শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পরাধীন মুসলিমদের মুক্তিকামী নেতা আল্লামা জামাল উদ্দীন আফগানী

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১০ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

মুসলিম জাহানের অবিসংবাদিত মুক্তিকামী নেতা আল্লামা সৈয়দ জামাল উদ্দীন আল হোসাইনী আল আফগানী (রহ:) -এর ওফাত বার্ষিকী ৯ মার্চ। ১৮৩৯ সালে তিনি আফগানিস্তানে জ¤œ গ্রহণ করেন এক সুফী সাধক পরিবারে। সারা জীবন তিনি তার স্বদেশ সহ তৎকালীন পরাধীন দুনিয়ার স্বাধীনতার জন্য নানা ভাবে যে সংগ্রাম করেছেন তা ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। তার সে সংগ্রামী জীবন কাহিনী বিশাল।

সৈয়দ সাহেবের শেষ জীবনে তিনি যখন তুরস্কে অবস্থান করছিলেন, তখন তুর্কী সুলতান কর্তৃক ভিত্তিহীন অভিযোগ ও বিভিন্ন সন্দেহের কারণে তাকে অন্তরালে রাখা হয় এবং তার প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখার জন্য গোয়েন্দা নিয়োজিত করা হয়, সারাক্ষণ তার সাথে ছায়ার মত লেগে থাকতো এবং তার গতিবিধির প্রতি কড়া নজর রাখতো। তার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছে যে, মোহাম্মদ আবদুহুর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘বন্ধু-বান্ধব সবাই তাঁর কাছ থেকে কেটে পড়তে লাগলো এবং ‘নিশানেতাস’ -এর রাজকীয় মেহমান খানা তার জন্য জেলখানার কুটীরে পরিণত হয়ে যায়। এ নির্জণ-একাগ্রতার মধ্যে কেবল তার এক ভক্ত কর্মচারী তার সঙ্গে ছিল। এ কঠিন বিপদের সময় সৈয়দ সাহেবের ক্যান্সার দেখা দেয়। শাহী চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়, কিন্তু রোগ তীব্র আকার ধারণ করে, সৈয়দ সাহেবের উন্নত চিকিৎসার জন্য ভিয়েনা যেতে চেয়েছিলেন, সুলতান এ অবস্থায়ও বিপজ্জনক মনে করে তাকে অনুমতি দিলেন না। এ দূরারোগ্য রোগে তার ইনতেকাল হয়।’

আল্লামা সৈয়দ জামাল উদ্দীন আফগানী এখন থেকে প্রায় সোয়াশ’ বছর পূর্বে এ দুনিয়া হতে চির বিদায় নিয়ে গেলেও আজো মুসলিম উম্মার নিকট তাঁর নাম সুপরিচিত হয়ে আছে। তাঁর এ সুনাম-খ্যাতির অন্তরালে কি জিনিস সক্রিয় রয়েছে তা অনেকের জানা না থাকলেও মুসলিম জগতের সেকালের ইতিহাস জানা লোকের অভান এখনো নেই। কেননা আল্লাম সৈয়দ জামাল উদ্দিন আফগানী কেবল জন্মভ‚মি আফগানিস্তানের কৃতি সন্তান ছিলেন না, তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাব শুধু এ উপমহাদেশ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, তার দুর্লভ ব্যক্তিত্বের প্রভাব তৎকালীন ইসলামী বিশ্বকেও প্রভাবিত করেছিল। যেখানে সেখানে সাম্রাজ্যবাদের কবলে পড়ে মুসলিম সমাজ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, সেখানেই আল্লামা আফগানীর পদচারণা ছিল আশা ভরসার আলোকবর্তিকা স্বরূপ। অনলবর্ষী বক্তা হিসেবে এবং অসাধারণ লেখক হিসেবে তিনি অত্যাচারিত-নির্যাতিত ও স্বাধীনতা কামী মুসলমানদের জবান ও কলম দ্বারা মুক্তি স্বাধীনতা, শান্তি ও বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যের যে বাণী ধারার সূচনা করেছিলেন তাতে নানামুখী প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হলেও বিশ্ব মুসলিমের নিকট তিনি ‘নকীব’ রূপে গণ্য হতে থাকেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে আলমে ইসলামের করুণ পরিস্থিতিতে তাঁর আবির্ভাব ছিল মুসলিম উম্মার জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। এ সময় তার মতো বিরল ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব গোটা ঘুমন্ত মুসলিম দুনিয়ায় যে নাড়া দিয়েছিল তার প্রতিধ্বনি এক বিখ্যাত ইংরেজ প্রাচ্যবিদ প্রফেসার ই. জি. ব্রাউনের মুখেই শোনা বাক্য। তিনি বলেন; “তিনি (সৈয়দ আফগানী) চিন্তাবিদও ছিলেন, কলমধারীও ছিলেন, খতীবও ছিলেন এবং সাংবাদিকও ছিলেন। কিন্তু সর্বাপেক্ষা তিনি ছিলেন এমন একজন রাজনীতিবিদ যিনি মুসলমান বাদশাহ এবং ফিরিঙ্গী সাম্রাজ্যের উভয়ই তাকে এক ভয়ংকর এবং বিপ্লবী গোলযোগ দমনকারী মনে করে।”

প্রফেসার ই. জি. ব্রাউন আল্লামা আফগানীর ব্যক্তিত্বকে যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন। কেননা মুসলমানদের তখনকার শোচনীয় পরিস্থিতি অনুধাবন করার মতো নেতৃত্বের অভাব না থাকলেও মুখ খুলে প্রকাশ করার সাহস অনেকেরই ছিল না। বিশেষত; বিভিন্ন রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন রাজশক্তি বর্গের শাসন ব্যবস্থাই ছিল নির্যাতন মূলক। ঐ সব রাষ্ট্রের মুসলিম জনগণ রাষ্ট্রীয় অত্যাচার-নির্যাতনে ছিল জর্জরিত এবং অধিকার বঞ্চিত। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে পরষ্পর বিরোধ, অনৈক্য ও ক্ষমতার দ্বন্ধ ইত্যাদি অন্যায়-অবিচারের সুযোগে সাসাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাতে ইন্ধন যোগাতেও ভুল করেনি এবং সুযোগ বুঝে বিভিন্ন স্থানে আগ্রাসনও চালাতে থাকে। সাধারণভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোতে বিরাজ করছিল স্থবিরতা। ভাগ্য পূজা, অকর্মণ্যতা, নৈরাশ্যবাদিতা, অন্ধ অনুকরণ, অজ্ঞতা, অভাব-অনটন এবং রাজনৈতিক দলাদলি, হানাহানি ইত্যাদি অশুভ নিদর্শণের সুযোগে ইউরোপের আগ্রাসী শক্তিবর্গ বিশে^র ইসলামী বসতিগুলোর দুই তৃতীয়াংশ গিলে ফেলে ছিল।

সংক্ষেপে বলা যায়, তুর্কিদের খেলাফতে উসমানিয়ার যে কেন্দ্রীয় মর্যাদা ছিল তাও ‘লুপ্ত-মর্দে বিমার’ উপাধি আখ্যায়িত এক খলিফার হাতে এবং খেলাফত রোজই তার দুর্বল হাতে দুর্বলতর হতে চলছিল। আফগানিস্তান হতে আলজিরিয়া পর্যন্ত যতগুলো মুসলিম সাম্রাজ্য ছিল সবগুলোর জনসাধারণ অযোগ্য এক নায়কত্ব ও অত্যাচারী বাদশাহদের অধীনে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হচ্ছিল। এহেন পরিস্থিতির অবিসম্ভাবী পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছিল অর্থাৎ- গোলামীর জিঞ্জিরে তারা আবদ্ধ হয়ে যায়। হিন্দুস্থানে মোগলে আজমের সাম্রাজ্যের পতনমুখ, ইংরেজ ও ফরাসীদের ষড়যন্ত্রের এক অব্যাহত ধারা বিস্তার লাভ করে। মোট কথা, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ অবশিষ্ট মুসলিম দেশ গুলোকেও গ্রাস করার পরিকল্পনা করতে থাকে। ফলে পাশ্চাত্য চিন্তা ধারার উন্মেষ ঘটতে থাকে, মুসলিম সমাজে এবং মুসলমানদের দুনিয়া ও দ্বীন উভয়ই সংকটে পতিত হয়।

সৈয়দ জামাল উদ্দীন আফগানী বংশ মর্যাদার দিক থেকেও ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত বংশের কৃতি সন্তান। এ বংশে বহু খ্যাতিনামা বুজর্গ সাধক ছিলেন। তার ঊর্ধ্বতন পুরুষদের মধ্যে সৈয়দ আলী তিরমিজি সীমান্ত প্রদেশের একজন প্রসিদ্ধ সাধক ছিলেন, যার মাজার সোওয়াতের বাণির নামক স্থানে অবস্থিত। তাকে আফগানিস্তানের সৈয়দ (সাদাত) গণের ঊর্ধ্বতন পুরুষ বলা হয়। সৈয়দ জামাল উীদ্দন -এর পিতা সৈয়দ সফদর বহু গুণের অধিকারী আফগানিস্তানের প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সে দেশের প্রসিদ্ধ গুণীজন বর্গ বিভিন্ন বিষয়ে তার শরণাপন্ন হতেন। সৈয়দ জামাল উদ্দীন -এর মাতা সকিনা বেগম ছিলেন সে দেশের প্রসিদ্ধ কাজী মীর শরীফ উদ্দীন আল হোসাইনী -এর কণ্যা এবং তাকে সাদাত বংশে গণ্য করা হতো। এভাবে সৈয়দ জামাল উদ্দীন পিতার উভয় দিক দিয়ে সৈয়দ ছিলেন। ১৮৩৯ সালে তিনি জালালাবাদের নিকট ‘কোন্টার’ নামক পল্লীতে জন্মগ্রণ করেন। শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান অর্জণ তাঁর পারিবারিক উত্তরাধীকার সূত্রে প্রাপ্য। ১৮৬০ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে তার পিতার নিকট শিক্ষা লাভ করেন এবং অসাধারণ মেধা শক্তি বলে মাত্র ২১ বছর বয়সেই সব শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৮৬২ সালে আগানিস্তানের শাসনকর্তা আমির দোস্ত মোহাম্মদ খান সৈয়দ সফদর ও তার পরিবার বর্গকে ডেকে কাবুলে গৃহ বন্দি করে রাখেন। কারণ সৈয়দ সফদরের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে চলছিল। আমিরের নিকট তা ছিল বিপদের কারণ হয়ে দাড়িয়ে ছিল। সৈয়দ জামাল উদ্দীন বিখ্যাত উলামার কাছ থেকে জ্ঞান লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিলেন সৈয়দ ফকির বাদশাহ। সৈয়দ সাহেব তারই নিকট প্রচলিত সব শাস্ত্রের শিক্ষা লাভ করেন। ১৮ বছর বয়সে তার পিতা ইন্তেকাল করেন।
পিতার ইন্তেকালের কিছু দিন পর সৈয়দ জামাল উদ্দীন হজ্জ্ব করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে প্রথমে হিন্দুস্থানে আগমন করেন। তখন ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বানিজ্য করার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে তা দখল করেছিল। মোগল সাম্রাজ্য দিল্লির লাল কেল্লা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ইংরেজরা ১৮৫৭ সালের যুদ্ধ পরিকল্পণা আগেই গ্রহণ করে রেখেছিল এবং সাথে সাথে পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থাও চালু করে ছিল। সৈয়দ আফগানী ১৮৫৭ সালের শুরুতেই হেজায চলে যান। হজ্জ্বের শেষে তিনি প্রায় এক বছর পর্যন্ত সিরিয়া, বায়তুল মোকাদ্দাস, ইরাক এবং পারস্য সফর করেন এবং এসব দেশের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। অত:পর বেলুচিস্তান হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তণ করেন।

সৈয়দ জামাল উদ্দীন তাঁর যৌবনের শুরুতেই সরকারের দরবারিদের মধ্যে নিজের মেধা-যোগ্যতার প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাই দেশে প্রত্যাবর্তণের পর পরই আমির দোস্ত মোহাম্মদ খান তাকে নিজের দরবারিদের অন্তর্ভূক্ত করেন এবং তার বড় পুত্র মোহাম্মদ আযীম খানের শিক্ষা দীক্ষার দায়িত্ব প্রদান করেন। সে সময় থেকেই তার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্ম তৎপরতা শুরু হয়। আমির দোস্ত মোহাম্মদ খানের জীবদ্দশা পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রীয় নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতে থাকেন, আমিরও তাকে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে দেখতেন এবং সামরিক অভিযানেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন।

আমির দোস্ত মোহাম্মদ খানের ইন্তেকালের পর তার তিন পুত্রের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ শুরু হলে সৈয়দ জামাল উদ্দীন সাহেব উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা পালন করতে থাকেন এবং তাদের মধ্যে বিরোধ নিরসনে বিশেষ অবদান রাখেন। কিন্তু তাদের মধ্যে ঝগড়া ফের তীব্র আকার ধারণ করে এবং রক্তপাত হওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়, এমনকি মন্ত্রী মোহাম্মদ রফিকের ষড়যন্ত্রের ফলে সৈয়দ সাহেবের নিরাপত্তাও বিপদজনক হয়ে উঠে। তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরে সাময়িক ভাবে হিন্দুস্থান চলে যান এবং মোহাম্মদ আজমকে তার ছোট ভাই শের আলী মোহাম্মদ আজমের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে তাকে ভারতের দিকে পালাতে বাধ্য করেন। অত:পর তার দ্বিতীয় ভাই মোহাম্মদ আমিনকে পরাজিত করেন। মোহাম্মদ আজম প্রত্যাবর্তণ করে শের আলীকে পরাজিত করেন এবং তিনি আফগানিস্তানের সিংহাসন অধিকার করেন এবং সৈয়দ জামাল উদ্দীন কে হিন্দুস্থান হতে ডেকে এনে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টা করেন।

অত:পর সৈয়দ জামাল উদ্দীন আফগানীর বিভিন্ন মুসলিম দেশ সফর, স্বাধীনতার জন্য পরাধীন মুসলমানদের উদ্ভুদ্ধকরণ, বিভিন্ন স্থানে সংবাদপত্রের প্রকাশনা এবং সেগুলোতে স্বাধীনতার পক্ষে জ্বালাময়ী রচনাবলী প্রকাশ, জনসমাবেশে বক্তৃতা দান ইত্যাদিসহ তার প্রচারধর্মী তৎপরতার এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তার শুরু করা সেই সংগ্রামী ভূমিকা ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রূপে চির অম্লান থাকবে। স্বাধীনতার সংগ্রামী এ মোজাহেদে আযমের কীর্তি ও অবদানের কথা স্মরণ করে আজও আত্মভোলা ঘুমন্ত মুসলমানগণ তার জীবনাদর্শ হতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। ১৮৯৭ সালের ৯ মার্চ এ মহান ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Nure Tahmid Adnan ২ নভেম্বর, ২০২২, ১১:৪৮ এএম says : 0
ইন্ডিয়া জিতবে মনে হচ্ছে
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন