মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে অসংখ্য নেয়ামতরাজি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।প্রতিটি মানুষের শরীর আল্লাহর দেওয়া অগণিত নিয়ামতে ভরপুর। যেমন: চোখ, নাক, জিহ্বা, হাত, পা, মাথা, ব্রেন, কান ইত্যাদি। কুরআন কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: তোমরা আল্লাহর নিআমত গণনা করে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবেনা। (সূরা ইবরাহীম : ৩৪)। এই অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে জিহ্বা হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া উল্লেখযোগ্য এবং একটি শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। কেননা, জিহ্বা বা বাকশক্তি আল্লাহ তাআলার বড় নিআমত ও মহা-দান। বান্দার বহুবিধ কল্যাণ এতে নিহিত। বহুমুখী প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে তিনি এ নিআমত বান্দাকে দান করেছেন।অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে এসব প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব নয়। যবানের নিআমত থেকে বঞ্চিত হলে অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। কোনো কিছুই যবানের বিকল্প হতে পারে না। মানুষ এই জিহ্বা দ্বারা মনের ভাব, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, আনন্দ-উল্লাস প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বলতে গেলে যবান সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মুখপাত্র। বোবার মনের কত দুঃখ-কষ্ট, কত আনন্দ-বেদনা, কিন্তু কাউকে জানাতে পারে না, জীবনের প্রতিটি ধাপে যার বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যে বাকশক্তি হারিয়েছে সে-ই উপলদ্ধি করতে পারে- যবান কত বড় নিআমত!
আবার এই যবান মানুষের জন্য জান্নাত বা জাহান্নাম। অর্থাৎ এই যবানের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত হয়,আবার এর অপব্যবহার করার কারণে মানুষ জাহান্নামের উপযোগী হয়ে যায়।এরকমই যবান মানুষকে কখনো সম্মানের পাত্র বানায়, আবার কখনো লাঞ্ছনার শিকার হওয়ায়। অপরপক্ষকে মিথ্যা, গীবত, অপবাদ, গালি-গালাজ, কর্কশ ভাষা; মানুষকে আল্লাহর অসন্তোষ, ক্রোধ ও জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করে। এজন্য শরীয়তে যবানের হেফাজত করাকে খুবই গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআান এবং হাদীস গন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ যবান হেফাজতের গুরুত্ব, সঠিক ব্যবহার, অপব্যবহার, ফজিলত ইত্যাদি সম্পর্কে। আমি সেখান থেকে কয়েকটি বাছাইকৃত বিষয়কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
যবান হেফাজতের গুরুত্ব : যবান হেফাজতের মাধ্যমে মানুষ অনেক ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারে। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন : যে আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (-সহীহ বুখারী: ৬০১৮)। একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবী ওকবা ইবনে আমের রা.-কে তিনটি ওসিয়ত করলেন। এর প্রথমটি ছিল : তুমি তোমার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখ। (জামে তিরমিযী : ২৪০৬)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন- সেই সত্তার কসম, যিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। ভূপৃষ্ঠে সবকিছুর চেয়ে জিহ্বাই সবচেয়ে বেশি বন্দিত্ব ও নিয়ন্ত্রণের মুখাপেক্ষী। (আলমুজামুল কাবীর : ৮৭৪৪)।
যবানের অপব্যবহার : ১. গালি-গালাজ করা। অধিকাংশ মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের ক্ষমতার বা যেকোন কারণে ছোট-বড়, আলেম-ওলামা সহ অন্যদের গালিগালাজ করাটাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে। অথচ হাদীসে এসেছে : হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : দুই ব্যক্তির পরস্পরকে গালি দেয়ার পরিণাম প্রথম গালি প্রদানকারীর উপর পতিত হয়, যাবত -- না মাজলুম (দ্বিতীয় ব্যক্তি) সীমা লংঘন করে। - (মুসলিম, আবুদাউদ ও তিরমিযী- ১৯৩১)। অপর এক বর্ণনায় এসেছে:আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : কোন মুসলমানকে গালি দেওয়া গুনাহর কাজ এবং তাকে হত্যা করা কুফরি কাজ। (বুখারী)। ২.মিথ্যা বলে মানুষকে হাসানো। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ধ্বংস ওর! যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। ধ্বংস ওর! ধ্বংস ওর জন্য!!। (মুসনাদে আহমাদ : হাদীস ২০০২১)।
৩. অন্যকে লানত করা। কারো মাঝে কথায় কথায় লানত-বদদোয়া দেওয়ার বা অভিশপ্ত করার বদ- অভ্যাস থাকে। বিশেষভাবে নারীদের মাঝে। অনেক সময় তারা আপনজন এমনকি নিজ সন্তানকেও বদদোয়া দিয়ে চলে। হতে পারে তখন দুআ কবুলের মুহূর্ত ছিল। ফলে খাল কেটে কুমির আনার মত অবস্থা হয়। বদদোয়াটা লেগে যায়। এটা খুবই গর্হিত কাজ। যবানের মারাত্মক অপব্যবহার। তাই এ ব্যাপারে আমাদের হুঁশিয়ার থাকা উচিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : তোমরা একে অপরকে লানত করো না; বলো না- তোমার উপর আল্লাহর লানত হোক, তোমার উপর আল্লাহর গযব পড়ুক, তুমি জাহান্নামে যাও। (জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৭৬)। ৪.অন্যের গীবত করা। যবানের অপব্যবহারের আরেকটি ক্ষেত্র হল, গীবত-অপবাদ দেওয়া। অথচ কুরআন-হাদীসে এগুলো থেকে শক্তভাবে বারণ করেছে। এগুলো প্রত্যেকটাই কবীরা গুনাহ। পাশাপাশি যবানের অপব্যবহারেরও শামিল।
আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুর‘আনে ইরশাদ করেছেন: তোমরা একে অপরের গীবত (পরনিন্দা) করনা ।তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দ করে থাক । আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক তওবা কবুলকারী অসীম দয়ালু। (সূরা হুজরাত:১২)। রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন; গীবত (পরনিন্দা) যিনার (ব্যভিচার) চেয়ে জগন্য অপরাধ (বায়হাকী)।
৫. মিথ্যা কথা বলা। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘যখন কোনো বান্দা মিথ্যা বলে তখন এর দুর্গন্ধে ফেরেশতারা তার নিকট থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়’। (তিরমিযী, হাদীস ১৯৭২)। ৬. শোনা কথা বলে বেড়ানো। হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছে : কোন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়। (মুসলিম থেকে রিয়াদুস সলিহীন : ১৫৪৭)। ৭. ভালো-মন্দ বিচার না করেই কোন কথা বলা। হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন : বান্দা যখন ভালো-মন্দ বিচার না করেই কোন কথা বলে,তখন তার কারণে সে নিজেকে জাহান্নামের এত গভীরে নিয়ে যায় যা পূর্ব ও পশ্চিমের দুরত্বের সমান। (বুখারী ও মুসলিম থেকে রিয়াদুস সলিহীন : ১৫১৪)।
৮. দ্বি-মুখীপনা হওয়া। হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : দ্বিমুখী চরিত্রের লোকেরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে গণ্য হবে। - (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী-১৯৭৪ : হাসান ও সহীহ্)। ৯. কথার দ্বারা অন্যকে কষ্ট দেওয়া। হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে একজন নারী সম্পর্কে বলা হল, সে খুব নফল নামায পড়ে, রোযা রাখে এবং অনেক দান-সদকা করে। কিন্তু তার মুখের ভাষা প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামী। ঐ ব্যক্তি আরেকজন এক নারী সম্পর্কে বলল, যার নফল নামায, নফল রোযা ও দান-সদকার ক্ষেত্রে তেমন প্রসিদ্ধি নেই। কখনো হয়তো সামান্য পনিরের টুকরা সদকা করে। তবে সে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। কেউ তার মুখের ভাষায় কষ্ট পায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জান্নাতী। (মুসনাদে আহমদঃ ৯৩৮৩; শুআবুল ঈমান : ৯৫৪৬)।
যবানকে অপব্যবহার করার পরিণাম : যবানের অপব্যবহারের কারণে সামাজিক সংঘাত তো রয়েছে, সাথে সাথে এর কারণে মানুষকে জাহান্নামে-ও নিক্ষেপ করবে। দীর্ঘ এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত মুআয রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন : কথার কারণেও কি আমাদের পাকড়াও করা হবে? (মুখের কথার কারণেও কি জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে?) তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুআজ রা.-এর উরুতে মৃদু আঘাত করে বললেন : হে মুআয! তুমি এ বিষয়টি বুঝ না! আরে, মানুষকে তো তার যবানের কথাই উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। যেআল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী সে যেন ভালো কথা বলে বা অন্তত মন্দ কথা থেকে বিরত থাকে। তোমরা ভালো কথা বল, লাভবান হবে। মন্দকাজ থেকে বিরত থাক, নিরাপদ থাকবে। (-মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৭৭৪)।
অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : বান্দা চিন্তা-ভাবনা ছাড়া এমন কথা বলে ফেলে, যার কারণে সে (পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্ব পরিমাণ) জাহান্নামের অতলে নিক্ষিপ্ত হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৭৭)। বহু ক্ষেত্রে যবানের অপব্যবহার গভীর সম্পর্ককেও তছনছ করে দেয়। নিবিড় বন্ধুত্বের মাঝেও ফাটল ধরায়। দীর্ঘদিনের আত্মীয়তাকে মুহূর্তে শেষ করে দেয়। হৃদয়কে জর্জরিত করে। অন্তরকে ক্ষত বিক্ষত করে, যা কখনও মানুষ ভুলতে পারে না। কারণ, যবানের আঘাতের ঘা শুকায় না। কবি বলেছেন, বর্শার ফলার আঘাতের উপশম হয়। তবে যবানের আঘাতের কোনো উপশম নেই। (শরহে জামী)।
যবানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যবানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। কত পুত-পবিত্র তাঁর যবান! যে যবান আল্লাহর তরফ থেকে বান্দার কাছে ওহী পৌঁছায় এবং আল্লাহর কালামের ব্যাখ্যা দান করে। এ যবানের পবিত্রতা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন : সে তার নিজ খেয়াল-খুশি থেকে কিছু বলে না’। এ তো ওহী, যা তার কাছে পাঠানো হয়। (সূরা আননায্ম (৫৩) : ৩-৪)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন