শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

গোপনীয়তায় পাচারকারীদের পছন্দ সুইস ব্যাংকগুলো

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০২১, ১২:০০ এএম

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) ২০২০ সালের জুন মাসে যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে সেখানকার ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের কতজনের কত টাকা রাখা হয়েছে, স¤প্রতি তার তালিকা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশের হাইকোর্ট। সেইসব পাচার হওয়ার টাকা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটাও জানতে চাওয়া হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, একসময় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো পাচারকৃত অর্থের ব্যাংকিংয়ের জন্য জনপ্রিয় থাকলেও এখন কেইম্যান আইল্যান্ড, পানামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড ও বাহামার ব্যাংকিং ব্যবস্থাও ধনীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ থেকে কারা স্ইুজারল্যান্ডের ব্যাংকে টাকা পাঠায়?
বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, সুইজারল্যান্ডের আইনি ব্যবস্থার কারণে সেদেশের ব্যাংকগুলোয় কাদের কী পরিমাণ অর্থ রয়েছে, এমন তথ্য বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তবে তারা ধারণা করেন, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অবৈধ পথে অর্জিত কালো টাকার মালিকরাই মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশের বাইরে টাকা নিয়ে গিয়ে সুইস ব্যাংকে জমা করছেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, ‘যে অর্থ বিদেশে যায়, তার বেশিরভাগই অপ্রদর্শিত বা দুর্নীতির অর্থ। আরেকভাবে যায়, সেটা হচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষ করে আমদানি রফতানির মাধ্যমে। এসব উপায়ে যে টাকা চলে গেছে, সেটা কিন্তু সুইস ব্যাংক এবং গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির রিপোর্টেও দেখা যায়’।

‘আসলে অনেকে বৈধভাবে অর্জন করার পরেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেশে টাকা রাখতে নিরাপদ বোধ করেন না। আবার সুইস ব্যাংকে যারা টাকা রাখেন, তাদের অনেকের টাকা অনেকাংশ বা কিছু অংশ থাকে অবৈধ উপায়ে অর্জিত। এগুলোকে পুরোপুরি সাদা টাকা বলা যাবে না। তারা এসব টাকা হয়তো উৎস জানিয়ে বৈধভাবে ব্যাংকে রাখতে পারবেন না, আবার কোন উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে না’।

‘অনেক সময় তাদের আশঙ্কা থাকে যে, ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তাদের এসব অর্থ ঝুঁকিতে পড়ে যাবে, যেমনটা আমরা ওয়ান ইলেভেনের সময় দেখেছি। ফলে এসব টাকা নিয়ে যাতে কোনরকম জবাবদিহিতার মুখে যাতে না পড়তে হয়, সেজন্য তারা টাকাগুলো বাইরে নিয়ে যান। আর গোপনীয়তা রক্ষা করায় এজন্য তাদের অন্যতম পছন্দের একটি দেশ হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো’ -বলছেন ফাহমিদা খাতুন।
ফাহমিদা খাতুন বলছেন, সুইস ব্যাংকের কাজই হচ্ছে সারা পৃথিবীতে যারা এভাবে বৈধ-অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেছেন কিন্তু নিজের দেশে বা অন্য দেশের ব্যাংকে রাখতে নিরাপদ বোধ করেন না বা রাখতে পারছেন না, সেই অর্থ নিরাপদে গচ্ছিত রাখা।

‘তারা উৎস জানতে চায় না, অর্থ বৈধ নাকি অবৈধ পথে উপার্জিত সেটা জানতে চায় না, গ্রাহকের পুরোপুরি গোপনীয়তা রক্ষা করে, অন্য কোন দেশের কাছে গ্রাহকদের তথ্য দেয় না, দেশটিতেও স্থিতিশীলতা রয়েছে, এসব কারণেই তারা সারা বিশ্বের টাকার মালিকদের বিশ্বস্ততা বা নির্ভরতা অর্জন করেছে। ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত দেশগুলোর বাসিন্দাদেরও কর ফাঁকি বা অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ এসব ব্যাংকে তারা জমা রাখেন’ -তিনি বলছেন।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ রাখার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা এবং বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ না থাকায় দেশের বাইরে, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকগুলোতে গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে রাখা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকার সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলছেন, গোপনীয়তা রক্ষা করাই সুইস ব্যাংকগুলোর মতো ব্যাংকের মূল চালিকাশক্তি।
‘আমার জানা মতে অনেক দেশ সুইস ব্যাংকের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা সফল হয়নি। সেখানে বেশিরভাগ টাকাই কালো টাকা, কর ফাঁকি দেয়া, অবৈধভাবে আয় করা, সেসব টাকা ওই দেশে চলে যায়। তবে বিভিন্ন দেশ কড়াকড়ি পদক্ষেপ নেয়ায় এখন সে প্রবণতা অনেক কমে এসেছে’-তিনি বলছেন। এসব টাকার বিষয়ে তথ্য জানতে এর আগে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হয়েছে।

বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে তাগাদা দেয়া হয়েছে যেন তারা ভারত বা যুক্তরাজ্যের মতো সুইস ব্যাংকের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের একটি সমঝোতা স্মারক করে।
দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গত বছর বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা কাদির কল্লোলকে বলেছিলেন, যদিও সংশ্লিষ্ট আইনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্য কারও বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে তাদের দেখার ক্ষমতা নাই, এরপরও তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেরকম কোন সমঝোতা এখনো সুইস ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হয়নি।

ব্যাংকার সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলছেন, ‘চাইলেই বাংলাদেশের পক্ষে এরকম অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। প্রথমত দুই দেশের মধ্যে চুক্তি থাকতে হবে। যেমন পানামা কেলেঙ্কারির কথা শোনার পরে কয়টা দেশ সেসব টাকা ফিরিয়ে আনতে পেরেছে? সেসব ব্যাংক তো তার গ্রাহকদের সম্পর্কে তথ্য দিতে বাধ্য নয়। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও এখনো এসব দেশ থেকে সরকার তথ্য আনতে পারেনি। এটা কঠিন একটা কাজ, এটা এতো সহজে সম্ভব হবে না’।

যতক্ষণ এসব ব্যাংক সহযোগিতা না করছে, ততক্ষণ এই টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও কঠিন বলে তিনি বলছেন। তবে বাংলাদেশি টাকার মালিকদের অনেকে এখন সুইস ব্যাংকে টাকা না জমিয়ে বরং মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডার মতো দেশগুলোয় বিনিয়োগের বদলে নাগরিকত্ব সুবিধায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তাতে একদিকে তারা যেমন আরেকটি দেশের নাগরিকত্ব পাচ্ছেন, পাশাপাশি সেসব দেশে বাড়ি বা ব্যবসাবাণিজ্যে বিনিয়োগ করছেন। সূত্র : বিবিসি বাংলা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন