মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সরকারি সম্পত্তি

প্রশাসনের যোগসাজশের অভিযোগ পকেট ভরছে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী মহলের

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

বিক্রি হয়ে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি। জাল-জালিয়াতি এবং আইনের ফাঁক-ফোকরে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে এসব সম্পত্তি। যদিও লিজ কিংবা ভাড়া ব্যতিত এসব সম্পত্তির হাতবদলে আইনি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু আইন-কানুনের ভ্রুক্ষেপ না করে চলছে বিক্রি প্রক্রিয়া। সরকারি সম্পত্তি বিক্রির অর্থে পকেট ভরছে স্থানীয় স্বার্থান্বেষীদের। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের কর্মকর্তা, মন্ত্রণালয় এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের অসাধু আইন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারি সম্পত্তি বিক্রির দু’য়েকটি ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে। তবে আইনের ফাঁক-ফোকরে জামিনে বেরিয়ে আসছেন আসামিরা।

দুদক সূত্র জানায়, জালিয়াতির মাধ্যমে অন্তত আড়াইশ’ কাঠার বেশি সরকারি জমি নিজের নামে ‘ইজারা’ দেখিয়ে একটি ‘নগর’ গড়ে তোলেন মিরপুরের শমসের আলী। আর সেই নগরের জমিগুলো প্লট আকারে বিক্রি করে হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কর্মচারী ও সাব-রেজিস্ট্রার সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট। এ বিষয়ে ২০১৯ সালে মামলা করে কমিশন। মামলার ভিত্তিতে প্রধান আসামি শমসের আলীসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হলেও কিছুদিন পর তারা জামিনে বেরিয়ে আসেন।

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, রাজধানীর বিশিল মৌজার কয়েকটি দাগে ৪ দশমিক ২৬৬৬ একর (২৫৮.৫৮ কাঠা) জমি ১৯৬০ সালে তৎকালীন গৃহায়ণ অধিদফতর অধিগ্রহণ করে (এলএ কেস নম্বর-১৩/১৯৫৯-৬০)। ১৯৮০ সালের ১৮ ডিসেম্বর এ বিষয়ে গেজেট নোটিফিকেশন করে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ (জাগৃক)। রাজধানীর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদিত নকশা ও সুপার ইম্পোজ নকশা অনুযায়ী এ সম্পত্তিতে জাগৃকের জমি ও ডুইপ প্রকল্পের বিভিন্ন প্লট রয়েছে। এ সম্পত্তি কাউকে ইজারা কিংবা বরাদ্দ দেয়া হয়নি।

২০০০ সালের ২০ এপ্রিল এ সম্পত্তির ইজারা দলিল (দলিল নম্বর ২১১৭/২০০০) করে নেন মিরপুরের বিশিল এলাকার শরাফত আলীর ছেলে শমসের আলী। দলিলে ৯৯ বছরের জন্য চার একর জমি ‘সেলামি’ দেখানো হয় মাত্র ৬৪ হাজার টাকা। অথচ গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এ সম্পত্তি লিজ বরাদ্দ দেয়নি। জাগৃকের পক্ষে সংস্থাটির তৎকালীন অফিস সহকারী কাম ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. নূরুজ্জামান ‘দলিল বাহক’ হিসেবে ওই দলিলে সই করেন। যদিও দলিল সই করার জন্য জাগৃকের পক্ষ থেকে নূরুজ্জামানকে কোনো ক্ষমতা দেয়া হয়নি।

মিরপুরের তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার মোখলেসুর রহমান ঠাকুর (বর্তমানে মৃত) জমির মৌজা মূল্যের চেয়েও কম দেখিয়ে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি করেন। এত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কোনো ব্যক্তিকে লিজ দেয়ার বিধান না থাকলেও তিনি যোগসাজশে তা করিয়েছেন। এই ভুয়া লিজ বরাদ্দপত্র দেখিয়ে নেয়া ওই সম্পত্তির ওপর গড়ে উঠেছে ‘শাহ আলী নগর হাউজিং এস্টেট’ নামক একটি উপ-শহর। এখন অর্ধশত সরকারি প্লটের ওপর ব্যক্তিমালিকানার ভবন নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

অ্যাটর্নি জেনারেল দফতর সূত্র জানায়, সরকারি সম্পত্তি গোপন এবং প্রকাশ্যে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এক শ্রেণির আইন কর্মকর্তা। অভিযোগ রয়েছে, তারা অ্যাটর্নি অফিস থেকে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন। কিন্তু গোপনে কাজ করেন সরকারি স্বার্থের বিরুদ্ধে। সরকারি আইনজীবী হয়েও গোপন সমঝোতায় আসামিপক্ষে কাজ করার অভিযোগে সম্প্রতি একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।

গোপন সমঝোতায় মামলার প্রতিপক্ষের স্বার্থ রক্ষা করছেন-এমন আরো কয়েকজন আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, তারা সরকারি সম্পত্তি কিংবা রাষ্ট্র স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলায় আন্তরিকভাবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন না। দায়সারা গোছের বিরোধিতা করে মামলার সুফল তুলে দিচ্ছেন প্রতিপক্ষের হাতে।

সরকারি সম্পত্তি সেলামির বিনিময়ে বরাদ্দ প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে দায়েরকৃত রিট (৪২৬০/২০১৯) নথিতে দেখা যায়, চাঁদপুর জেলা পরিষদের মালিকানাধীন অন্তত ২শ’ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি ‘সেলামি’র বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে সম্পত্তিটি বিক্রির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলা পরিষদ জেলার বাবুরহাট বাজারে ‘জেলা পরিষদ সুপারমার্কেট কাম-বাণিজ্যিক ভবন’র দোকান বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি দেয়। বাণিজ্যিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় ১০৫টি দোকান বরাদ্দ দেয়া হবে-মর্মে উল্লেখ করা হয়। জেলার তৎকালিন নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মান্নানের স্বাক্ষরে প্রকাশিত হয় বিজ্ঞপ্তিটি। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বরাদ্দ দেয়ার কথা থাকলেও প্রতি বর্গফুটের ‘সেলামি’ ধরা হয় ৭ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং সেলামি মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ ট্যাক্স। বায়নার টাকা ধার্য করা হয় দেড় লাখ টাকা।

সেলামির বিনিময়ে এই বিক্রি সুসম্পন্ন হলে নিচ তলার আরও ১০৫টি দোকানও একই প্রক্রিয়ায় বিক্রির পরিকল্পনা নিয়েছে এই স্বার্থান্বেষী স্থানীয় মহল। এ হিসেবে অন্তত ২শ’ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যেই সেলামির অগ্রিম বাবদ অর্থ নিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতে মামলা থাকায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কার্যাদেশ বাস্তবায়ন করতে পারছে না।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওসমান পাটোয়ারি ইনকিলাবকে বলেন, সরকারের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই এ মার্কেট নির্মাণ এবং দোকান বরাদ্দ হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন রয়েছে। এখানে সরকারের কোনো খরচ নেই। সালামির টাকা দিয়েই কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে। আশা করছি সরেজমিন তদন্ত করে এ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করবেন।

প্রায় অভিন্ন মন্তব্য করেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার কাজী মাইনুল হাসান। তিনি বলেন, জেলা পরিষদের সম্পত্তির একটি অংশ জুড়ে শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে। সেলামির বিনিময়ে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। সরকারি সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গেছে কিংবা সরকারি স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে-এমনটি মনে করার কারণ নেই।

তিনি আরো বলেন, রিটটির শুনানি হয়েছে আমার পূর্বে যিনি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের দায়িত্বে ছিলেন তার সময়ে। গত ২৭ জানুয়ারি মামলাটির দায়িত্ব পেয়েছি। শুনানির সময় আমি ছিলাম না। আমার কাছে নথিও নেই। ১১ ফেব্রুয়ারি মামলাটির রায় হয়ে গেছে। শুনানিতে অংশ নেয়ার সুযোগ আমি পাইনি।

এদিকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ রিটকারীর বিপক্ষে রায় দিয়েছেন। এর ফলে সরকারি সম্পত্তি বিক্রির পথে আইনগত অন্তরায় আপাতঃ দূর হয়েছে। কিন্তু রিটকারী পক্ষের কৌঁসুলি ড.বাবরূল আমীন বলেন, আমরা হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতি নিয়েছি। তিনি বলেন, জেলা পরিষদের সম্পত্তি (অর্জন, ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও হস্তান্তর) বিধিমালা-২০১৭ এর ৭ নম্বর বিধিতে জেলা পরিষদ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। উক্ত বিধির (খ) অনুযায়ী রাজস্ব আয়ের উৎস সৃষ্টিকল্পে পরিষদের মালিকানাধীন জমি অনুর্ধ্ব এক বছরের জন্য ইজারা বা ভাড়া প্রদান করা যাবে। কিন্তু ১০ নম্বর বিধিতে ‘পরিষদের সম্পত্তি হস্তান্তর’ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এই বিধির (১) উপ-বিধি (৩) এর বিধান সাপেক্ষে ‘সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে পরিষদের কোনো সম্পত্তি ইজারা বা ভাড়া প্রদান ব্যতীত, বিক্রয়, বন্ধক বা অন্য কোনো পন্থায় হস্তান্তর করা যাইবে না।’ সুস্পষ্ট এই বিধান সত্তে¡ও বাবু বাজারের সম্পত্তি বিক্রি প্রক্রিয়া চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে।

আইন কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় সরকারি সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে- এমন অভিযোগের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, আমি মামলাটি সম্পর্কে এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না। নথি দেখে এ বিষয়ে মন্তব্য করা সম্ভব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
মারিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১:১৬ এএম says : 0
যারা এই অন্যায়ের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হোক
Total Reply(0)
Sohel Rana ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১:৫১ এএম says : 0
ডিজিটাল বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি
Total Reply(0)
Md. Mohammad Ali ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ২:০০ এএম says : 0
সরকারি জায়গায় কোন অবৈধভাবে কেউ কোন দখল করতে পারবে না
Total Reply(0)
Saju Ahmed ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ২:০৮ এএম says : 0
ধরা পরলেও আইনের ফাঁক-ফোকরে জামিনে বেরিয়ে আসছেন আসামিরা।
Total Reply(0)
প্রিয়সী ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ২:১৯ এএম says : 0
সরকারি সম্পদ সবাই মিলে মিশে ভাগ বাটওয়ারা করে খায়!
Total Reply(0)
ফিরোজ ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ২:২০ এএম says : 0
রক্ষক যখন ভক্ষক তখন আর কি বলার থাকে ?
Total Reply(0)
MD.Uzzal Hossain ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:২৩ পিএম says : 0
১.আইনের আওতায় আনা হবে ২.জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না ৩.অপরাধী যেই পুলিশ
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন