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অংশগ্রহণ এবং গান্ধীর ছবিকে পূজা করতে বাধ্য করা হয় (মাধ্যমিক ইতিহাস বাংলাদেশ স্কুল টেক্সবুক বোর্ড, পৃষ্ঠা ২৯৫)। এই পুস্তকে আরো বলা হয় যে মুসলমানদিগকে গরুর গোস্ত খেতে দেওয়া হয়নি, উর্দূ ও ফার্সি অক্ষরের পরিবর্তে দেবনাগরী অক্ষর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই অবস্থায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, সামান্য ক্ষমতা পেয়েই কংগ্রেস মুসলমানদের প্রতি যে অন্যায় অবিচার শুরু করেছে তার একটিই অর্থ হতে পারে। আর সেটি হলো, হিন্দুস্তানে হিন্দু ব্যতীত আর কারো সম্মানজনক স্থান নাই (মাধ্যমিক ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২৯৬)।

মুসলমানদের প্রতি কংগ্রেস এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বিমাতা সূলভ আচরণের পটভূমিতে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে বাংলার বাঘ এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক মুসলানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠার দাবী থাকলেও মুসলিম লীগ বিশেষকরে মি. জিন্নাহ তখনও শর্ত সাপেক্ষে ভারতকে অখন্ড রাখার ধারণা ত্যাগ করেননি। ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে বৃটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস্ ভারতে এসে ফেডারেল সরকার প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করলে কংগ্রেস সেটি প্রত্যাখান করে।

১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে মুসলিম লীগ কেন্দ্রের সমস্ত মুসলিম আসন লাভ করে। প্রাদেশিক আইনসভাগুলির শতকরা ৯০ ভাগ আসন মুসলিম লীগ লাভ করে। কংগ্রেসও হিন্দু আসনগুলিতে ভাল করে। এই নির্বাচনে প্রমাণিত হয় যে ভারতে মুসলমানদের সংগঠন হলো মুসলিম লীগ এবং হিন্দুদের হলো কংগ্রেস।

ভারতকে অখন্ড রাখার শেষ চেষ্টা হিসাবে মুসলিম লীগ এবং তার নেতা মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ক্যাবিনেট মিশন সম্মন্ধে সকলেই জানেন। আমি তাই এর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। সংক্ষেপে, ভারতকে অখন্ড রেখে তিনটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বা গ্রুপে ভাগ করার প্রস্তাব ছিলো। জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ক্যাবিনেক মিশন প্ল্যান গ্রহণ করে। কিন্তু কংগ্রেস সেটিও প্রত্যাখান করে। এই অবস্থায় মুসলমানদের সামনে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকলো না। এই আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবীতে মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করে। এই দিবসে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। প্রথমে হিন্দুরা মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমে দাঙ্গা হয় কলকাতায়। তারপর সেটি ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী, বিহার, বোম্বাই, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানে। হাজার হাজার মানুষ এই দাঙ্গায় নিহত হয়। দাঙ্গায় নিহত মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।

এই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার পর বৃটিশরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে যে, ভারত বিভাগ না করে কোনো উপায় নাই। ফলে ভাগ হলো ভারতবর্ষ। এই পটভূমিতে ভারত ভাগের অর্ধশতক পর বিজেপির সুপ্র্রীমো আদভানী ঘোষণা করেন যে, জিন্নাহ্ সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তিনি ছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষ বা সেক্যুলার। এই মন্তব্যের জন্য আদভানীকে বিজেপির সভাপতির পদ হারাতে হয় এবং ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রীর গদিও হারাতে হয়। ভারতের সাবেক প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত রাও খোলাখুলি বলেন যে, ভারত বিভাগের জন্য পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু দায়ী। এই মন্তব্যের জন্য তাঁকে বিজেপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি থেকে লালকৃষ্ণ আদভানীর প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসাবে মনোনীত হওয়ার কথা ছিল। জিন্নাহ সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য তাদের উভয়ের অর্থাৎ আদভানী ও যশোবন্ত সিংয়ের পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তাঁরা তার পরেও তাদের মন্তব্যে অটল থাকেন।
journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
গিয়াসউদ্দীন একরাম ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:৩৩ পিএম says : 0
অনেক তথ্যবহুল একটি লেখা
Total Reply(0)
রায়হান ইসলাম ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:৩৪ পিএম says : 0
সত্য ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মোবায়েদুর রহমান সাহেবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি
Total Reply(0)
রোদেলা ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:৩৬ পিএম says : 0
সব সময়ই মুসলমানরা উপেক্ষিত ছিলো
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন