শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কিশোর গ্যাং দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

সমাজে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রচলিত ধারার অপরাধের সাথে সাথে নতুন ধারার অপরাধ যুক্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশেষ সংযোজন কিশোর গ্যাং কালচার। উঠতি বয়সের কিশোররা রাজধানীর পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাং গড়ে তুলছে। জড়িয়ে পড়ছে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, মাদকবাণিজ্য, চাঁদাবাজির মতো ভয়াবহ অপরাধে। এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এক দল আরেক দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এতে খুন ও জখমের ঘটনা ঘটছে। বিগত কয়েক বছর ধরে সমাজে এই কিশোর গ্যাং নতুন আতঙ্ক ও উপদ্রব হয়ে উঠেছে। এরা না মানে কোনো আইন-কানুন, না মানে শাসন-বারণ। দুর্বিনীত এই কিশোর গ্যাং যা খুশি তা করে বেড়াচ্ছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাব মতে, খোদ রাজধানীতে ৬০টি কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ৩৪টি সক্রিয়। গত ৩ বছরে এই গ্যাংয়ের সাথে জড়িত ৪ শতাধিক কিশোর র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছে। এদের বেশিরভাগই স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে, কেউ এখনো পড়ছে। হিরোইজম দেখাতে এবং এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার করতে এরা এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে বেড়াচ্ছে। ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, কিশোর গ্যাংয়ের হাতে রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতি মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি খুনের ঘটনা ঘটছে। অতি তুচ্ছ ঘটনায় দুর্বীনিত এই গ্যাং খুন-জখমের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। গত শুক্রবার রাজধানীর আফতাব নগরে সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›দ্ব নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে এক কলেজ ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বিগত কয়েক দিনে এমন ঘটনা বেশ কয়েকটি ঘটেছে। উচ্ছন্যে যাওয়া এই কিশোরদের গ্যাং এখন পুরো দেশ ও সমাজের জন্য এক ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশ ও জাতির ভবিষ্যত কান্ডারি বলা হয় কিশোরদের। এরাই আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেবে। এদের যথাযথ বিকাশ, নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় রীতি-নীতি ও মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের বাড়ন্ত এ সময়ে এ কাজটির যে চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তা কিশোরদের দল বেঁধে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া থেকে বোঝা যাচ্ছে। স্বাভাবিক নিয়মে কিশোরদের বাড়ন্ত ও দূরন্ত সময়ে পরিবারের অভিভাবক শ্রেণীর অধিক সতর্ক থাকতে হয়। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কার সাথে মিশছে, কখন ঘরে ফিরছে এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হয়। সেই সাথে সমাজের অভিভাবকদেরও সচেতন থাকা অপরিহার্য। দেখা যাচ্ছে, এই দুই শ্রেণীর মধ্যেই চরম উদাসীনতা ও বেখায়াল চরম আকার ধারণ করেছে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ধরে রাখা এবং সন্তানদের সঠিক পথে চালিত করার দায়িত্ব পালনে এড়িয়ে চলার মানসিকতা প্রকট হয়ে উঠেছে। আগামী প্রজন্মকে সঠিক পথে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং সরকারের দায়িত্ব অগ্রগণ্য। সরকারের দায়িত্ব পরিবার ও সমাজ যাতে মূল্যবোধ ধরে রেখে সঠিক পথে এগিয়ে চলে তার দিক নির্দেশনা দেয়া। কেবল অপরাধ ঘটলেই অপারধীকে ধরা বা সাজা দেয়াই তার দায়িত্ব নয়। অপরাধ যাতে ঘটতে না পারে, এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দেখা যাচ্ছে, সরকারের মধ্যে এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা রয়েছে। সরকারের পুরো মনোযোগ বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়ন করা। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় বড় মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ব্যস্ত। অথচ এসব উন্নয়ন যাদের জন্য এবং যারা এসবের সুফল ভোগ করবে, সেই ভবিষ্যত প্রজন্মই সঠিক পথে নেই। তারা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে বিপথগামী। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমে ব্যস্ত। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তবে এসব ইট-পাথরের অবকাঠামো উন্নয়ন দিয়ে কি হবে? মানুষের মানবিকতা এবং মূল্যবোধই যদি ধসে যায়, তাহলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সভ্যতা বলে কি কিছু থাকে? কোমলমতি যে কিশোরদের পড়ালেখা, খেলাধুলা ও সৃষ্টিশীল কাজে মনোনিবেশ করার কথা, তারা এখন এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্যাং গড়ে তুলছে। এলাকা এলাকায় গুন্ডামির রাজত্ব কায়েমে লিপ্ত। দিন দিন তাদের এই রাজত্বের বিস্তৃতি ঘটছে। এদের নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অথচ তৃণমূল থেকে সর্বত্রই ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আধিপত্য। তারা কি পারে না ভবিষ্যত প্রজন্মকে বিপথগামী হওয়া ও গ্যাং কালচার থেকে নিবৃত করতে? ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধিরা কি এ দায়িত্ব পালন করছে? বরং আমরা এমন খবর পাই, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কেউ কেউ কিশোর গ্যাংদের পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এর দায় সরকারের ওপর যেমন পড়ছে, তেমনি সামাজিক নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতাও প্রমাণিত হচ্ছে।

আমাদের চিরায়ত পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা ধর্মীয় মূল্যবোধকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। সুদীর্ঘকাল থেকেই ধর্মীয় রীতি-নীতি, শাসন-বারণ, আদব-কায়দা মানুষকে অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে রক্ষাকবচ হয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে, মাদরাসা শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সাধারণত মাদরাসায় নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করে থাকে। তারা এ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেখা যাচ্ছে, সরকারের উদাসীনতা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মাদরাসা শিক্ষা সংকুচিত হচ্ছে। এবতেদায়ী ও কওমী মাদরাসার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর ফলে যেসব নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান মাদরাসায় পড়াশোনা করত, তারা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের অনেকে গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে। নিম্নবিত্ত এসব শিশু-কিশোরকে সঠিক পথে রাখা এবং ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষার সম্প্রসারণে সরকারের যে ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন, তা অপ্রতুল অবস্থায়ই রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে যেমন সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে তেমনি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাঠ্যসূচিতে ইসলামী শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা মনে করি, দেশে কিশোর গ্যাং যেভাবে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে, তা নির্মূলে সরকারকে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোরদের পরিবারের অভিভাবকদের সচেতন করা থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি ও অটুট রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম ও নেতৃত্বই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে যতই উন্নয়ন করা হোক না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন