শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামে মুসাফাহার বিধান ও প্রয়োজনীয়তা

মনির হোসেন হেলালী | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৮ এএম

ইসলাম এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যাতে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ নিয়ে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। মানুষের সামাজিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুসাফাহা। কিন্তু গত ৮ মার্চ, ২০২০ ইং বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ নামে এক ভাইরাস ধরা পড়েছে। যা খুবই ভয়াবহ। অবশ্য তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরো কিছু দিন আগেই ধরা পড়েছে। সর্বপ্রথম ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে এ অজানা নতুন ভাইরাসটির সংক্রমণের খবর প্রকাশিত হয়। এর পর ১৩ জানুয়ারি, ২০২০ সালে চীনের বাইরে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার খবর জানা যায় থাইল্যান্ডে। এর পর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ইং ইউরোপে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয় ফ্রান্সে। বর্তমানে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণকারী মানুষের সঠিক সংখ্যা গণণা করে বলা অসম্ভব। বিশ্ব ব্যাপী করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর কারণে আজ মানুষ মুসাফাহা করা ভুলতে শুরু করছে। এ ব্যাপারে ইসলাম কী বলে তা জানা সময়ের দাবি।
অভিধানের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় মুসাফাহার আবিধানিক অর্থ করমর্দন করা, হাতে হাত মেলানো। আগন্তুক অথবা সাক্ষাতকারীর হাত ধরে তাকে অভিনন্দন জানানোর নাম মুসাফাহা। এটা সালামের পূর্ণতা সাধন করে। কারও সাক্ষাত হলে মুখে সালাম আদান-প্রদান করে হাতে হাত মিলানো মুসলিম ঐতিহ্য ও সামাজিকতার অংশ। নাবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত। সাহাবাদের রীতি-রেওয়াজ। এ বিষয়ে কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, আমি আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, সাহাবাদের আমলে কি তাদের মধ্যে মুসাফাহার প্রচলন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। -[সহিহ বুখারি : ৬২৬৩]।
নাবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন, রোগী দেখতে যাওয়ার কাজ পূর্ণ হয় রোগীর কপালে বা হাতে হাত রেখে এ কথা জিজ্ঞাসা করলে, আপনার অবস্থা কেমন? আর অভিনন্দন জানানো পূর্ণ হয় মুসাফাহা করলে। -[মিশকাত : ৪৬৮১] মুসলমানদের সৌহার্দ্যপূর্ণ স¤প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধন আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয়। মানুষের বন্ধন সুদৃঢ় হয় সুন্দর আচরণের মাধ্যমে। তাই সুন্দর আচার-ব্যবহার প্রকাশের প্রতিটি ধরন আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দনীয়। কারও সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সালাম আদান-প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রতি হাত বাড়িয়ে দিলে ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও বিনয় প্রকাশ পায়। পরস্পরে এমন ভালোবাসার দৃশ্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে অনেক পছন্দনীয়। আল্লাহ খুশি হয়ে পুরস্কার প্রদান করেন। কাজ যদিও ছোট কিন্তু পুরস্কার দিচ্ছেন আল্লাহ। তাই কাজের বিবেচনায় পুরস্কার ছোট হবে না। বরং দাতার বিবেচনায় তা বড়ই হবে। আল্লাহর নাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, দুজন মুসলিম যদি সাক্ষাতের সময় মুসাফাহা করে তবে তারা আলাদা হওয়ার আগেই আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন। -[সুনানে আবু দাউদ : ৫২১৪]
মুসাফাহার সংজ্ঞা : মুসাফাহার পারিভাষিক সংজ্ঞায় আলেমদের একাধিক মত পাওয়া যায়। প্রখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হাতের তালু দ্বারা হাতের তালু ধারণ করার নাম মুসাফাহা বা করমর্দন করা।
আল্লামা খাত্তাবী বলেন, মুসাফাহা হলো, সালাম থেকে অবসর না হওয়া পর্যন্ত পরস্পর সংযুক্ত থেকে হাতের তালুর উপর হাতের তালু রাখা।
মুসাফাহার গুরুত্ব ও ফজিলত : আনাস রাদি আল্লাহু বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কেউ এলে তিনি তার সাথে মুসাফাহা করতেন। [তিরমিযি] অপর বর্ণনায় এসেছে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “দুজন মুমিন পরস্পরে সাক্ষাত হলে, যদি সালাম বিনিময় করে মুসাফাহা করে তাহলে গাছের পাতা যেভাবে ঝড়ে পড়ে সেভাবে তাদের হাতের গুনাহগুলো ঝড়ে পড়ে।” [তাবরানী; বায়হাকী] কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, আমি আনাস রাদিআল্লাহুকে জিজ্ঞাসা করলাম, সাহাবাদের আমলে কি তাদের মধ্যে মুসাফাহার প্রচলন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। -[সহিহ বুখারি : ৬২৬৩]। বারা ইবনে আজেব রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দু’জন মুসলিম সাক্ষাৎকালে মুসাফাহা করলেই একে অপর থেকে পৃথক হবার পূর্বেই তাদের (গুনাহ) মাফ করে দেওয়া হয়।’’ [আবু দাউদ ৫২১২, ৫২১১, তিরমিযি ২৭২৭, ইবন মাজাহ ৩৭০৩]
কারও সঙ্গে সাক্ষাতের পর প্রথমে সালাম দেওয়া। তারপর সুযোগ হলে হাত মিলিয়ে মুসাফাহার মাধ্যমে সালামকে পরিপূর্ণ করা। আব্দুুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সালামের পরিপূর্ণতা হলো মুসাফাহা।’ [তিরমিজি : ২৭৩০]। মুসাফাহার আদব সম্পর্কে আনাস রাদিআল্লাহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর অভ্যাস ছিল, কোনো ব্যক্তি এগিয়ে এলে তিনি মুসাফাহা করতেন। সে ব্যক্তি হাত না সরানো পর্যন্ত তিনি নিজের হাত সরাতেন না এবং চেহারা না ফেরানো পর্যন্ত তিনি মুখ ফেরাতেন না। সঙ্গে উপবিষ্ট লোকদের সামনে দুই হাঁটু ছড়িয়ে বসতেন না।’ [তিরমিজি : ২৭২৭]
ইসলামে মুসাফাহার বিধান : আলেমদের কেউ কেউ বলেন মুসাফাহা করা মুস্তাহাব। আর অধিকাংশের মতে মুসাফাহা করা সুন্নাত। ওলামায়ে কিরামের বক্তব্য নিম্নরূপ-
১. ইমাম নাওবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র মতে মুসাফাহা মুস্তাহাব। এ প্রসঙ্গে রদ্দুল মোখতার ফত্ওয়া গ্রন্থে আছে- তিনি বলেন, জেনে রেখো, প্রত্যেক সাক্ষাতের সময় মুসাফাহা করা মুস্তাহাব। [সূত্র. আনোয়ারুল হাদীস, আল্লামা জালালুদ্দীন আহমদ আমজাদী, মুসাফাহা অধ্যায়, পৃ. ৪০১] ২. ফতওয়া শামী মুসাফাহা অধ্যায়ে আছে- বরকত অর্জনের জন্য আলেমেদ্বীন ও ধার্মিক মুত্তাকী লোকদের হাত চুম্বন করা জায়েয। [প্রাগুক্ত] ৩. শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রণীত ‘আশিয়াতুল লুমআত’ (মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ) ৪র্থ খন্ড ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন- সাক্ষাতের সময় মুসাফাহা করা সুন্নাত। ৪. মুসাফাহা করা সুন্নাত, হাদীস শরীফে এ প্রসঙ্গে অসংখ্য ফজিলত উল্লেখ করা হয়েছে। জামাত সহকারে নামাযের পর মুসাফাহা করা নিঃসন্দেহে জায়েয। বিখ্যাত ফিকাহ্গ্রন্থ, ফতওয়ায়ে শামীতে উল্লেখ আছে যে, আসর নামাযের পরও মুসাফাহা করা জায়েয। ফকীহ্গণ যেটা বিদআত বলেছেন, তা বিদআতে হাসনাহ ও মুবাহ্ অর্থে প্রযোজ্য যেমন ইমাম নওবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় আযকারে উল্লেখ করেন। [ফতোয়ায়ে ফয়জুর রসূল, আল্লামা মুফতি জালালুদ্দিন আমজাদী, পৃ. ২৩৮]
মুসাফাহার নিয়ম : মানুষের পারস্পরিক সাক্ষাতে সালাম বিনিময়ের পর একে অপরের সঙ্গে মুসাফাহা করে বা হাত মেলায়। এটিকে ইংরেজিতে হ্যান্ডশেক (ঐধহফংযধশব), আরবিতে মুসাফাহা কিংবা বাংলায় করমর্দন বা হাত মেলানো বলে থাকে। একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমের সাথে সাক্ষাত কালে একে অপরের ডান হাত মিলিয়ে মুসাফাহা করা হয়। মুসাফাহা করতে হয় হাতের তালুর সাদা অংশ বা ভেতরের অংশ মিলিত করে। হাতের পিঠের অংশ মিলিয়ে মুসাফাহা নয়। অথবা এক হাতের তালুর অংশ অন্য হাতের পিঠের অংশের সাথে মিলিয়ে মুসাফাহা নয়।
মুসাফাহার সুন্নাত পদ্ধতি : জনৈক ব্যক্তি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকটে মুসাফাহা করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কেবল দু’হাত মিলানোর ব্যাপারে সম্মতি দেন [তিরমিযী হা/২৭২৮; মিশকাত হা/৪৬৮০; ছহীহাহ হা/১৬০]।
মুসাফাহা করার সময় ঝাঁকি নয় বরং স্বাভাবিকভাবে উভয়ের ডান হাত মিলাবে। যা অত্যন্ত নেকীর কাজ [আবুদাঊদ হা/৫২১২; মিশকাত হা/৪৬৭৯, সনদ সহীহ]। সুতরাং এর বাইরে ঝাঁকি দেওয়া বাড়াবাড়ি বৈ কিছু নয়। মুসাফাহা করার সময় নির্ধারিত কোন দুয়া পড়ার সহি দলিল নেই। তবে হাদিসে আল্লাহর প্রশংসা ও ইসতিগফার করার কথা বলা হয়েছে। মুসাফাহার দু‘আ আছে তবে তা নির্ধারিত না। তাই আমরা দেখতে পাই, আমাদের সমাজে এর একটি দু‘আর প্রচলন রয়েছে।
মুসাফাহা কয় হাতে করবে : মুসাফাহা কয় হাতে করতে হবে এব্যাপারে দুটি মত পাওয়া যায়। একটি হলো এক হাতে মুসাফাহা করবে। অর্থাৎ শুধু ডান হাত দিয়ে মুসাফাহা করবে। দ্বিতীয় মতটি হলো- মুসাফাহা দুহাতে হবে। অর্থাৎ ডান হাতের সাথে বাম হাতও যোগ করা হবে। তবে এক হাতে করার ব্যাপারে বেশি শক্তিশালী দলিল পাওয়া যায়। তবে কেউ যদি দুহাতে মুসাফাহা করে তাতেও কোন দোষ নেই। এক হাতে বা দুহাতে- এ নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। মুসাফা করলেই গুনাহ মাফ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। মুসাফাহা কয় হাতে হবে এ নিয়ে শায়খ মুহাম্মদ সালেহ আল মুনাজ্জিদকে প্রশ্ন করলে তিনি জবাবে বলেছেন- মুসাফাহা সংঘটিত হয় ব্যক্তি তার হাতের তালু অপর ব্যক্তির হাতের তালুতে রাখার মাধ্যমে। এটাই আরবি ভাষার দাবী; ঠিক যেমনটি উদ্ধৃত হয়েছে ‘মু’জামু মাকায়িসিল লুগাহ’ (৩/২২৯) ও অন্যান্য অভিধানে। মুসাফাহা সম্পর্কে ইতিপূর্বে উল্লেখিত হাদীসগুলোর আপাতঃ মর্ম এভাবেই বুঝতে হবে। এ কারণে অধিকাংশ আলেমের মতে, এক হাতে মুসাফাহা করাই সুন্নত হিসেবে যথেষ্ট এবং এটা ছিল মুসলমানদের মাঝে ও সাহাবায়ে কিরামের মাঝে সাধারণ অভ্যাস।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন