শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করা কখনোই মঙ্গলজনক নয়

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২১, ১২:০৫ এএম

ক্ষমতা যার আছে সে যদি তা অপব্যবহার করে, তবে সাধারণ মানুষের কেন অসাধারণ মানুষেরও কিছু করার থাকে না। কিছু বলতে গেলেই তাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দমনের শিকার হতে হয়। এ ধরনের ঘটনা সাধারণত সামন্ততান্ত্রিক যুগে কিংবা স্বৈরশাসকদের আমলে ঘটতে দেখা যায়। যেখানে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। সচেতন ও সাধারণ মানুষের ‘ফ্রিডম অফ স্পীচ’ বাধাগ্রস্ত হয়, গণ-এর ইচ্ছা নয়, ব্যক্তি-ইচ্ছাই সেখানে শেষ কথা। কেউ এর ব্যতিক্রম করলেই, তার উপর খড়গ নেমে আসে। তাকে শায়েস্তা করার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়। ২০১৮ সালে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে এমনই এক পদক্ষেপ নিয়েছে। আইনটির শুরু থেকেই রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সচেতন মহল এর কয়েকটি ধারার তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। ধারাগুলো বাদ দেয়ার দাবী জানিয়েছে তারা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এ ধারাগুলো স্বাধীনমত ও বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী। এতে কারোই স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার থাকবে না। সরকার তার বিরোধীমত ও বাকস্বাধীনতাকে দমন করার জন্য এ আইন করেছে। তাদের এ কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। আইনটি প্রণয়নের পর থেকে সাংবাদিক, পেশাজীবী, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের উপর ব্যাপক হারে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকার, পুলিশসহ যে কেউ এই আইনের অপপ্রয়োগ করছে। সরকারের মতের সাথে না মিললেই অপপ্রচার ও রাষ্ট্রের মর্যাদাহানির অভিযোগ এনে মামলা এবং গ্রেফতার করে হাজতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দিনের পর দিন আটকে রাখা হচ্ছে। জামিন চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। গত সপ্তাহে লেখক মুশতাক আহমেদ জেলে থেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাকে প্রায় বছর খানেক আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে জেলে নেয়া হয়। বেশ কয়েকবার জামিন চেয়েও পাননি। অবশেষে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার চিরস্থায়ী জামিন হয়েছে। দেশে ‘ফ্রিডম অফ স্পীচ’ কতটা রয়েছে, তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। এখানে ক্ষমতাসীন দলের কথা বলার অবাধ সুযোগ থাকলেও তার বিরোধীমতের সে সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কথা বাদ দিলেও টেলিভিশন চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সচেতন মহলের বাকস্বাধীনতায় যে এক ধরনের বাধা রয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সরকার এই বাধা দিয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে। এ আইন এতটাই ভয়ংকর যে, কারো কথা বা লেখায় সরকারের পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষা নাই। মামলা এবং গ্রেফতার অনিবার্য। ফলে সংবাদ ও গণমাধ্যম নিজেরাই সেল্ফ সেন্সরশিপের আওতায় চলে গেছে। উচিৎ কথা বলা থেকে বিরত থাকছে। সরকারের ভুল-ত্রুটির সমালোচনা করতে গেলে আইনের খড়গ নেমে আসছে। সরকার চায় সংবাদ ও গণমাধ্যম তার উন্নয়নের ফিরিস্তি ও গুণগান গাক। এর বাইরে যাওয়া যাবে না। তারপরও কোনো ব্যক্তি বা সংবাদ মাধ্যম সাহস দেখিয়ে যখনই কিছু বলেছে, তাকে সঙ্গে সঙ্গে বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এদের মতামত সরকারের পছন্দ হয়নি বলে মামলা ও গ্রেফতার হয়ে তাদেরকে কারাগারে যেতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যাভিত্তিক সংস্থা আর্টিক্যাল ১৯-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে এই আইনের অধীনে মোট ১৯৮টি মামলা করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৪৭৫ জনকে। এর মধ্যে ৪১টি মামলার আসামি করা হয়েছে ৭৫ জন পেশাদার সাংবাদিককে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব মামলায় অভিযুক্তদের সকলের মত যে, যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য তা আমরা বলছি না। আবার সকলের ব্যাক্তিগত অবস্থান ও গুরুত্বও যে সমান, তাও নয়। তবে যেসব সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী মামলা ও গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন, তাদের একটা অবস্থান রয়েছে। তারা নিজস্ব বোধ-বুদ্ধি ও সচেতন চিন্তা থেকেই মতপ্রকাশ করেছেন। তাদের এই মতামত সরকারের পছন্দ হয়নি বলেই জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। এজন্য দেশের আইনজ্ঞ, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সচেতন মহল এবং জাতিসংঘ এবং বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা বাতিল ও সংশোধন করার জন্য বারবার বলেছেন। মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এখন পুরো আইনটিই বাতিল করার দাবী তোলা হয়েছে।

দুই.
বাকস্বাধীনতার বিষয়টি সাধারণত নির্ভর করে রাজনৈতিক দল ও তার নেতৃবৃন্দ, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত প্রিণ্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সচেতন নাগরিক মহলের উপর। তাদের দায়িত্ব জনসাধারণের জন্য উচিত-অনুচিত এবং কল্যাণ-অকল্যাণমূলক ঘটনা এবং কথাবার্তা সুবিবেচনাপ্রসূত অথচ অবারিতভাবে প্রকাশ করা। এ দায়িত্ব পালনে তারা কতটা স্বাধীন বা তাদের করতে দেয়া হচ্ছে, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ ফ্রিডম অফ স্পীচ বা ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৮ সালে গৃহীত ‘ইউনিভার্সেল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস’-এর আর্টিক্যাল ১৯-এ বলা হয়েছে, কোন ধরনের বাধা ছাড়া প্রত্যেকেরই মতামত প্রকাশ ও ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। এর মধ্যে সব ধরনের তথ্য খোঁজা, গ্রহণ করা এবং তা বলা, লেখা, শিল্পকলাসহ যত ধরনের প্রকাশ মাধ্যম রয়েছে, তার পছন্দমতো মাধ্যমে প্রকাশ করা। তবে এ স্বাধীনতা সতর্কতার সাথে বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে চর্চা করতে হবে, যাতে অন্যের অধিকার ও সম্মানহানি এবং জাতীয় ও জনসাধারণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক জন মিল্টনের মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আকুল হয়ে বলেছিলেন, ‘গিভ মি দ্য লিবার্টি টু নো, টু আটার, অ্যান্ড টু আরগু ফ্রিলি অ্যাকোর্ডিং টু কনসায়েন্স, এভাব অল লিবার্টিস।’ তিনি বাকস্বাধীনতার নামে যা খুশি তা বলার অধিকার চাননি। যা সত্য এবং উচিৎ তাই বলতে দেয়ার দাবী করেছেন। এক্ষেত্রে কে সরকারের সমালোচনা করছে, তার অবস্থান কি এবং তার কথার গুরুত্ব কতটা তা বিবেচনা করতে হয়। এসব বিবেচনায় যদি তার মতামত যৌক্তিক হয় এবং সরকারের বিপক্ষে যায়, তা গ্রহণ করা বা তার পাল্টা যুক্তি দিয়ে খন্ডন করাই হচ্ছে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশকে নিশ্চিত করা। প্রখ্যাত ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ার বাকস্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘তোমার মতের সাথে আমি একমত না হলেও, তোমার মত প্রতিষ্ঠায় আমি জীবন দিতে পারি।’ তার এ কথা সার্বজনীন হলেও, সবাই যে মতামত প্রকাশ করে, তা নয়। প্রকাশ করে সচেতন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সাথে জড়িতদের কেউ কেউ, যাদের মতামতের গুরুত্ব রয়েছে এবং সার্বজনীন। তারা নিশ্চয়ই সরকারের ভুল-ত্রুটি বা অন্যায্য আচরণের বিরোধিতা বিদ্বেষ থেকে করেন না। সরকার ও দেশের মঙ্গলের জন্যই করেন। এতে সরকার ক্ষুদ্ধ না হয়ে বরং খুশি হয়ে তা সংশোধন করতে পারে। মতামত খন্ডণে পাল্টা যুক্তি দিতে পারে। দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে সরকার তার বিপক্ষে যায় এমন মত সহ্য করতে পারছে না। তার আচরণ এমন, যে কথা তার জন্য সুবিধাজনক সেটাই সঠিক, বিরুদ্ধে গেলেই বেঠিক। অথচ গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার নিউক্লিয়াসই হচ্ছে, অন্যের মতামত পছন্দ না হলেও তার গুরুত্ব দেয়া। নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, তুমি যদি বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করো, তবে তোমাকে ধরেই নিতে হবে তোমার বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির বাকস্বাধীনতাকে পছন্দ করতে হবে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্ট্যালিন ও হিটলারের মতো একনায়করাও তাদের বিরুদ্ধবাদীদের মতামত পছন্দ করতেন। আমাদের দেশের মতো গণতন্ত্রকামী দেশে যেখানে গণতন্ত্র পুরোপুরি ভিত্তি লাভ করেনি, সেখানে গণতন্ত্র অনেকটা তৈলাক্ত বাঁশে বানরের উঠানামার মতো অবস্থায় রয়েছে। গণতন্ত্রকে একেক দল বা গোষ্ঠী তাদের সুবিধা মতো সংজ্ঞায়িত করেছে এবং করে চলেছে। মুখে মুখে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশ এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতের উদাহরণও প্রায়ই দেয়া হয়। গণতন্ত্রের এসব উদাহরণ দেখিয়ে জনসাধারণের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি করলেও কার্যক্ষেত্রে এর চর্চা এবং প্রতিফলন দেখা যায় না বললেই চলে। এখন তো বলা যায়, গণতন্ত্রের মোড়কে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অথচ গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার জন্য এদেশের মানুষ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেই বারবার আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। পরিতাপের বিষয়, যাদের নেতৃত্বে জনগণ সংগ্রাম করেছে, ক্ষমতায় আসার পর তাদের দ্বারাই গণতন্ত্রের সুরক্ষা ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। জনসাধারণের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। অনেককে বলতে শোনা যায়, ব্রিটিশ, আমেরিকার গণতন্ত্র ভিত্তি লাভ করতে শত বছর লেগেছে। তাদের দেড়-দুইশ’ বছরের গণতন্ত্র। আর আমাদের যাত্রা তো সবে শুরু। তাদের এসব কথার মধ্যে যে এক ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ও শাসন-শোষনের মনোভাব রয়েছে, তা সচেতন মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাদের এ কথার অন্তর্গত অর্থ হচ্ছে, শতবর্ষ না পেরুলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, কাজেই জনসাধারণকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। এটা গণতন্ত্রকামী মানুষের সাথে এক ধরনের প্রবঞ্চণা ছাড়া কিছুই নয়। যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে দেশে গণতন্ত্র নেই, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, সেই তারা যখন ক্ষমতায় গিয়ে একই কাজ করে, তখন দেশের মানুষের আশ্চর্য হওয়া ও আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। দেশের রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যদি এ ধরনের মনোভাব থাকে, তবে শত বছর কেন, হাজার বছরেও গণতন্ত্র ভিত্তি লাভ করবে না। মানুষের বাকস্বাধীনতাও নিশ্চিত হবে না। যারা উচিত কথা বলতে যাবেন, তাদেরকে পদে পদে হুমকি-ধমকির মধ্যেই থাকতে হবে।

তিন.
আমাদের দেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটুকু রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ এখন এক অস্বাভাবিক ও বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলছে। প্রধান বিরোধীদল কর্মসূচি পালন করতে গেলেই ক্ষমতাসীন দল পদে পদে বাধা দিচ্ছে। সরকারের এ ধরনের মানসিকতা শুধু বিরোধী রাজনীতিকে দমন করাই নয়, সাধারণ মানুষের মতামত প্রকাশের পথকেও রুদ্ধ করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই পরিস্থিতিকে পলিটিক্যাল অ্যানহিলেশন বা নিশ্চি‎হ্নকরণ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। তারা বলছেন, ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদলের রাজনীতিকে যেভাবে সংকুচিত করে ফেলেছে তা গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার শামিল। বিরোধী রাজনীতি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যদি অবারিত না থাকে, তবে দেশে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার উদ্ভব হওয়ার শঙ্কা থাকে। ফলে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির স্বার্থেই কার্যকর বিরোধী দলের প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ক্ষমতাসীন দল আর সরকারের মধ্যে এখন পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাদের আশঙ্কা, যদি কখনো সরকারকে বিদায় নিতে হয়, তখন সরকারের সাথে তার দলেরও পতন অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। ক্ষমতাসীন দল এ দিকটি বিবেচনায় নিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। বরং ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধী দল এবং মতকে দমনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা আত্মবিধ্বংসী প্রবণতা। এ প্রবণতা সরকারের জন্য তো বটেই কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়। বাংলাদেশে যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত অবস্থায় রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বরাবরই বলে আসছে। সংস্থাটি তার এক প্রতিবেদনে বলছে, ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নেতিবাচক দিকে ধাবিত। সঙ্কুচিত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। অব্যাহত রয়েছে গণমাধ্যম সম্পাদক আর নির্বাহীদের হয়রানি। তাদের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছে সরকার।’ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এ প্রতিবেদন সরকারকে পছন্দ করতে দেখা যায় না। সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই তা অস্বীকার করে সংগঠনটিকে বিরোধী দলের মুখপাত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বলা বাহুল্য, সরকারের দ্বারা যখন বিশ্বখ্যাত সংগঠন তোপের মুখে পড়ে, তখন সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম সরকারের চাপের মধ্যে রয়েছে, এ কথা দেশীয় কোন মানবাধিকার সংগঠন বা ব্যক্তি বললে, তার পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। যারাই বলতে গেছে, তাদের কী অবস্থা হয়েছে তা এ সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম বন্ধ ও পরিণতি ভোগ করার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছে। বলা প্রয়োজন, গণমাধ্যম অত্যন্ত সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল মাধ্যম। এখানে সচেতন, দক্ষ ও পেশাদার ব্যক্তিরাই কাজ করেন। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, সংবাদ মাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। তাদেরও ভুল হতে পারে। এ ভুলের প্রতিকারের নানা নিয়মকানুন ও বিধিব্যবস্থা রয়েছে। তার অর্থ এই নয়, ভুলের জন্য মাধ্যমটিকেই বন্ধ করে দিতে হবে বা মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলতে হবে।

চার.
গণতন্ত্রের স্পিরিটটাই এমন যে, জরুরি অবস্থার মধ্যেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করা বা দমানো যায় না। কোন না কোনভাবে তা প্রকাশিত হবেই। এ প্রকাশকে যারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে দমাতে চায়, তা কোনক্রমেই তাদের অনুকূলে যায় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, ফ্রিডম অফ স্পীচ গণতন্ত্রের ‘সেফটি ভাল্ভ’ বা নিরাপদ কপাট হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব ব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড গর্ভনেন্স ইন্ডিকেটরস’ প্রজেক্টের আওতায় কিছুকাল আগে বিশ্বের ২০০ দেশের উপর করা জরিপে দেখা গেছে, যেসব দেশে বাকস্বাধীনতা এবং জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া রয়েছে, সেসব দেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র সংহত হয়েছে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে আসা নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সচেতন মহল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে যেটুকু গণতন্ত্র রয়েছে, সেটুকুও বিলুপ্ত হতে পারে। অগণতান্ত্রিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ক্ষমতাসীন দল এ ব্যাপারে সচেতন হবে এবং গণতান্ত্রিক ধারা ও বাকস্বাধীনতার সংকোচন নীতি থেকে সরে এসে শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবে। এ সংক্রান্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সকল কালা-কানুন সংশোধন অথবা বাতিল করতে হবে।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মোঃ দেলোয়ার হোসেন বাবু ৫ মার্চ, ২০২১, ২:৩৮ এএম says : 0
মত প্রকাশ করার নামে যদি হয় মিথ্যা আর গুজবের কল্পকাহিনি, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র,দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা তাহলে কি তা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন থাকা বাঞ্ছনীয় নয়? দেশের মানুষ এই আইনের অপপ্রয়োগ চাই না।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন