বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে করণীয় শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিচার বিভাগ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ আজও দলীয়করণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ-পদোন্নতি-বদলি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয় থেকে। দলীয়করণ নামক ক্যান্সারে আক্রান্ত পুরো বিচার বিভাগ। অলোচনায় সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা প্রবীণ আইনবীদ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, আজ সংবিধানের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের সর্বোচ্চ বিচারবিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে দলীয়করণের মাধ্যমে। জজ নিয়োগ হয় দলীয়করণের ভিত্তিতে Ñ এমন অভিযোগ এনে তিনি বলেছেন, কথা হলো যোগ্যতা, মেধা, সততা কোনো কিছু হিসাবের মধ্যে আসবে না। বিচার বিভাগ না থাকলে আমরা কেউ নিরাপদ থাকব না, আমাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিও নিরাপদ থাকবে না। তিনি আরো বলেছেন, বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা গেলে দেশ সংবিধান অনুযায়ী চলছে কিনা তা বিচারকরাই দেখতে পারবেন। সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন বলেছেন, চিফ জাস্টিসকে ডিনারে ডাকা মানেই বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করা। এছাড়া ওই কাজটি করার পর ওই বিচারপতি সঠিক রায় লিখেেলও জনগণ মনে করবে, তিনি সঠিক রায় লিখতে পারছেন না। তিনি উল্লেখ করেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময়েও বিচারপতিদের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। তিনি আগে বলেছেন, যে সরকারই আসুক এ অবস্থার অবসান না হলে বিচার বিভাগ স্বাধীন হতে পারবে না। তিনি জানিয়েছেন, তাকে ডিঙিয়ে বিচারপতি খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করে আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ রায় দিলেও তিনি সেই রায়টি লেখেন অবসরে যাওয়ার পর।
আলোচনায় বিশিষ্টজনরা বিচার বিভাগের সত্যিকার স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার যে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, তাকে কোনো বিবেচনাতেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। সুশাসন, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র Ñ যা কিছুই বলা যাক না কেন, তা সত্যিকার অর্থে নির্ভর করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর। এটা সুবিদিত যে, নির্বাহী বিভাগ থেকে যেসব অন্যায় বা অবিচারমূলক কর্মকা- সংঘটিত হয়, তার সুবিচার নিশ্চিত করতে পারে একমাত্র বিচার বিভাগই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বিচার বিভাগ নিয়ে নানামাত্রিক আলোচনা সাম্প্রতিককালে স্থান করে নিয়েছে। অলোচনায় সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দীন খান বলেছেন, আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চাই, কার্যকর বিচার বিভাগ চাই। বিভাগের দুর্নীতির বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। টিআইবির খানা জরিপেও দুর্নীতির দিক দিয়ে বিচার বিভাগ এক নম্বরে উঠে এসেছিল। তিনি মনে করেন, রাজনীতি কুলষিত হয়ে গেছে। সেটা থেকে বের হতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রকৃত অর্থে আমাদের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। সে মোতাবেক আইন করে স্বাধীনও করা হয়েছে। এ নিয়ে সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মাঝেমধ্যে তাদের কৃতিত্বও জাহির করেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কোন পর্যায়ে রয়েছে সে প্রসঙ্গ মূলত উঠে এসেছে প্রধান বিচারপতিসহ আরো অনেকের আলোচনায়। সম্প্রতি বারের এক আলোচনায় প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় সোচ্চার থাকতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। অবসরে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি বিদায়ী সংবর্ধনায় বলেছিলেন, গণতন্ত্র সুসংহত না হলে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কথা না ভাবাই ভালো। স্বাধীনতার প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে Ñ অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা অসাংবিধানিক, এ সংক্রান্ত প্রধান বিচারপতির মতামত দেয়ার পর থেকেই। এই বক্তব্য দেয়ার পর সরকারি দলের অসহিষ্ণুতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছে। সরকারি দলের কোনো কোনো প্রবীণ সদস্য প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যকে উস্কানিমূলক বলেও অভিমত প্রকাশ করেছেন। এর পরপরই প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতিকে ডিনারের দাওয়াত দিয়েছিলেন, যেখানে আইনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন।
বিচার বিভাগে দলীয়করণের যে অভিযোগ উঠেছে তার নেতিবাচক প্রভাব অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। অধস্তন পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বত্রই যদি বিচার বিভাগে এর প্রভাব পড়ে তাহলে সংগত বিবেচনাতেই নাগরিক অধিকার বিঘিœত হবে। এ অভিযোগই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে গত কিছুদিন থেকে করা হচ্ছে। বিষয়টি কেবল বর্তমান সময়েই হয়েছে, তেমনটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। একটি স্বাধীন দেশে এ অবস্থা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। দেশের বিশিষ্টজনেরা যে অভিমত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন, তাকে হালকা করে না দেখে পরিস্থিতি উত্তরণের পথ খোঁজা জরুরি। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা নিঃসন্দেহে সরকারের জন্য বিব্রতকর। দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতেই বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। এ প্রসঙ্গে আমরা প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে তার আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন