বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

জালনোট ঠেকাতে কঠোর বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রকাশের সময় : ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : প্রতিবছর ঈদ এলেই জালনোট কারবারীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে রাজধানীতে এসব চক্র ১০ কোটি এবং রাজধানীর বাইরে বিশেষ করে পশুরহাটগুলোতে প্রায় ৪০ কোটি টাকার জাল নোট বিক্রির টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে।
এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। যদিও ইতোমধ্যে রাজধানীর পল্টন, কোতয়ালী ও লালবাগ থেকে এ চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে কোরবানির পশুর হাটে জালনোট প্রচলন প্রতিরোধে এবার আগে থেকেই মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে নোট যাচাই সেবা দিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হাট শুরুর দিন হতে ঈদুল আজহার পূর্ববর্তী রাত পর্যন্ত অভিজ্ঞ ক্যাশ কর্মকর্তাদের দ্বারা এ সেবা প্রদান করার নির্দেশ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজম্যান্ট বিভাগ এক সার্কুলারে এমন নির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র এফ এম মোকাম্মেল হক ইনকিলাবকে বলেন, ঈদ এলেই জালনোট কারবারী সিন্ডিকেট সারাদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মার্কেট, বিপণী-বিতান ও পশুরহাটে এরা ভয়ঙ্কর ফাঁদ ফেলে। আর তাই প্রতিবছরের মতো জালনোট ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সোচ্চার। এ জন্য রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নোট যাচাই সেবার ব্যবস্থা করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিবছর ঈদ ও কোরবানি উপলক্ষে নতুন টাকা ছাড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নতুন টাকাকে পুঁজি করে জালকারী চক্রের অপতৎপরতা বাড়ে। বিশেষ করে কোরবানির পশুর হাটে জালনোট ছড়িয়ে দেয়ার আশঙ্কা থাকে। এমন বাস্তবতায় এবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন হাট বসছে ২১টি। এসব হাটে ব্যাংকগুলোর নির্দিষ্ট শাখাকে জালনোট শনাক্তকারী মেশিনের ব্যবহারে নোট যাচাই সেবা দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে একটি হাটে ন্যূনতম দুইটি ব্যাংকে এ ধরনের সেবা দিতে হবে। তবে গাবতলী পশুর হাট বড় হওয়ায় ৪টি ব্যাংকের জালনোট যাচাই সেবা থাকবে।
সার্কুলারে বলা হয়, হাট শুরুর দিন হতে ঈদুল আযহার পূর্ববর্তী রাত পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে অভিজ্ঞ ক্যাশ কর্মকর্তাদের দ্বারা বিনা খরচে পশু ব্যবসায়ীদের এই সেবা দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট হাটে ব্যাংকের নাম ও তার সাথে জালনোট শনাক্তকরণ বুথ উল্লেখপূর্বক ব্যানার ও নোটিশ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট হাটের জন্য নির্বাচিত কর্মকর্তার নাম, পদবী ও মোবাইল নম্বর এবং তার কাজ পর্যবেক্ষণে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণকারী উপযুক্ত একজন কর্মকর্তার নাম, পদবী ও মোবাইল নম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার একটি ইমেইলে পাঠাতে বলা হয়েছে। বুথ স্থাপন কার্যক্রমে সহযোগিতা নিতে প্রয়োজনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। জালনোট ধরা পড়লে আইন ও নীতিমালা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস রয়েছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার অনুমোদিত পশুর হাটে স্থানীয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যাংকগুলোর আঞ্চলিক কার্যালয়কে নির্দেশনা প্রদানের অনুরোধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে অন্যান্য জেলাগুলোর থানা ও পৌরসভার অনুমোদিত হাটে বিভিন্ন ব্যাংকের দায়িত্ব বন্টনের জন্য সোনালী ব্যাংকের চেস্ট শাখাগুলোকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের বন্টিত দায়িত্ব অনুযায়ী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শাখাগুলোকে নোট যাচাই সেবা দেয়ার কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, নতুন এক হাজার টাকার নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য ১৩টি এবং ৫০০ টাকার ১১টি। বৈশিষ্ট্যগুলো হলো রং পরিবর্তনশীল হলোগ্রাফিক সুতা, অসমতল ছাপ, রং পরিবর্তনশীল কালি, উভয়দিক থেকে দেখা, অন্ধদের জন্য বিন্দু, জলছাপ, এপিঠ-ওপিঠ ছাপা, অতি ছোট আকারের লেখা, লুকানো ছাপা, সীমানাবর্জিত ছাপা, পশ্চাদপট মুদ্রণ, ইরিডিসেন্ট, স্ট্রাইপ ও বিশেষ কাগজ। জাল নোটগুলোর কাগজও হয় সাধারণ। ফলে নোটগুলো সাধারণত নরম প্রকৃতির হয়ে থাকে। বিশেষ করে রং পরিবর্তনশীল হলোগ্রাফিক সুতা ও কালি, জলছাপ এবং অসমতল ছাপ জাল টাকায় থাকে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র এফ এম মোকাম্মেল হক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে জাল নোট-সংক্রান্ত মামলা রয়েছে ৬ হাজার ২৫৭টি। আগের বছরের একই সময়ে মামলার সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৯৩৩টি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে জাল নোট বিষয়ে মামলা হয়েছে ১০৪টি। আগের বছরের একই সময়ে মামলার সংখ্যা ছিল ১৪৫টি। এসব মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। সঠিক তথ্য-প্রমাণ বা সাক্ষী না থাকায় মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। ফলে অপরাধীরাও পার পেয়ে যাচ্ছে। উপযুক্ত শাস্তিও দেয়া যাচ্ছে না জাল নোটের হোতাদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি জাল করা হয় ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট। অবশ্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তেও বাজারে নতুন এক হাজার টাকা ও সবুজ রঙের পাঁচশ’ টাকার নোট সবচেয়ে বেশি জাল হচ্ছে বলে উঠে এসেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সীমান্তের ওপার থেকে কোটি কোটি টাকার জাল নোট দেশে ঢুকছে। চাহিদা মেটাতে আবার রাজধানীতেও ছাপানো হচ্ছে জাল টাকা। এ চক্রের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকও রয়েছে। জানা গেছে, জাল নোট তৈরি ও বাজারজাতের সাথে জড়িত রয়েছে অন্তত অর্ধশত চক্র। এদের সাথে কিছু অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি চক্রকে শনাক্ত করেতে পেরেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পুলিশের ধারণা, তারা কয়েকটির সন্ধান পেলেও অন্তত অর্ধশত চক্র জড়িত এ জালিয়াতির সাথে।
জানা গেছে, গ্রামগঞ্জে এরা টাকার জাল নোট বিক্রি করে ৬০ ভাগ কমিশনে। অর্থাৎ কারখানা থেকে ১০০ টাকার একটি জাল নোট বিক্রি করা হয় ৪০ টাকায়, ৫০০ টাকার নোট ২০০ টাকায় ও ১০০০ হাজার টাকার জাল নোট বিক্রি হয় ৩০০ টাকায়। একটি নোট তৈরিতে খরচ হয় মাত্র কয়েক টাকা। আর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে। উল্লেখ্য, জাল নোট প্রতিরোধে ২০১১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক এ অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতুদ-ের সুপারিশ করে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ পাঠায়। এছাড়া জাল নোট ব্যবসায় জড়িতদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমেও শাস্তি দেয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু জাল নোটে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- সুপারিশের বিরোধিতা করা হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে। এরপর সেই সুপারিশ আর আলোর মুখ দেখেনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন