দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)র চেয়ারম্যান পদ থেকে বিদায় নিলেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ। ২০১৬ সালের ১০ মার্চ তিনি সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যোগদান করেন। সেগুনবাগিচাস্থ দুদক কার্যালয়ে যোগ দেন একই বছর ১৩ মার্চ। সেই থেকে টানা পাঁচ বছর তিনি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গতকাল মঙ্গলবার ( ৯ মার্চ)ছিলো দুদকে তার শেষ কর্মদিবস। আজ (১০ মার্চ) থেকে তিনি ‘দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান’। ব্যক্তিগতভাবে কোনো রকম জবাবদিহিতার ধার না ধারা আতœম্ভরিতায় পরিপূর্ণ এই ব্যক্তিটির শেষ দিন কেটেছে হাইকোর্টের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেয়ার মধ্য দিয়ে। বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের একক বেঞ্চে তিনি ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সংক্রান্ত নিজ মতামত তুলে ধরেন। দুপুর আড়াইটা থেকে চারটা পর্যন্ত তিনি হাইকোর্টের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে। এ সময় তিনি আদালতের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন।
দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, করোনার প্রকোপ শুরুর পর তিনি সেগুনবাগিচাস্থ দুদক কার্যালয়ে খুব একটা আসতেন না। বিশেষ করে করোনার প্রথম দিকেই দুদকের একজন পরিচালকের মৃত্যুর পর তিনি প্রতিষ্ঠানে আসেনই নি। অফিস চালাচ্ছিলেন ভার্চুয়ালি। শেষ কর্মদিবসের আগের দিন অর্থাৎ সোমবার তিনি দুদক কার্যালয়ে আসেন। সংবাদকর্মীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। এ সভায় তিনি স্বীকার করেন, মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী দুর্নীতি বিরুদ্ধে তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন নি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরণের ‘চাপ’ ছিলো না। তা সত্তে¡ও শুধুমাত্র দেশের ‘ভাব-মর্যাদা রক্ষায়’ অনেক দুর্নীতির বিষয়েই ব্যবস্থা নিতে পারেন নি।
সূত্রমতে, গতকাল মঙ্গলবার ছিলো তার শেষ কর্মদিবস। পিপলস লিজিংসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ,পরিচালনা ইত্যাদি বিষয়ে হাইকোর্ট তার মতামত জানতে চেয়েছিলেন। ৯ মার্চ ছিলো সেই ‘মতামত’ প্রদানের তারিখ। এ জন্য তিনি নিজ কার্যালয়ে আসেন সকাল সকাল। কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে কথা বলেন। সৌজন্যমূলক আলাপচারিতা সারেন। এর আগে তিনি পুলিশ,আদালত,রাজস্ববোর্ড,বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধানকে চিঠি লেখেন। পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকালে তাকে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান এই চিঠিতে।
সূত্রটি জানায়, সমান এখতিয়ার সম্পন্ন তিন সদস্যের কমিশনে ছিলো কার্যত: ইকবাল মাহমুদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। এর ফলে স্বশাসিত স্বাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি হয়েছিলো বলতে গেলে তার একক ইচ্ছার অধীন। সকল সিদ্ধান্ত কমিশন সভায় নেয়ার কথা থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত তিনি একাই নিতেন। টানা পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকালে অনেক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেন। স্বেচ্ছাচারিতার বশবর্তী হয়ে হয়ে অনেক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তার মেয়াদকালে আন্তর্জাতিক দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের অবণতি ঘটে। সরকারি কেনাকাটা,বিভিন্ন প্রকল্প, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতির পরাগায়ণ ঘটে। দুর্নীতি দমনের পরিবর্তে তিনি নসিহতধর্মী কার্যক্রম হাতে নেন। গণ শুনানি, মানব বন্ধন, লিফটলেট বিতরণ, সততা স্টোর পরিচালনা, বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের নামে বিপুল অর্থও ব্যয় করেন। সংবাদ শিরোনাম হওয়ার লক্ষ্যে তিনি মাঝে-মধ্যেই নীতিগতভাবে বহুল বিতর্কিত ‘ফাঁদ মামলা’র আশ্রয নেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দালিলিক প্রমাণ হাতে না নিয়েই দায়ের করেন এসব পাতানো মামলা। কিন্তু যখন মামলাগুলো বিচারের জন্য যায়-তখন আইনের ফাঁকে বেরিয়ে আসেন আসামিরা। ‘ফাঁদ মামলা’ প্রমাণিত হয় ‘মিথ্যা মামলা’ হিসেবে। আর এসব মামলায় আসামি করা হয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল,প্রভাবহীন ছোটখাটো কর্মকর্তা-কর্মচারিদের। অন্যদিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন, ভুয়া প্রকল্পের বিপরীতে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ, প্রশাসন ক্যাডারদের যোগসাজশে শত শত কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকের হাতে তুলে দেয়ার মতো বৃহৎ ঘটনা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখেন। স্বেচ্ছাচারিতা এবং প্রতিশোধপরায়ণতার অভিযোগও ওঠে ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে।
২০১৬ সালে দায়িত্ব নিয়েই তিনি জনতা ব্যাংকের তৎকালিন চেয়ারম্যান শেখ মো. ওয়াহিদ-উজ-জামানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেন। অবশ্য পরে অদৃশ্য কারণে সেই অনুসন্ধান ‘পানি’ হয়ে যায়। এক সময় জানা গেলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব শেখ. মো. ওয়াহিদ-উজ-জামানের সঙ্গে ইকবাল মাহমুদের ছিলো স্নায়ু বিরোধ। পাঁচ বছরে এমন বহু দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন। বহু নিরীহ মানুষ তার দম্ভ ও রোষানলের শিকার হয়ে অকারণ ‘মামলা’ খেয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও তিনি হয়েছেন দুদকের ‘চার্জশিটভুক্ত’ আসামি। এর মধ্যে জাহালম-কান্ড ছোট্ট একটি নজির মাত্র। দুদক আইনের ২৬(২) এবং ২৭(১) ধারায় ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জন’র অভিযোগ কমিশন ইচ্ছে করলে যে কারও বিরুদ্ধেই আনতে পারে। সহজলভ্য এই আইনটির যথেচ্ছ প্রয়োগে ইকবাল কমিশন দুদককে পরিণত করেন হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে। ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন’র কথা তিনি প্রায়শ:ই উচ্চারণ করতেন। কিন্তু করতেন এর উল্টোটি। দুর্নীতির ‘রাঘব বোয়াল’ ছেড়ে তিনি ছুটেছেন ‘চুনোপুটি’র দিকে। উপরোক্ত ধারাটি তিনি বহু সনামধন্য ব্যক্তিদের অযথা হয়রানি করেন। সুপ্রতিষ্ঠিত অনেক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের হেয় করতেও ব্যবহার করেন এই দু’টি ধারা। তাদের নোটিশ দিয়ে ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য’ তলব করেন। যা দেশের শিল্প বিনিয়োগ এবং ব্যবসায়িক বিস্তারে ছিলো বড় একটি অন্তরায় । দুর্নীতি দমনের নামে ইকবাল মাহমুদ নেতৃত্বাধীন কমিশনের স্বেচ্ছাচারিতায় ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে দুদক। বৃহৎ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের ভাব-মর্যাদারও হানি ঘটেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদক কর্মকর্তারা জানান, চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেই সেবছর ১৪ মার্চ ভরা মিটিংয়ে দুদক কর্মকর্তাদের ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পরে কথিত সেই ‘দুর্নীতিবাজ’দেরই তিনি কাছে টেনে নেন। তাদের ওপর নির্ভর করেন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক অভিযোগের অনুসন্ধান এবং মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেন তাদের হাতে। কাজের ধীরগতি দেখে ক্ষিপ্ত ইকবাল মাহমুদ প্রথম মাসেই কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সাড়ে ৭শ’ কারণদর্শানোর নোটিশ দেন। সেই নোটিশের জবাব দিতে কর্মকর্তাদের শুরু হয় ত্রাহিদশা । এ সময় চলমান অনেক অনুসন্ধান-তদন্তের স্বাভাবিক কার্যক্রমও বিঘিœত হয়। পরে তিনি বুঝতে সক্ষম হন যে, দুর্নীতির অনুসন্ধান-তদন্ত মূলত:প্রমাণ ভিত্তিক-সাক্ষ্যভিত্তিক নয়। বিভিন্ন দফতর থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কখনো নোটিশ দিয়ে কখনও গ্রেফতার করে হাজির করতে হয়। আদালতের অনুমোদন নিতে হয়। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ রদ করতে হয়। অনুসন্ধান-তদন্তের প্রক্রিয়াটিই এমন। পরে অবশ্য তিনি নির্দেশনামূলক একটি সময়-সীমা বেধে দিয়ে দুদক অনুসন্ধান-তদন্তে স্বীয় অজ্ঞতার পরিসমাপ্তি ঘটান।
দুদক কর্মকর্তারা নাম প্রকাশে আপত্তি তুলে জানান, স্বেচ্ছাচারিতার বশবর্তী হয়ে মাঠপর্যায়ের অনেক দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাদের তিনি প্রতিরোধ,গণসচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত রাখেন।তাদের দক্ষতাকে কাজে না লাগিয়ে নিয়োজিত রাখেন ব্যক্তিগত আকাঙ্খা বাস্তবায়নে। দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে তিনি ‘১০৬’ নামক অভিযোগকেন্দ্র খোলেন। উদ্যোগটি হালে পানি পায় নি। দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে সংবাদপত্রের কাটিং।
তিনি মুখে সমালোচনাকে স্বাগত জানানোর কথা বলতেন। কার্যত: সমালোচকের এক হাত নিয়ে ছাড়তেন। ছিলেন ভয়াবহ রকম প্রতিশোধপরায়ণও। মৃদু সমালোচনাও সহ্য করতে পারতেন না। গণমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক,সম্পাদক,প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দিতেন। প্রতিষ্ঠানের মালিককে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে বেশ ক’জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুতও করেন। কাউকে কাউকে দুদকে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। গণমাধ্যম কর্মীদের তিনি ‘পছন্দ’ করতেন শুধুমাত্র আতœপ্রচারণায়। কিন্তু দুদকের অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দুর্নীতির অনুসন্ধান-তদন্তের তথ্য যাতে সংবাদ মাধ্যমের হাতে না আসে এ লক্ষ্যে তিনি হাতে নিয়ন্ত্রণমূলক নানা কর্মসূচি। দুদকে সাংবাদিক প্রবেশে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন। জনসংযোগ কর্মকর্তা এবং সংস্থার সচিব ছাড়া অন্য কোনো কর্মকর্তা সাংবাদিককে তথ্য দিয়েছেন-জানলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিতেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। পছনন্দের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সুপারিশ করে মাঠপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা তার রোষানলের শিকার হয়েছেন। বদলি হয়েছেন প্রত্যন্ত এলাকায়। পক্ষান্তরে তার ‘চাহিদানুগ’ ফরমায়েশী কাজ করে পুরষ্কৃত হয়েছেন অনেকে। পদোন্নতি,গুরুত্বপূর্ণ ডেস্কে বদলি, বিদেশে প্রশিক্ষণ-এসবকে তিনি ব্যবহার করতেন প্রলোভন হিসেবে।
এ হেন ‘চেয়ারম্যান’র বিদায়ে অনেক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তির মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। সেই সঙ্গে নতুন প্রত্যাশায় তারা আস্থা রাখতে চাইছেন নবনিযুক্ত মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেৃত্বত্বাধীন কমিশনের প্রতি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন-আর যাই হোক-নতুন কমিশন অন্তত: বিদায়ী কমিশনের মতো এতো টা নিচে নামবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন