১৯৯৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে অনেক সাংবাদিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। সাংবাদিক খুনের সর্বশেষ শিকার গত ২০ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির। ১৯ ফেব্রুয়ারি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার মেয়র সমর্থক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় সংঘর্ষের ভিডিও ধারণ করাকালে খুব কাছ থেকে সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কিরকে গুলি করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১১টার দিকে তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাংবাদিক হত্যাকান্ডের দিকে একটু আলোকপাত করা যাক:
১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি নীলফামারীতে নির্বাচনী সহিংসতায় সাপ্তাহিক নীল সাগর পত্রিকার সম্পাদক মো. কামরুজ্জামান প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন। ৮ জুন দায়িত্ব পালনকালে সাতক্ষীরার পত্রদূত পত্রিকার সম্পাদক শ. ম আলাউদ্দীন খুন হন।
১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট যশোরের দৈনিক রানার পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল খুন হন।
২০০০ সালের ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামের দৈনিক বীর দর্পণ পত্রিকার সম্পাদক মীর ইলিয়াস হোসাইনকে গুলি করে হত্যা করে দূর্বৃত্তরা। ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার যশোর প্রতিনিধি শামছুর রহমান কেবল তাঁর কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন।
২০০১ সালের ২১ এপ্রিল রাতে গভীর রাতে মুখোশধারীরা খুলনায় দৈনিক অনির্বাণ বাংলাদেশ পত্রিকার প্রতিনিধি নাহার আলীকে তার শোভনা গ্রামের বাড়ি থেকে অপহরণ করে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।
২০০২ সালের ২ মার্চ দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকার খুলনা প্রতিনিধি হারুনুর রশিদ দায়িত্ব পালন শেষে মোটর সাইকেল যোগে বাড়ি ফেরার পথে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। গুলিতে তিনি নিহত হন এবং তার এক বন্ধু গুরুতর আহত হন। ৫ জুলাই খুলনায় অনির্বাণ বাংলাদেশ পত্রিকার অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদক শুকুর হোসাইনকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৩ আগস্ট শ্রীমঙ্গলের দৈনিক খোলাচিঠি পত্রিকা ও সাপ্তাহিক পূবালী বার্তা পত্রিকার প্রতিনিধি সৈয়দ ফারুক আহমদের রহস্যজনক মৃত্যু হয়।
২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক সংবাদ পত্রিকার খুলনা ব্যুরো প্রধান ও খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সভাপতি মানিক সাহা। ২ মার্চ কেরানীগঞ্জে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন দি নিউএজ পত্রিকার প্রতিনিধি আব্দুল লতিফ পাপ্পু। ২৪ জুন নিজের বাড়িতে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় মৃত্যুবরণ করেন খুলনার দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকার সম্পাদক হুমায়ূন কবির বালু। ২২ আগস্ট সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে দৈনিক আজকের কাগজ এবং দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ পত্রিকার মানিকছড়ি উপজেলা প্রতিনিধি ও মানিকছড়ি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেনকে। ২ অক্টোবর বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক দীপাংকর চক্রবর্তী নিজ বাসায় সন্ত্রাসীদের হতে খুন হন। ২৪ অক্টোবর খুন হন ডেইলি এশিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাদেশ পত্রিকার প্রতিবেদক শহীদ আনোয়ার।
২০০৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার খুলনা প্রতিনিধি শেখ বেলালউদ্দিন আহমেদ সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দেন। ২৯ মে দৈনিক মুক্তকণ্ঠ কুমিল্লা প্রতিনিধি গোলাম মাহফুজ খুন হন। ১৭ নভেম্বর দৈনিক সমকাল পত্রিকার ফরিদপুর ব্যারো প্রতিনিধি গৌতম দাসকে সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো অফিসে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে দূর্বৃত্তরা।
২০০৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর খুন হন জনবাণী পত্রিকার কুলাউড়া প্রতিনিধি বেলাল হোসেন দফাদার।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় খুন হন এনটিভি’র ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক; জুলাই মাসে ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমনা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার নূরুল ইসলাম ওরফে রানা খুন হন। আগস্ট মাসে খুন হন গাজীপুরের সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময় পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারি। ডিসেম্বর মাসে খুন হন দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার রূপগঞ্জ সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি আবুল হাসান আসিফ।
২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল খুন হন সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানী। ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল। ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে খুন হন বরিশালের মূলাদী প্রেসক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী।
২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টনে নিজ বাসায় খুন হন দৈনিক জনতার সহ-সম্পাদক, প্রবীণ সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ এবং তাঁর স্ত্রী রহিমা খাতুন; ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পোর্টকলোনি এলাকায় হত্যাকান্ডের শিকার হন দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার প্রতিবেদক মাহবুব টুটুল। একইদিন উত্তরার বাসিন্দা সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ কুকরাইল এলাকায় গলা কেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকার গোবিন্দগঞ্জ প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি ও মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার। ১৫ জুন দৈনিক গ্রামের কাগজ পত্রিকার যশোর প্রতিনিধি জামাল উদ্দিনকে কাশিপুর এলাকার একটি চা স্টলে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। ১০ জুলাই খুন হন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের দৈনিক বিবিয়ানা পত্রিকার স্টাফ জুনায়েদ আহমেদ। ২৩ অক্টোবর খুন হন দৈনিক নরসিংদীর বাণী পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার তালহাদ আহমেদ কবিদ।
২০১৪ সালের ২৮ মার্চ হত্যার শিকার হন দৈনিক সমাচার পত্রিকার নারায়নগঞ্জ প্রতিনিধি দেলোয়ার হোসেন। ২০১৪ সালের ২১ মে দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার প্রতিনিধি সদরুল আলম নিপুলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নিপুলের বিচ্ছিন্ন দেহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চুয়াডাঙ্গা জেলার একটি রেলওয়ে স্টেশন থেকে উদ্ধার করা হয়।
২০১৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর দৈনিক যুগের আলো পত্রিকার রংপুর প্রতিনিধি মশিউর রহমান উৎস খুনের শিকার হন।
২০১৭ সালের ০৩ ফেব্রুয়ারি দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান দৈনিক সমকাল পত্রিকার সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুল।
২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট আনন্দ টিভির পাবনা প্রতিনিধি সুবর্ণা নদীকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
২০১৯ সালের ২১ মে অনলাইন পোর্টাল প্রিয় ডট কম’র জামালপুর প্রতিনিধি ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন হত্যাকান্ডের শিকার হন।
২০২০ সালের ১১ অক্টোবর কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে দৈনিক বিজয়ের প্রতিনিধি ইলিয়াস হোসেনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
সর্বশেষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির হত্যার শিকার হলেন।
দেশের একজন সাংবাদিক যখন খুন হন তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে তাৎক্ষণিক ঘোষণা দেয়া হয় খুনি বা সন্ত্রাসীরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। কিন্তু কথায় আর কাজের কতটুকু মিল তা সহজেই অনুমেয়। সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না। ঘাতকরা অধরাই থেকে যায়।
বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার নানা ধরণ আছে। কেউ কেউ পেশার কারণে আবার কেউ কেউ পারিবারিক, জমি সংক্রান্তসহ নানা কারণে হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছেন। তবে যে কারণেই সাংবাদিক হত্যার শিকার হন না কেন তাদের বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সাংবাদিক হত্যায় যারা জড়িত, তারা শক্তিশালী এবং তারা নানা কৌশল অবলম্বন করে। এ কারণে অনেক সময় তারা হত্যা করেও পার পেয়ে যায়।
একজন সাংবাদিক যখন হত্যাকান্ডের শিকার হন তখন সরকারী দল হত্যার সুষ্ঠু বিচারের বাণী শোনান আর বিরোধীদল শুনান সাংবাদিক হত্যাকান্ডে সরকারের ব্যর্থতার কাহিনী। এক সময় মৃত্যুবরণকারী সাংবাদিক হয়ে ওঠেন রাজনীতির পণ্য। কিন্তু এরপর ‘যে লাউ সেই কদু’। হত্যার শিকার হওয়া সাংবাদিকের কথা এক সময় সবাই বেমালুম ভুলে যায়। এভ-াবে কতদিন চলবে, সেটাই প্রশ্ন।
লেখক: কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন