ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক মামলায় গ্রেফতার হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কারা হেফাজতে মৃত্যুবরণ করার পর এই আইনের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পাশপাশি দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরাও লেখক মুশতাকের মৃত্যু এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘের মানবার্ধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেট লেখক মুশতাকের মৃত্যুর ঘটনায় দ্রুত, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করার পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পুনর্বিবেচনার আহবান জানিয়েছেন। সেইসাথে এই আইনে আটক সকলের দ্রুত মুক্তিরও দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘ। দেশের আভ্যন্তরীণ একটি আইন নিয়ে বিদেশিদের মন্তব্য, আপত্তি এবং সংশোধন ও বাতিলের দাবি সরকারের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। তবে ২০১৮ সালে গৃহিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি গেজেটেড হওয়ার আগেই দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন এবং বিশেষত সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকর্মীদের পক্ষ থেকে এই আইনের নিবর্তনমূলক ধারাগুলোর বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি তোলা হয়েছিল। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা, বিশেষত সরকারের সমালোচকদের টুটি চেপে ধরতে এই আইনে কিছু নিবর্তনমূলক ধারা সংযুক্ত করা হয়েছিল। আইনের এসব ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা সত্ত্বেও সে সব ধারা রেখেই আইনটি পাশ হওয়ার পর থেকেই এর অপপ্রয়োগ চলছে। লেখক মুশতাকের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার, জামিন অগ্রাহ্য করা এবং কারাগারে মৃত্যুর ঘটনা তার সর্বশেষ উদাহরণ।
গণমাধ্যম তথা জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত রাখা যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি। গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধের দাবিকে সামনে রেখেই লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। দেশের মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই সংবিধান এবং আইনগত বিধিবিধান প্রণীত ও বলবৎ করা হয়। তবে ঔপনিবেশিক আমল থেকেই এমন কিছু আইন রয়েছে যেখানে শাসক শ্রেণীর স্বার্থে পুলিশকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। সে সব আইনে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই স্রেফ সন্দেহজনকভাবে যে কাউকে আটক বা গ্রেফতার করতে পারে পুলিশ। দেশের নাগরিক সমাজ এসব আইনের সংশোধন ও অপপ্রয়োগ বন্ধের ব্যাপারে সব সময়ই কথা বলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের জন্য সাম্প্রতিক বাস্তবতা। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের নাগরিক সমাজের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিনত হওয়ায় এ বিষয়ে নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিচারিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে সরকারের সমালোচক, রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশকারী দমনে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিস্তারের সাথে সাথে ই-কমার্স, ই-বিজনেস, ই-ব্যাংকিং যেমন বেড়ে চলেছে সেই সাথে বেড়ে চলেছে সাইবার ক্রাইমের সংখ্যা এবং ঝুঁকিও। এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মূলত সরকারি দলের ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিরা গণমাধ্যমে সরকার বিরোধী বক্তব্য প্রদানকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দিয়ে বিনাবিচারে আটক রাখার সুযোগ নিচ্ছে। কোনো সভ্য দেশে এ ধরনের আইন থাকতে পারে না। মূলত সংবাদপত্রের সম্পাদক-প্রকাশক, সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক-কলামিস্টরা এই আইনের অপপ্রয়োগের শিকার হচ্ছেন। শুরুতে যখন এই আইন নিয়ে সম্পাদক পরিষদসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সরকারের সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনায় বসেছিলেন তখন আইনমন্ত্রীকে আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের ব্যাপারে সহমত পোষণ করতে দেখা গেলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। এখন লেখক মুশতাকের মৃত্যুর পর দেশে ব্যাপক গণবিক্ষোভ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দাবির মুখে আইনটির পরিবর্তনে সরকারের যে ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে তা আশাব্যঞ্জক। আইনের বিতর্কিত ও নির্বতনমূলক ধারাগুলো বাতিল করার পাশাপাশি তদন্তের আগে কাউকে গ্রেফতার না করার বিধান করার কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী। ডিজিটাল নিরাপত্তা এখন একটি বৈশ্বিক ব্যাপার। সারাবিশ্বেই এখন সাইবার ক্রাইম ও ডিজিটাল নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। উন্নত বিশ্বের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে এসব সমস্যা মোকাবেলা করছে, আমাদেরও সেভাবেই করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার হরণের ন্যূনতম আশঙ্কা থাকে এমন পথ চিরতরে বন্ধ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন