শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিআরটি ভোগান্তি

১৩ কি.মি. সড়কজুড়ে যানজট আর ধুলায় নাভিশ্বাস

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

যানজট আর ভোগান্তি কমাতে বিআরটি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। ২০১২ সালে নেয়া এ প্রকল্প ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বিআরটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও কাজ শুরু হয় তার আরও চার মাস পর। তখন বলা হয়েছিল, ২০২০ সালে কাজ শেষ হবে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) দ্বিতীয় সংশোধনী অনুযায়ী ২০২২ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কাজের যে গতি তাতে ২০২২ সালেও এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। এতে দুর্ভোগ কমানোর প্রকল্প উল্টো দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বছরের পর বছর। ৯ বছরে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্রিশের ঘরও পার হতে পারেনি। এমতবস্থায় চরম ভোগান্তি পোহাতে মানুষ।

ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার রাস্তায় শুধু ধুলা আর ধুলা। কয়েক স্তরের ধুলায় রাস্তা দিয়ে হাঁটলে সুস্থ থাকা দায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাড়কের বিশাল অংশ জুড়ে ধুলায় দমবন্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের। রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস রেপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলছে। আর উত্তরায় চলছে মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ। এসব কর্মযজ্ঞের উদ্দেশ্যই নিঘ্নিত ও দ্রুতগতির পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থাপনার প্রকল্পগুলোর ধীরগতিতে রাস্তাসহ আশ-পাশের দোকানপাট, ভবন, বাসা-বাড়ি সবই বিষাক্ত ধুলার আস্তরে ঢাকা। সরকারের অগ্রাধিকার এ প্রকল্পের করুণ দশায় রীতিমতো ধুঁকছে মানুষ।

যানজট এড়াতে যাত্রী পরিবহনে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে রাজধানীর বিমানবন্দর পর্যন্ত বাসের জন্য সাড়ে ২০ কিলোমিটার পৃথক লেনের (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি) নির্মাণকাজ চলছে ৫ বছর ধরে। প্রকল্পের নিয়মানুযায়ী বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা করা হয়নি। বরং অব্যবস্থাপনায় পুরো পথ এখন যানজটের দখলে। সাথে ধুলাতো আছেই। উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরের চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার যেতে এখন সময় লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা লাগছে। ধীরগতির এ রাস্তায় ধুলায় যাত্রীরা অসুস্থ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধুলা কমাতে নিয়মিত পানি ছিটানোর জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও সেটা মানা হয় না। এ নিয়ে এ সড়কে চলাচলকারী যাত্রী, চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ। বলাকা বাসের চালক মনিরুল বলেন, পেটের দায়ে গাড়ি চালাই। আগে এই রুটে দিনে-রাতে ৫ ট্রিপও মারতাম। এখন একবার যাওয়া আসা করতেই দিন শেষ হয়ে যায়। ধুলার কারণে চলতেও বিপদ, থেমে থাকলেও বিপদ। যাত্রীরা যানজটে আটকে ধুলা সহ্য করতে না পেরে মাঝপথে ভাড়া না দিয়েই নেমে যায়। কন্ডাক্টর, হেলপাররা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সব মিলে খুবই কষ্টের মধ্যে আছি আমরা। কবে এ কষ্ট শেষ হবে জানি না।

প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুরো নির্মাণ এলাকার রাস্তা ভাঙাচোরা। গাড়ি চলে হেলেদুলে। সড়কে বিআরটির উড়াল অংশের পিলার তৈরি শেষ, কয়েকদিন ধরে নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে। সড়কে বিশাল বিশাল গর্ত খুঁড়ে সেগুলো কোনোমতে ইট সুরকি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। ছোট ছোট অসংখ্য গর্ত এখনও বিদ্যমান। সরু আর এবরো থেবরো রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলতে গিয়ে আটকে থাকছে। সৃষ্টি হচ্ছে বিশাল যানজট। দু:সহ গরম আর ধুলায় কিলোমিটারজুড়ে দমবন্ধ পরিস্থিতি। যেখানে বিআরটি সড়কের মাঝবরাবর হচ্ছে, সেখানেও রাস্তার অবস্থা করুণ।

গত শুক্রবার সিএনজি অটোরিকশাযোগে ঢাকা থেকে গাজীপুরে গিয়েছিলেন একজন জেলা জজ। তিনি জানতেন না উত্তরার পর থেকে রাস্তার এই বেহাল দশার। যানজটে ধুলার মধ্যে আটকে ছিলেন এক ঘণ্টারও বেশি সময়। তিনি বলেন, মেগা প্রকল্পের কাজ বছরের পর বছর চলতে থাকলে মানুষ ভোগান্তি পোহাবে। কিন্তু সেটা কতোদিন? প্রকল্প চলাকালে বিকল্প সড়কের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। কিন্তু সেখানে ঘাটতি দেখা গেছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রবেশপথে এরকম অনিয়ম চলতে দেয়া ঠিক না। দিনে রাতে মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া জরুরি।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ৮ বছরে টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কের দুপাশের হাজার হাজার ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা হারিয়ে পথে বসার উপক্রম। বহু মানুষ স্নায়ু ও শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে মারাও গেছেন। শিশু ও বৃদ্ধদের অবস্থা আরও করুণ। এ কারণে যাদের সামর্থ আছে তারা অন্যত্র চলে গেছেন। যাদের নেই তারা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। নাটক নির্মাতা এম এ ছালাম জানান, তিনি গাজীপুরাতে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। সেখান থেকেই ঢাকায় আসা-যাওয়া করতেন। বিআরটি প্রকল্প শুরুর পর আর টিকতে পারেন নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারি রেজা বলেন, প্রতিদিন এ রাস্তায় চলতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। স্ত্রী-পরিবারকে ঢাকায় রেখেছি তাদের নিরাপত্তার জন্য। নিজে নিরাপদ হতে পারিনি চাকরির কারণে। প্রতিদিন অফিস যাতায়াতে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা এ পথেই নষ্ট হয় জানিয়ে তিনি বলেন, আসলেই আমাদের দুর্ভাগ্য। উন্নয়নের এমন জ্বালাতন সহ্য করতে হয়।

প্রকল্প সূত্র জানায়, রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে ২০০৫ সালে প্রণীত কৌশলগত পরিকল্পনায় (এসটিপি) তিনটি মেট্রোরেল ও তিনটি বিআরটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। ২০১৬ সালে অনুমোদিত সংশোধিত এসটিপিতে (আরএসটিপি) পাঁচটি মেট্রোরেল ও দুটি বিআরটির সুপারিশ রয়েছে। জয়দেবপুর থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত বিআরটি-৩ নির্মাণ করতে বলা হয়। বিআরটি পদ্ধতিতে সড়কের মাঝবরাবর বাসের জন্য পৃথক লেন নির্মাণ করা হয়। যেখানে সড়ক সরু, সেখানে ফ্লাইওভারে বাসের নির্ধারিত লেন করা হয়। বাস যেন কোনো সিগন্যালে না আটকা পড়ে, সে জন্য মোড়ে ওভারপাস করা হয়। এ পদ্ধতিতে ট্রেনের মতো বিনা বাধায় বাস চলতে পারে। যাত্রী ওঠানামায় রাস্তায় থাকবে স্টেশন।

পরিকল্পনায় জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা, টঙ্গী, উত্তরা, বিমানবন্দর, বনানী, মহাখালী, কাকরাইল, পল্টন, পুরান ঢাকা হয়ে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত ৪১ কিলোমিটার বিআরটি-৩ নির্মাণের সুপারিশ থাকলেও তা হচ্ছে না। জয়দেবপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে বিমানবন্দর পর্যন্ত কাজ চলছে কচ্ছপ গতিতে। এ অংশ নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্ভোগের কারণে বাকি অংশ নিয়ে আগ্রহী নয় সরকার।

চারটি প্যাকেজে বিআরটির কাজ চলছে। বাসের জন্য ১৭ কিলোমিটার পৃথক লেন হবে রাস্তার মাঝবরাবর। বিআরটি আইন, ২০১৬ অনুযায়ী এ লেনে প্রবেশ ও অন্য কোনো গাড়ি চালানো দন্ডনীয় অপরাধ। লেনের কাজ বাস্তবায়ন করছে সওজ। ৮৫৫ কোটি টাকার এ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের গেজহুবা। বাকি তিন কিলোমিটার হবে ছয়টি পৃথক ফ্লাইওভারে। ফ্লাইওভার ও সেতু নির্মাণ করছে সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। ৯৩৫ কোটি টাকার এ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের জিয়াংশু।

প্রকল্প সূত্র জানায়, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার কারণ হিসেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো চিঠিতে বলছে, প্রকল্প এলাকা কাজের উপযোগী ছিল না। রাস্তার নিচের ভূগর্ভস্থ পরিষেবা লাইন নকশা অনুযায়ী ছিল না। তা স্থানান্তরে বাড়তি সময় লেগেছে। রাস্তার পাশে ড্রেন না থাকায় পানিবদ্ধতায় দেরি হয়েছে। করোনা মহামারি কাজ অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এ প্রকল্পে বারবার বদল হয়েছেন পরিচালক। প্রকল্প পরিচালক ইলিয়াস শাহ বলেছেন, এখন কাজে গতি এসেছে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে। এ প্রসঙ্গে বুয়েটের শিক্ষক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, যানজট এড়িয়ে গণপরিবহনে চলার ভালো উপায় হলো বিআরটি। এ প্রকল্পে এত সময় লাগছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। ঢাকায় একের পর এক অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণ করে বিআরটির জায়গা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। খন্ডিত বিআরটি কতটা সুফল দেবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
মশিউর ইসলাম ১২ মার্চ, ২০২১, ১:০০ এএম says : 0
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কের বেশিরভাগ অংশে ভাঙাচোরা, যানবাহনে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি, তীব্র যানজট আর ধুলা-ময়লায় একাকার
Total Reply(0)
মোহাম্মদ মোশাররফ ১২ মার্চ, ২০২১, ১:০১ এএম says : 0
এই কাজ যে কবে শেষ হবে? কাজটা শেষ হলে আমরা একটু রক্ষা পেতাম। ধুলাবালির জন্য দোকানপাট খোলা রাখতে পারি না
Total Reply(0)
কামাল রাহী ১২ মার্চ, ২০২১, ১:০২ এএম says : 0
মহাসড়কের আগের সড়ক বিভাজনগুলো ভেঙে সড়কের মাঝেই ফেলে রাখা হয়েছে। দুই পাশে ড্রেজার দিয়ে মাটি কেটে রাখায় সারাক্ষণ ধুলাবালি উড়ছে।
Total Reply(0)
নাজারেথ স্বনন ১২ মার্চ, ২০২১, ১:০২ এএম says : 0
গত তিন-চার বছর তারা দুর্ভোগের মধ্যে আছি। এখন এসব থেকে রক্ষা পেতে চাই
Total Reply(0)
গাজী মোহাম্মদ শাহপরান ১২ মার্চ, ২০২১, ১:০৩ এএম says : 0
সড়কের ভাঙাচোরা আর খানাখন্দের কারণে আমাদের প্রতিদিনই যানজটের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা ৩০ মিনিটের পথ। কিন্তু এখন আমাদের সময় লাগে দুই ঘণ্টা। এই ভোগান্তির শেষ কবে হবে?
Total Reply(0)
মো. সাইফুদ্দিন ১২ মার্চ, ২০২১, ১:০৩ এএম says : 0
আমি নিজেও প্রতিদিন ধুলাবালির মধ্যে ওই সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করছি। মহাসড়কের ওই কাজটি চলছে বিআরটি প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণে। এর দেখভালের দায়িত্ব তাদের। তবে প্রকল্প কর্মকর্তাদের সড়কের যে অংশ দিয়ে যানবাহন চলছে সেটি চলার উপযোগী এবং ধুলাবালির জন্য পানি দিতে বলা হয়েছে।
Total Reply(0)
বাতি ঘর ১২ মার্চ, ২০২১, ১:০৪ এএম says : 0
বাংলাদেশের ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেমেই গলদ আছে।চার রাস্তার মোড়ে দুটি রাস্তা একসাথে চালু থাকলে সেখানে কিছুটা যানজট হবেই।সিগন্যালে সব গাড়ি সোজা পথে যায় না,কিছু গাড়ি ডানে যায়,কিছু গাড়ি ইউ টার্ণ করে।ফলে দুই রাস্তা একসাথে খুলে দিলে জট লাগে।এক রাস্তা একবার চালু রাখা উচিত।
Total Reply(0)
মেহেদী ১২ মার্চ, ২০২১, ১:০৪ এএম says : 0
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে পুলিশের শিক্ষা নেই বললেই চলে। ঢাকার ট্রাফিক ব্যাবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান আছে এমন বিশেষ সংস্থাকে এ দায়িত্ব দেওয়া উচিত।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন