মুহাম্মদ আবদুল বাসেত
মানবতাবাদ বোঝার পূর্বে প্রয়োজন নিজের ভিতরে মানবিকতাবোধ জাগ্রত করা। তারও পূর্বশর্ত মনুষত্ব বোধের উন্মেষ ঘটানো। যে নিজেকে মানুষ হিসেবে চেনে না, সে অন্যকেও মানুষ হিসেবে চিনতে পারে না। যদিও মানবতাবাদ বলতে শুধুমাত্র অন্যের দুঃখ, কষ্টে অংশীদার হওয়া বুঝায় না, এর পরিধি ব্যাপক। এছাড়া মানবতাবাদের সাথে ধর্মের সংযুক্ত তার একটা বিষয় ও থেকে যায়। প্রাচীন গ্রিক মানবতাবাদ থেকে শুরু করে আধুনিক মানবতাবাদ পর্যন্ত কাল পরিক্রমায় মানবতাবাদকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিন্যাস করা হয়েছে। মানবতাবাদ হচ্ছে অন্যকে নিজের মত করে দেখতে জানা, যাবতীয় সৎ গুণাবলী, শিক্ষা ও পারদর্শিতার আলোকে যথোপযুক্ত আসনে তাকে সমাসীন করা। মানবতার কল্যাণে যা কিছু প্রয়োজন তার চিন্তা ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাই মানবতাবাদ। নিজের যা আছে অন্যের জন্যও তা চাওয়া, নিজের জন্য যা আকাক্সক্ষা অন্যের জন্যও তা আকাক্সক্ষা করা। তাই মনুষ্যত্ববোধ ও মানবিকতা বোধের যত ঘাটতি হবে মানবতাবাদও তত অপূর্ণ থাকবে।
মানবতাবাদ, এটি কোন সূত্র নয় যে, প্রায়োগিকভাবে তার প্রতিফলন ঘটবে। তা মূলত অনুভূতির বিষয়। সত্যিকার মানবিকতাবোধের যত বেশি উন্মেষ ঘটবে ততই মানবতাবাদ ধারণাটি পূর্ণতা পাবে। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মা ‘ফেনারটি’ পেশায় একজন ধাত্রী ছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি তাঁর মায়ের পেশার উদাহরণ দিতে পছন্দ করতেন। বলতেন, তিনিও তাঁর মায়ের মতো ধাত্রীর কাজেই করে থাকেন, তবে তাঁর মা মানবশিশু প্রসবে সহায়তা করতেন, তিনি সহায়তা করে থাকেন চিন্তা -ভাবনা প্রসবের বেলায়। সক্রেটিস প্রাচীন গ্রিসের কল্যাণমূলক দর্শনের জন্য বেঁচেছিলেন এবং মৃত্যুকেও বরণ করেছিলেন।
গত ৩০ মার্চ ২০১৪, শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে প্রদর্শিত মোল্লা সাগর পরিচালিত একুশ মিনিটের “সাইরেন” প্রামাণ্যচিত্রে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকল শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ, ক্ষুধার জ্বালায় শেষ পর্যন্ত শ্রমিকের আত্মহত্যার মতো ঘটনা উপস্থিত দর্শকদের মর্মাহত করেছে। একটু ভেবে দেখা দরকার, আমি যদি তাদের স্থানে হতাম!। অজান্তেই স্মরণে আসে স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্য। তিনি পৃথিবীতে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, সৃষ্টি করেছেন তিনি এর মাধ্যমে জেনে নিতে চান কে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসে। কাল কিয়ামতের সময়ে স্রষ্টা তার বান্দাকে বলবেন, আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে খাওয়াওনি। আমি তৃষ্ণার্ত ছিলাম তুমি আমার তৃষ্ণা নিবারণ করোনি। মূলত ক্ষুধার্থ, তৃষ্ণার্ত, অভাবী বান্দাদের প্রতি মানবিকতাবোধ সম্পন্ন সৃষ্টির পরিচয় জেনে নিতে চান স্রষ্টা।
মাইকেল এইচ হার্ট বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশত মনীষীর জীবনীগ্রন্থে, প্রথম স্থান দেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে। তার মানবিক গুণাবলীর কথা সবাই জানেন, এমনকি তাঁর শত্রুও তাঁর গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে যেত। হযরত ওমর মদিনার উপকণ্ঠে এক দরিদ্র মহিলাকে মাঝেমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে আসতেন। কিন্তু যখন সেখানে যেতেন তিনি শুনতেন তার আগে কেউ গিয়ে বৃদ্ধাকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে গেছেন। একদিন তিনি সকালে বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে ঘরের কোনে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন ওই লোককে দেখার জন্য, দেখেন তিনি হলেন হযরত আবু বকর (রা.)। হযরত আবু বকর (রা) আবু বকর খলিফার পদ গ্রহণের পূর্বে তাঁর মহল্লায় বকরীর দুধ দোহন করতেন। একদিন রাস্তা দিয়ে গমন কালে জনৈক বালিকার মন্তব্য শুনলেন, “লোকটি এখন খলিফা হয়েছে তাই আমাদের বকরীর দুধ দোহন করতে আসবে না”। তিনি মেয়েটিকে বললেন, হে আমার কন্যা আমি আগের মতোই বকরীর দুধ দোহন করতে আসবো, আশা করি পদ মর্যাদা আমার নিয়মিত কর্মসূচিতে কোন পরিবর্তন আনবে না ”।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যে অন্য জাতির অধিকার ক্রীতদাসের চাইতেও খারাপ ছিল। এমনকি সিরিয়ায় খ্রিস্টানদের তাদের জমির উপর অধিকার পর্যন্ত ছিল না। জমির মালিকানা হস্তান্তরের সাথে সাথে তারাও হস্তান্তরিত হতো। হযরত ওমর (রা) যখনই এই দেশগুলো জয় করেন তখন তিনি স্থানীয় কৃষকদের কাছে জমি ফিরিয়ে দেন। তাদের অধিকাংশ ছিল অমুসলিম। বাস্তবিক মানবিকতাবোধ এখানইে যেখানে ধর্ম ও বর্ণ মানবিকতাবোধকে প্রতিবন্ধক করে রাখেনি। এ মহামানবদের কর্ম ও দর্শনই মানবতাবাদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বিনা অপরাধে কোনো মানবকে কেউ হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করলো, আবার কারও প্রাণ রক্ষা করল সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতির প্রাণ রক্ষা করল পবিত্র কোরআনে একথা বর্ণিত হয়েছে। অথচ চেচনিয়া, বসনিয়া, ইরাক, সিরিয়া, মিশর, কাশ্মীরসহ বিভিন্ন দেশে হত্যা, নির্যাতন ইত্যাদি যেন নিত্য নৈমিত্তিক কা-। সেখানে মানুষকে মানুষ হিসেবে মনে করা হয় না। শুধুমাত্র ভিন্ন মতাবলম্বী ও ভিন্ন ধর্মের কারণে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। সেখানে মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ধর্মী ও নেতৃবর্গরা কোথায়? সে জন্য মানবাধিকার কর্মী হওয়ার পূর্বে চাই সত্যিকার মানবতাবাদী হওয়া যেখানে ধর্ম, অঞ্চল বা মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে মানুষকে মানুষ হিসেবে চিনতে ও মানবতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।
মানবতাবাদীদের মূল আন্দোলন হচ্ছে অন্ধত্ব ও অভিশাপকে দূর করা যেখানে হত্যা, ব্যভিচার হওয়া দূরের কথা, কোনে পাপাচারের ছোঁয়াই থাকবে না। সেখানে মানুষ মানুষকে চিনবে। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। ভিন্নধর্মী বা ভিন্ন মতালম্বী হলেও কেউ কাউকে হত্যা বা হত্যার মত গর্হিত কাজে প্ররোচিত করবে না। সারা পৃথিবীর মানবাত্মাকে তারা একই আত্মারূপে মনে করবে। দেহের একটি অঙ্গের আঘাত যেমনি পুরো অনুভূতিতে আঘাত করে তেমনি পৃথিবীর একপ্রান্তের কোনো মানুষের আঘাত, দুঃখ-পীড়া অন্য প্রান্তের মানুষও উপলব্ধি করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন