শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

সন্তান প্রতিপালনে ইসলামের দিকনির্দেশনা

হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ ইসমাঈল | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৮ এএম

৩. বিভিন্ন সময়ে সন্তান পিতামাতার মাঝে নানা ঝগড়াঝাঁটি, কথা কাটাকাটি ও মনোমালিন্য দেখে থাকে। একে অপরকে ভালোমন্দ বলতে শোনে। কখনো বা সে দেখে, পিতা মায়ের ওপর হাত তুলছে, একে অপরের সম্মানহানি করছে, পরস্পর আদব-আখলাক নষ্ট করছে। সন্তানের সামনেই এগুলো ঘটায়, তার মাঝেও এসব মন্দ গুণ প্রবেশ করে। সে তখন অন্যদের সঙ্গেও সামান্য থেকে সামান্য বিষয় নিয়ে অনুরূপ আচরণ করতে আরম্ভ করে। আর যখন মা-বাবার মধ্যকার মনোমালিন্য বৃদ্ধি পেয়ে তালাকের পর্যায়ে পৌঁছে যায় এবং উভয়ে ভিন্ন হয়ে যায়, তখন সন্তানের সামনে সমস্ত খারাপ কাজের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, আর সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে সে অন্যায়ের দিকে ধাবিত হয়।
৪. মা-বাবা গোনাহে লিপ্ত থাকা। তাদের মাঝে মদপান ও জুয়াখেলার নেশা থাকা। হারাম কামাইয়ের বদঅভ্যাস থাকা কিংবা আরও এমন গোনাহ, যা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিশেষকরে যখন মা বেহায়া হয়ে যায়, তখন বাচ্চার মাঝে খারাপির প্রভাব দ্রুত প্রকাশ পায়। টিভি, মোবাইলে ছবি দেখা তার সামনে।
৫. মাতাপিতা শুদ্ধ আছেন, তারা সন্তানের তরবিয়তও সঠিকভাবে করছেন। কিন্তু তাদের চতুর্পাশ্বের পরিবেশ, বন্ধুবান্ধবের পরিবেশ, বিদ্যালয়ের পরিবেশ, ওঠাবসার সঙ্গীদের পরিবেশ ভালো ও সঠিক নয়। বর্তমান সময়ে সন্তানদের খারাপ হওয়ার পেছনে এ কারণটাই বেশি ভূমিকা রাখছে। এসব অসৎ সঙ্গীর সংস্পর্শে এসেই তারা খারাপ জিনিস শিখছে এবং অনেক গোনাহে জড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে মোবাইল, টিভি ও খারাপ বই-পুস্তকও সবচেয়ে বড় অসৎ সঙ্গের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। সাইকোলজি বিশেষজ্ঞগণ অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, মানুষ দেখাশোনার মাধ্যমে বেশি প্রভাবিত হয়। সে বিষয়গুলোই অন্তরে বেশি মজবুতভাবে স্থান করে নেয়।
আজ সন্তানের সুন্দর তরবিয়ত মায়ের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের যুগে একেক মায়ের পনেরোজন সন্তানও হতো। সেকালে ঘরে ঘরে চাক্কি ব্যবহার হতো। সমস্ত ঘরোয়া কাজ নিজ হাতে করতে হতো। তবুও তাদের সন্তানদের আদর্শ তরবিয়ত হয়েছে। বড়ো বড়ো আলেম, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকিহ, আকাবির তৈরি হয়েছেন তাদের ঘরে। কিন্তু বর্তমানে আলাদা কাজের লোক রাখা হয়, বিভিন্ন কাজ সহজ করার জন্য বিভিন্ন মেশিনারিও তৈরি হয়েছে, রুটি বানানোর মেশিন পর্যন্ত বাজারে এসে গেছে। এতো কিছুর পরও সন্তান একটুখানি বিরক্ত হলে টিভি, মোবাইল চালু করে তাকে বসিয়ে দেন পিতামাতা। আর নিজে ব্যস্ত হয়ে যান অন্য কাজে। বিশেষজ্ঞগণ বলেন-‘বাচ্চা যখন টিভি-মোবাইলে বিভিন্ন জিনিস দেখে, তখন তা কাজে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে।’ এভাবেই তার জীবনে বহু খারাপির সূচনা হয়। শিশু থেকে বাঁচার জন্য মায়ের এ ধরনের কাজকে আরবিভাষায় নেক তরবিয়ত থেকে পালানো বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ মা সন্তানের কাছ থেকে দূরে সরে থাকেন। সে কান্না করলে মা নারাজ হয়ে পড়েন। তাকে সামলাতে গিয়ে তিনি পেরেশান হয়ে যান। তখন তিনি সন্তানকে মিডিয়ার মাধ্যমে এমন অপরাধমূলক বিষয়ের সামনে পেশ করেন, যার জন্য তার ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পিতামাতার জীবনও অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে।
বাচ্চাদেরকে যেসব সিরিয়াল বর্তমানে দেখানো হয়, তার মাঝে অন্যতম হলো আদালত, সিআইডি, আহট, ডরিমন, টম অ্যান্ড জেরি, ইত্যাদি। বিজ্ঞজনদের মতে এসব সিরিয়ালে বাচ্চাদের সূ²ভাবে শেখানো হয়- কিভাবে অন্যদের সঙ্গে দুশমনি করবে? কিভাবে শত্রুর বদলা নেবে? অন্যের ওপর অত্যাচার কিভাবে করবে? অন্যের মাল কিভাবে চুরি করবে? কীভাবে খুন করবে? অবৈধ নারীর সঙ্গে জিনা কিভাবে করবে? কারো সম্মানের ওপর কিভাবে আঘাত করবে? তাদের মতে এসব সিরিয়ালে বাচ্চাদেরকে এর ট্রেনিং দেওয়া হয়। গভীর উপলব্ধির বিষয় হলো, এ সমস্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত শিশুর কাছে পিতামাতার অনুগত ও বাধ্য হবার আশা কখনোই করা যায় না।
৬. অনেক পিতামাতা সন্তানকে কার্টুনের সামনে বসিয়ে দেন। কোনো দীনি মাসআলা হলে তা বোঝানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু এ সমস্ত সিরিয়াল সম্পর্কে আজকের পিতামাতা ও সন্তানরা অধিক অবগত, বোঝানোর দরকার নেই। ছোটো ছোটো শিশুরা আজ ‘ডরিমন’ সিরিয়ালের পাগল। মায়েরাও তার থেকে ছাড় পাবার জন্য ও তাকে শান্ত রাখার জন্য ‘ডরিমন’ সিরিয়াল চালু করে দেন। অথচ এসব সিরিয়ালের মাধ্যমে ছোটো শিশুর কচি মন থেকে আল্লাহর একত্ববাদকে মুছে দেওয়া হচ্ছে, আল্লাহর কল্পনাকে নিঃশেষ করা হচ্ছে। আবার কিছু সিরিয়ালে জাদু দেখানো হয়। যার একটি নমুনা ‘ডরিমনের গ্যাজেট’।
কিছু হারিয়ে গেলে ডরিমন একটি গেজেট ব্যবহার করে, সঙ্গে সঙ্গে তা তার হাতে চলে আসে। তখন বাচ্চারাও এ কামনা করে, আমারও যদি একটি এমন গেজেট হতো, তাহলে আমিও আমার হারিয়ে যাওয়া বস্তু অর্জন করতে পারতাম। আরেকটি সিরিয়াল হলো ‘শাকালাকা বুম বুম’। যার মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে, একটি পেন্সিলের সাহায্যে ড্রো করলে প্রার্থীত বস্তু হাসিল হয়। এ সমস্ত সিরিয়ালের মাধ্যমে বাচ্চাদেরকে শেখানো হচ্ছে, মানুষের মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারে শুধু শাকালাকা বুম বুমের পেন্সিল ও ডরিমনের গ্যাজেট। অথচ একজন মুসলিমের উচিত, কিছু হলেই আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া, তার কাছে দোয়া করা, নামাজ আদায় করা ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখে ধৈর্য ধারণ করা। কিন্তু এসব সিরিয়ালের সাহায্যে তার কল্পনা ও কচি মন থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছে এ সহিহ বিশ্বাস। স্থাপন করা হচ্ছে গাইরুল্লাহর মিথ্যা বিশ্বাস এবং শিরিক।
এ তো হলো বাচ্চা খারাপ হবার একটি কারণ মাত্র। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পিতামাতা নিজের কলিজার টুকরো সন্তানের তরবিয়তের জন্য এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন না।
কিন্তু ইহুদি-নাসারাদের হাতে তিনি-চার ঘণ্টা তরবিয়তের জন্য ঠিকই ছেড়ে দিচ্ছেন এসব সিরিয়ালের সামনে। পিতামাতার এক ঘণ্টার পরিবর্তে কাফের-মুশরিকরা তিন-চার ঘণ্টা যে শিশুর মগজ ধোলাই করছে, তার ওপর কি ভরসা করা যায়- সে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) এবং পিতামাতার অনুগত হবে? সাইক্লোজি ডাক্তারদের বক্তব্য হলো- টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট আসার পর থেকে মানসিক রোগীর ভেতর বড়োদের পাশাপাশি ছোটোদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বহু সন্তান এর কারণে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। মা-বাবার অবাধ্য হচ্ছে। ছোটো ছোটো বিষয়ে পিতামাতাকে আত্মহত্যার ভয় দেখাচ্ছে। অথচ নিষ্পাপ শিশুর এ অধঃপতন ও দুরাবস্থার একমাত্র কারণ সন্তানের প্রতি তার পিতামাতার অসতর্কতা ও বোকামি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন