বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

অবক্ষয় রোধ ও সম্প্রীতি রক্ষায় করণীয়

মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর | প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

সৃষ্টিকুলের মধ্যে কেবল মানবজাতিই সর্বশ্রেষ্ঠ। মানবজাতির প্রতিটি সদস্য দেহাবয়ব আত্মা আবেগ ও বিবেকের সমন্বিত সার্বিক গুণে গুণান্বিত। আশরাফুল মাখলুকাত খ্যাত মানুষের জীবনের একান্ত সাধনা হচ্ছে মনুষ্যত্ব অর্জনের চেষ্টা করা। মনুষ্যত্বের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক বিরাজমান। যে কোন সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও অনৈতিকতা জঘন্যতম অপরাধ ও সব অপকর্মের মূল হিসেবে পরিগণিত। প্রতারণা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি সমাজবিরোধী কার্যকলাপের মূলে রয়েছে অসততা। মানুষের জীবনে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিলে সততার অবসান ঘটে। ফলে সমাজজীবনে নানা রকম অনৈতিক কর্মকান্ড, পাপাচার, অনাচার, অবৈধ কাজ প্রভৃতি প্রাধান্য পায়। তখন মানুষের মধ্যে নৈতিক গুণাবলি হারিয়ে যায়। এমনিভাবে মানুষ অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হলে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ লোপ পায়, এতে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় যার ফলে পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রেও বিশৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সমাজজীবনে মানুষের সততা ও নৈতিকতার অভাবে ব্যাপক আকারে অন্যায় ও অনৈতিকতা প্রবেশ করে জাতিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয় এবং জাতীয় জীবনে নৈতিক অধঃপতনের সূচনা হয়।

সমাজে বসবাসরত গুটি কয়েক মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে হিংসা, অহংকার, ক্রোধ-বিদ্বেষ, ছিনতাই, লোভ, শঠতা, ঘুষ, দুর্নীতি, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, মুনাফেকি, অন্যায়, অবিচার, জুলুম কেবল বেড়েই চলে, তাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এক চরম অবক্ষয় পুরো সমাজকে ছেয়ে ফেলে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ অবক্ষয় ছেয়ে যায়। এ অবক্ষয় ধীরে ধীরে সবাইকে কলুষিত করে। বর্তমানে দেশের সামগ্রিক অপরাধজনক পরিস্থিতির জন্য অনেক কারণের উল্লেখ করা যেতে পারে। এর মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ই প্রধান কারণ।

দেশে সম্প্রতি সময়ে চলমান আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা হল মুক্তবুদ্ধি চর্চা কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে অবিবেচক ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন গুটি কয়েক লোক সম্প্রীতি নষ্ট করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। অপরদিকে অতি উৎসাহী বিবেকহীন গুটি কয়েক ব্যক্তি যাচাই বাছাই না করে অতি উৎসাহী হয়ে গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। এ বিষয়টি শান্তিপ্রিয় জনগনকে বেশ ভাবিয়ে তুলছে। এছাড়াও মতলবী ও সুযোগ সন্ধানী কুশীলবদের পরোক্ষ ইঙ্গিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কতিপয় গোঁড়া ও পথভ্রষ্ট তরুন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সংবেদনশীল ধর্মীয় বিষয়ে পরিকল্পিত আক্রমন করে যাচ্ছে। তারা সময়ে সময়ে আপত্তিকর মন্তব্য, অশ্লীল পোস্ট করে সোস্যাল মিডিয়ায় তা ছড়িয়ে দিয়ে ধর্মীয় উসকানী দিচ্ছে। বিপরীতে ধর্মপ্রাণ মুসলিম তরুন ও ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ এ সকল বিষয়ে প্রতিবাদ করে বক্তব্য বিবৃতি মিছিল ও সমাবেশ করছেন। এসব অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির কারণে জাতির মধ্যে একধরণের বিভেদের দেয়াল তৈরী হচ্ছে, সম্প্রীতির পরিবেশ ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

যে কোনো দেশের উন্নতি বহুলাংশে নির্ভর করে জনগণের শিক্ষা দীক্ষা, কর্মদক্ষতা, নৈতিক শক্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহনশীল আচরণের ওপর। ক্ষেত্র বিশেষে নৈতিক শিক্ষাই উন্নয়নের মুল চালিকা শক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। কেননা নৈতিক শিক্ষা মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং ভালো কাজে উৎসাহ দেয়। যে দেশের জনগণের নৈতিক অধঃপতন হয়, সে দেশ প্রচুর সম্পদের অধিকারী হলেও কাঙ্খিত অগ্রগতি অর্জন করতে পারে না। আপামর জনসাধারণের উন্নতি ব্যতীত কতিপয় লোকের উন্নতির দ্বারা কোনো দেশ যথাযথ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে না। অতএব একটি দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা, উন্নতি ও প্রগতির জন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা। সাধারণত মানুষ ঘর ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে নৈতিক শিক্ষা লাভ করে। নৈতিক সব শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্মের মাধ্যমে মানুষ আদব-কায়দা, আচার-আচরণ ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে সব ধরনের লোভ-লালসা, প্রলোভন ও অপকর্ম থেকে বিরত রাখে। এ শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানী, সৎ, নম্র বিনয়ী ও চরিত্রবান হতে সাহায্য করে। সুতরাং ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বড় দালানকোঠা নির্মাণ করতে হলে যেমন এর ভিত্তি মজবুত হওয়া আবশ্যক, তদ্রূপ আদর্শ জাতি গঠনের লক্ষ্যে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে হলে তাদের শৈশবকালের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত। এই ভিত্তি মজবুত করার জন্য ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

যে সমাজে আমরা বসবাস করি সে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা, সুখ-সমৃদ্ধি, ঐক্য-স¤প্রীতি, সাম্য-মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের নিদর্শনস্বরূপ মানুষের মধ্যে স্নেহ-মায়া-মমতা, শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি, ধৈর্য-সহনশীলতা, সততা, বিশ্বস্ততা, সংবেদনশীলতা প্রভৃতি সামাজিক গুণ অবশ্যই থাকা উচিত। আমাদের সকলের একথা জানা উচিত যে, সকল প্রকার দ্বন্ধ-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গোলমাল-হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ, ফিতনা-ফ্যাসাদ, সহিংসতা-উগ্রতা, হিংসা-বিদ্বেষ এগুলো অনিষ্ট ও অকল্যাণের অশুভ লক্ষণ। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ চায় শান্তি সহনশীলতা ও সম্প্রীতি। এরকম পরিবেশ গড়ার জন্য সকলকে স্ব স্ব আঙ্গিনা থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সমাজে পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি অটুট রাখার ফলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও সহাবস্থান এর মাধ্যমে শান্তিময় পরিবেশ গড়ে উঠে। আর এ সুন্দর পরিবেশের কারণে ব্যক্তির মন থেকে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা ও হৃদয়হীনতার পাশবিক বৈশিষ্ট্য দূর হয়ে যায়।

মানবসমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী যে কোন কার্যকলাপকে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর এতে তোমরা বিপর্যয় ঘটাবে না। (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৫৬)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে না, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৭৭)। পবিত্র কোরআনে যে কোন হাঙ্গামা, উসকানী গুজব ইত্যাদিকে ফিতনা বলে ঘোষনা করা হয়েছে। আর এ ফিতনার ভয়াবহতা সম্পর্কে স্বয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯১)।

মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়। (আবু দাউদ : ৫১২৩)।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কারণ ধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা। তোমরা আঁড়ি পেতো না, গোপন দোষ অন্বেষণ করো না, স্বার্থের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না, হিংসা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না, সম্পর্কচ্ছেদ করো না, পরস্পর কথাবার্তা বন্ধ করো না, একে অপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিও না, দাম-দস্ত্তরে প্রতারণা করো না এবং নিজের ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের মাঝে ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করো না। হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহ যেমন আদেশ করেছেন, সবাই তোমরা আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’(সহীহ বুখারী : ৫১৪৩ সহীহ মুসলিম: ২৫৬৩)।

হযরত আবু বারযা আলআসলামী রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ওহে যারা মুখে মুখে ঈমান এনেছ, কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি তারা শোন, মুসলমানের গীবত করো না এবং তাদের দোষত্রুটি অন্বেষণ করো না। কারণ যে তাদের দোষ খুঁজবে স্বয়ং আল্লাহ তার দোষ খুঁজবেন। আর আল্লাহ যার দোষ খুঁজবেন তাকে তার নিজের ঘরে লাঞ্ছিত করবেন। (মুসনাদে আহমদ : ১৯৭৭৬ ; সুনানে আবু দাউদ : ৪৮৮০)

নৈতিক অবক্ষয় রোধ ও সম্প্রীতি রক্ষায় সকল মানুষের স্ব স্ব অবস্থান অনুযায়ী নিজস্ব পরিসর ওা বলয়ের মাঝে সুনিদিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলো প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও। আর যখন মানুষের বিচার-মীমাংসা করবে, তখন ন্যায়ভিত্তিক মীমাংসা করো। আল্লাহ তোমাদের সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৮)

আবদুল্লাহ্ ইব্নু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ যে, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব ইমাম, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল, তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির উপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোন ব্যক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখ, প্রত্যকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সহীহ বুখারী- ৬৬৫৩) বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যকার সম্প্রীতি ও সহিষ্ণু সহাবস্থান একটি সমাজের সৌন্দর্যের প্রতীক। এর মধ্য দিয়ে জাতিসত্ত¡ার একতাবদ্ধ সুদৃঢ় অবস্থানই প্রকাশ হয়। বিশেষ কোনো কারণে কাউকে যদি কিছু জানানোর প্রয়োজন পড়ে, তাহলে সহনশীল পন্থা অবলম্বন করলে সমাজে অশান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে না।
লেখকঃ প্রভাষক, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন