শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আহ! কি যন্ত্রণা : কীভাবে বেঁচে আছে জাহানারা?

আবু জাফর মুহাম্মদ সোহেল | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:৩১ পিএম

আহ! কি যন্ত্রণা। এমন করুন অবস্থায়ও তাকে সান্ত্বনা দেওয়ারও যে কেই নেই। শক্তিহীন জাহানারা চিৎকার করে কাঁদিতেও পারে না। দেখে মনে হয় মৃত্যুর প্রহর গুণছে অসহায় জাহানারা।

দূর থেকে কিংবা কাছে গিয়ে দেখলে যে কারোরই মন শিহরিত হয়ে উঠবে। যারা সামান্য দুর্বল চিত্তের তাদের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়বে জল। তার হাতের অবস্থা দেখে অনেকেই স্তম্ভিত। জীর্ণশীর্ণ কাপড়ে ঢাকা না জানি শরীরের কি অবস্থা। হয়তো পুরো শরীরটা জুড়েই রয়েছে এরকম অসংখ্য যন্ত্রনাদায়ক ক্ষত। সাধারণ মানুষ যেখানে সামান্য কাটাছেঁড়াতে যন্ত্রনায় কাতর হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় জাহানারা কীভাবে বেঁচে আছেন।

হাতের আঙ্গুলগুলো দেখলে মনে হবে সেখানে গজিয়েছে গাছের শিকড়। অপুষ্টি আর চিকিৎসাহীন থাকায় সেগুলো পচে ঝরে ঝরে পড়ছে। অনেক পথচারী তার অবস্থা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননা। কিন্তু জাহানারার কোনো অনুভূতিই নেই। পড়ে আছেন নিয়ে টিকাটুলি মোড়ে সড়কের পাশে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে তার সময়। হাসি-কান্না, দু:খ-যন্ত্রনা বোঝার অনুভূতিও যে হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগে। ঠিকমত দাঁড়াতে, বসতে বা শুতেও পারে না। সব সময় একই ভঙ্গিতে পড়ে থাকে। তবে কখনো কখনো তাকে একটু আধটু হাঁটতে দেখা যায়।

তার পাশ দিয়ে প্রতিদিন হেঁটে যায় অসংখ্য মানুষ। রাস্তায় অসংখ্য সারি সারি গাড়ী। সে সব গাড়ীতে কতই না ভিআইপি হুইসেল বাজিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে। কিন্তু ১০/১৫ বছরেও জাহানারার প্রতি কারো নজর পড়েনি। দেশে কত হাসপাতাল, ক্লিনিক আর মাতৃসদন। কিন্তু হায়! জাহানারার জন্য কোথাও কি নেই একটু চিকিৎসার সুযোগ।

এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৫/২০ বছর ধরে এভাবেই তারা তাকে দেখছেন। এলাকার অনেকে তাকে পাগল জাহানারা হিসেবেই চিনে। রোদ-বৃষ্টি, রাত কিংবা দিন তার কাছে সবই সমান। এ যেন মৃত লাশ। লাশের যেমন কোনো অনুভূতি থাকে না। তেমনই তারও কোনো অনুভূতি নেই। অনেকেই অনেকভাবে সহায়তা করে। কিন্তু কেউ কখনো দায়িত্ব নিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়নি। হয়তো মৃত্যুর পর পরিচয়হীন জাহানারার একটা পরিচয় মিলবে। তার মৃত দেহটি যখন পড়ে থাকবে রাস্তার পাশে তখন কেউ না কেউ তা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে পাঠাবে। সেখানে কাটাছেঁড়ার পর বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তুলে দেয়া হবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের হাতে। তখন তার ঠিকানা হবে, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে কোনো এক গোরস্থানে।

আসলে কে এই জানাহারা? কোথাও কি তার নাম আছে। ভোটার লিস্ট, জন্ম সনদ কিংবা ইউনিয়ন কার্যালয়ে। না নেই। সে অসহায়, ছিন্নমূল, নিরন্ন। তবে সেও তো মানুষ। কিন্তু তার কি কোনো অধিকারও নেই। এভাবেই কি একদিন চলে যাবে ওপারে। হয়তো সেদিন কোনো পত্রিকার পাতায় খবর ছাপা হবে জাহানারা আর নেই। এটাই স্বাভাবিক। কারণ সন্ধ্যার পর ইত্তেফাক-ইনকিলাব মোড়ে সাংবাদিকদের মিলনমেলা বসে। কিন্তু কখনো কেউ তাকে নিয়ে দুকলমও লেখেনি। সবাই তাকে চিনে। ক্ষোভের সাথে কথাগুলো বলছিলেন দীর্ঘ দিন জাহানারারে দেখে আশা চায়ের দোকানদার ফারুক।

তিনি বলেন, ১৫/১৬ বছর আছে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসে জাহানারা। ওইটুকুই তার স্মৃতিতে আছে। এর বেশি কিছু সে বলতে পারে না। বখাটেরা সারাক্ষণ জ্বালাতন করে। মানুষের কাছ থেকে যা সাহায্য পায়, সন্ধ্যার পর তা চিনিয়ে নিয়ে যায়। দয়া করে, আজকে কেউ একটা নতুন শাড়ি পরিয়ে দিলো। কাল দেখবেন সেটা নাই।

এক সময় জাহানারা শখ করে একটি কুকুর পালতো। সেই কুকুরটি তাকে পাহারায় রাখতো। কিন্তু কয়েক বছর আছে ট্রাকচাপায় কুকুরটি মারা যায়। এরপর থেকে আরও অসহায় হয়ে পড়ে জাহানারা। কখনো ভিক্ষা চাই না। মানুষই আগ বাড়িয়ে তাকে কিছু না কিছু দেয়।

মানুষ কত সাধের খাবারই খায়। কিন্তু জাহানারার কপালে তা কখনো জোটে না। হয়তো এ কারণে সে ভুলেই গেছে সুস্বাসু খাবার কি? কিংবা খাবারের ধরণ। তাই সে শুধু খায় চা আর বনরুটি। কেউ যখন একটু ভালো খাবার দেয়, তখন সে সেগুলো দেয়ালে লাগানো পোস্টারে থাকা বিভিন্ন ছবিকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। খাবারগুলো হাতে নিয়ে ছবির মানুষগুলোর মুখের সামনে ধরে রাখে। এভাবেই কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর খাবারগুলো সে ফেলে দেয়।

জাহানারা শরীরে সব সময় পুরনো একটা নোংরা কাপড় জড়িয়ে রাখে। আর কিছুই নেই তার। খালি পায়ে দিন-রাত পড়ে থাকে এখানে সেখানে। মাঝে মাঝে নোংরা পানিতেও গড়াগড়ি করতে দেখা যায়। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে থাকে। চোখও ইদানিং দেখতে পায় কম। পুরনো শরীরে বেঁধেছে নানা রোগের জঞ্জাল। আসলে কি কখনো জাহানারা এই নরক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবে?

বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার সেই গানের কথাই বলতে হয়, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না…ও বন্ধু।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন