শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কোভিশিল্ড করোনা প্রতিরোধক (প্রিভেন্টিভ) তাহলে রোগ নিরাময়কারী টিকা কোথায়?

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

আমরা বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের যে ভ্যাকসিন বা টিকা নিয়েছি বা নিচ্ছি সেটি তো প্রিভেন্টিভ (Preventive)। তাহলে করোনার কিউরেটিভ (Curative) ঔষধ বা ভ্যাকসিন কোনটি? প্রশ্নটি আরো খোলাসা করে বলছি। আমি টিকা নিয়েছি। আমার ভাই ব্রাদার এবং আত্মীয়-স্বজনের অনেকেই এই টিকা নিয়েছেন। কিন্তু আমার অতি ঘনিষ্ট জনদের একজন আছেন যিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি কি টিকা নিতে পারবেন? টিকা নিলে কি করোনা সেরে যাবে? আমি এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খোঁজ খবর নিয়েছি। তাদের একজন সিনিয়র ডাক্তার বললেন, করোনা হওয়া তো পরের কথা। আপনার হাই টেম্পারেচার, অর্থাৎ বেশি জ্বর থাকলেও আপনি করোনার টিকা, অর্থাৎ এ্যাস্ট্রাজেনেকা বা কোভিশিল্ড নিতে পারবেন না। এই কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে যে, করোনা চিকিৎসার ঔষধ এখনও বের হয়নি। তাহলে সেটি বের হবে কবে? যতদিন সেটি বের না হচ্ছে ততদিন কি করোনা চলতেই থাকবে? আমার জানা নাই। যদি কারো জানা থাকে তাহলে লেখা ছাপা হওয়ার পর নীচে যেসব কমেন্ট আসে সেখানে জানালে জনগণ উপকৃত হবে।

আরো পরিষ্কার করছি। পেনিসিলিন একটি ঔষধ। এটি ট্যাবলেট ফরমেও পাওয়া যায়, আর ইনজেকশন হিসাবেও পুশ করা যায়। এটি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে কাজ করে, ভাইরাল ইনফেকশনে কাজ করে না। নিউমোনিয়া, মেনিন্জাইটিস, সিফিলিস, গনোরিয়া প্রভৃতি অসুখে কাজ করে। আরেকটি এন্টিবায়োটিকের নাম করছি। সেটি হলো এজিথ বা এজিথ্রোমাইসিন (Azithromycin)। ৫০০ মিলি গ্রামের এই ট্যাবলেটটি একটি ব্রড্ স্পেকট্রাম এন্টিবায়োটিক (Broad Spectrum Antibiotic) অর্থাৎ অনেক অসুখ বা ইনফেকশনে কাজ দেয়। বাংলাদেশের ডাক্তার সাহেবরা টাইফয়েড্ হলে এজিথ প্রেসক্রাইব করেন। এছাড়াও নাক, গলা, শ্বাসনালী, ফুসফুস প্রভৃতির সংক্রমণেও এই ঔষধটি দেওয়া হয়। করোনাভাইরাসের প্রথম দিকে কিছু রোগীকে এজিথ্রোমাইসিন এবং হাইড্রোক্লোরোকুইন বা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের কম্বিনেশন করে প্রেসক্রাইব করা হয়। কিন্তু আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এই মর্মে সতর্কবার্তা জারি করে যে, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন হৃদস্পন্দনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এরপর চিকিৎসকরা এই ড্রাগটি প্রেসক্রাইব করা থেকে বিরত থাকেন।

আমি বুঝতে পারছি যে বিষয়টি একটু টেকনিক্যাল তথা বিশেষজ্ঞ টাইপ হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও ঐটুকু না বলে উপায় ছিল না। কারণ টিকা দিলেও দেশটি করোনামুক্ত হয়ে গেল- বিষয়টি অত সহজ নয়। ঠিক এই জায়গায় কিছুটা বিভ্রান্তি অথবা স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে আরো একটু বিশদ আলোচনার দরকার।

দুই
গত বছরের ১১ জানুয়ারি চীনে প্রথম করোনা দেখা দেয়। তারপর ১ বছর ২ মাস বা ১৪ মাস পার হয়ে গেল। এরমধ্যে শুধু করোনা নিয়ে নয়, আরো অনেক অসুখ নিয়ে দেশ-বিদেশে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আলোচনার একটি পর্যায়ে একটি পরিভাষা এসেছে। সেটি হলো ‘হার্ড ইমিউনিটি’। এর অর্থ হলো, যখন কোনো জনগোষ্ঠির ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের মধ্যে সেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায় তখন সেই সমগ্র জনগোষ্ঠিই সেই রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে করোনার কথাই বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। দেশকে করোনা মুক্ত করতে হলে ৮০ শতাংশ, কম করে হলেও ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে। ৮০ শতাংশ হল ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ। আর ৭০ শতাংশ হলো ১১ কোটি ৯০ লক্ষ ১২ হাজার। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত দিয়েছে ৯০ লাখ ডোজ টিকা (৭০ লাখ ক্রয় চুক্তির অধীন আর ২০ লাখ বিনা মূল্যে উপহার হিসাবে)। তাদের কাছ থেকে পাওনা এখনও ২ কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা। এই ৩ কোটি ২০ লাখ ডোজ কোভিশিল্ড টিকা ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষকে কভার করবে। সেটি করতে কম করে হলেও জুলাই মাস পার হয়ে যাবে। ৭০ শতাংশ মানুষ ধরলেও ঐ ৩ কোটি ২০ লাখ ডোজের বাইরে থেকে যাচ্ছে ১০ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ। তাদের টিকা দিতে গেলে আরো ২০ কোটি ৭০ লাখ ডোজ টিকার (যদি এ্যাস্ট্রাজেনেকা বা কোভিশিল্ডের মত ২ ডোজের টিকা হয়) প্রয়োজন। এখন দৈনিক গড়ে ২ থেকে আড়াই লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। শুক্রবারও যদি টিকা দেওয়া হয় তাহলে মাসে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে। তাহলে কোভিশিল্ডের বাইরে যে ১০ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ থেকে যাচ্ছে তাদের টিকা দিতে লাগবে ১৭ মাস সময়। সেটিও প্রতি মাসে এক ডোজ। কিন্তু ফুল কোর্স বা ফুল ডোজ হলো ২ টি- সেটিও ৬০ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ। আর এই ৩ কোটি ২০ লাখের ফুল ডোজ (দুইটি ডোজ) দিতে সময় লাগবে আরো এক বছর। তাহলে ২০২১ সাল তো দূরের কথা, ২০২২ সালেও বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে না। তাহলে বাংলাদেশে হার্ড ইমিউনিটি আনতে হলে ২০২২ সালের মাঝামাঝি বা ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকের আগে কোনো সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে না।

তিন
আমেরিকার জনসংখ্যা ৩৩ কোটি। অথচ তারা দেড় মাসে ৬ কোটি মানুষকে ইতোমধ্যেই টিকা দিয়ে ফেলেছে। জুন মাসের মধ্যে তারা সমগ্র জনগোষ্ঠিকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে। সেটি করতে আমাদের যদি আরো পৌনে দুই বছর অপেক্ষা করতে হয় তাহলে দুর্ভোগ আরো বাড়বে। আরো প্রাণহানি ঘটবে। এই অবস্থায় আমাদের করণীয় কি?

এখানে এসে পড়ে টিকার অব্যাহত সরবরাহের কথা। ভারতের ২০ লাখ ডোজ উপহার বাদ দিলে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১ কোটি ডোজ টিকা আসার কথা। দ্বিতীয় চালানে ৫০ লাখের জায়গায় ২০ লাখ ডোজ এসেছে। অর্থাৎ ৩০ লাখ ডোজ কম এসেছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে হলে মার্চ মাসে ৮০ লাখ ডোজ আসার কথা। দেখা যাক, ৮০ লাখ ডোজ আসে কিনা। ইতোমধ্যেই সেরামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মি. পুনেওয়ালা জানিয়েছেন, কোভিশিল্ড সরবরাহের ব্যাপারে সেরাম যেন ভারতের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেয়। একই বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশে কর্মরত ভারতের হাইকমিশনার মি. বিক্রম কুমারা দোরাইস্বামী। এসব কথার পরেই দ্বিতীয় চালানে ৩০ লাখ ডোজ কম এল। দেখা যাক, মার্চে ৮০ লাখ ডোজ আসে কিনা।

এরমধ্যে আরেকটি টিকার নাম বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এটির নাম, জনসন এন্ড জনসন। এর উৎপাদক কোম্পানীর নাম জ্যানসেন। ডাচ্ (হল্যান্ড) মার্কিন যৌথ মালিকানাধীন এই কোম্পানিটি। জনসনের ভ্যাকসিন সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এটি এক ডোজের টিকা। এক ডোজ নিলেই কাজ হবে। দুই ডোজ লাগবে না। মার্কিন ফাইজার বায়োএনটেক টিকার জন্য হিমাঙ্কের ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার (মাইনাস ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড) ফ্রিজারের প্রয়োজন হয়। অপর মার্কিন টিকা ‘মর্ডানার’ জন্যও অত্যন্ত ঠান্ডা ফ্রিজারের প্রয়োজন হয়। এত কম তাপমাত্রায় রাখার মত ফ্রিজার বা কোল্ড স্টোরেজ বাংলাদেশে নাই। কিন্তু জনসনের টিকা শূন্য থেকে হিমাঙ্কের ৪ ডিগ্রী নিচের, অর্থাৎ মাইনাস ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসের রেফ্রিজারেটরে রাখা যায়।

জনসনের টিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আশা জাগানিয়া দিক এই যে, খুব ক্ষতিকর করোনাভাইরাসকে এই টিকা ঠেকাতে সক্ষম। খুব খারাপ ধরণের স্ট্রেইনকেও এটি মোকাবেলা করতে সক্ষম। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, করোনাভাইরাস ক্ষণে ক্ষণে মিউটেশনের মাধ্যমে রূপ বদলায়। এইরূপ বদলানো বা নতুন অবয়বের ভাইরাসকে বলা হয় স্ট্রেইন বা ভ্যারিয়ান্ট। আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলে থার্ড ট্রায়াল রানে এই ফলাফল পাওয়া গেছে। এই টিকার গুরুতর কোনো সাইড এফেক্ট বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি।

চার
যে প্রশ্ন দিয়ে আজকের এই কলামের অবতারণা করেছি, সেই প্রশ্নের উত্তর জনসনের টিকায় পাওয়া যায়। জনসনের মালিক কোম্পানী জ্যানসেন দাবী করেছে যে, গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রেও এ টিকা উচ্চমাত্রায় কার্যকর। আমেরিকা, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় চালানো ট্রায়ালে দেখা গেছে যে, করোনার তীব্র সংক্রমণে এই টিকা উচ্চ মাত্রায় প্রয়োগে একই রকম কার্যকর। এমনকি মধ্যম মাত্রার অসুস্থতাতেও এটি কার্যকর। জনসনের এই সফলতার খবর প্রচারিত হওয়ার পর ফাইজার বায়োএনটেকও দাবি করেছে যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু প্রতিরোধে তাদের টিকা ৭২ শতাংশ কার্যকর।

করোনা আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে জনসন এন্ড জনসন এবং ফাইজার বায়োএনটেক যে সফলতার দাবী করেছে এ্যাস্ট্রাজেনেকা বা কোভিশিল্ডের তরফ থেকে সেই রকম সফলতার এখনো দাবী করা হয়নি। পক্ষান্তরে কোভিশিল্ড টিকা দেওয়ার পর বাংলাদেশে তিন ব্যক্তি কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন। এরা হলেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মহসিন, মিডফোর্ড হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার সাজ্জাদ হোসেন এবং চলচিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের পরিচালক গোলাম কিবরিয়া। এরা তিন জন টিকা নেওয়ার পর যথাক্রমে ৬ দিন, ১৫ দিন এবং ৬ দিন পর করোনায় আক্রান্ত হন।

শেষ করার আগে একটা কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে ৭ এপ্রিল থেকে। কিন্তু সরকারি তথ্য মোতাবেক তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কমতে শুরু করে। শনিবার এই লেখা লিখছি। দেখলাম, সংক্রমণ ৪০৭ এবং মৃত্যু ৫। এটা আল্লাহর অপার রহমত। আল্লাহ গরীব মানুষ, বস্তিবাসী, দিনমজুর, রিক্সাওয়ালা, মিস্ত্রি- এদেরকে করোনা থেকে রক্ষা করেছেন। এদের মাঝে করোনার প্রকোপ তেমন একটা নাই। আল্লাহই তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্ট্রং করেছেন। তাই তাদের করোনা হয় না। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সকলকে টিকা নিতে হবে।
journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Md Golam Azom ২ মার্চ, ২০২১, ২:১৫ এএম says : 0
লেখককে ধন্যবাদ, গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় তুলে আনার জন্য।
Total Reply(0)
মোঃ তোফায়েল হোসেন ২ মার্চ, ২০২১, ২:১৫ এএম says : 0
করোনা নিরাময়ের ওষুধ আর আবিষ্কার করতে পারবো না।
Total Reply(0)
দু খী জীবন ২ মার্চ, ২০২১, ২:১৬ এএম says : 0
এখন বিশ্বব্যাপী চলছে ধনী দেশগুলোর করোনা টিকার রমরমা ব্যবসা--এছাড়া আর কিছু না।
Total Reply(0)
তোফাজ্জল হোসেন ২ মার্চ, ২০২১, ২:১৬ এএম says : 0
করোনা নিরাময়কারী ওষুধ নিয়ে বিজ্ঞানীদের কাজ করা উচিত।
Total Reply(0)
নীল প্রজাপতি ২ মার্চ, ২০২১, ২:১৭ এএম says : 0
ধন্যবাদ, বিষয়টি নিয়ে আসলেই তো ভাবা হয়নি।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন