বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিআরটি প্রকল্প : মান ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

| প্রকাশের সময় : ১৬ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত রোববার সকালে বিমানবন্দরের বিপরীত দিকের সড়কের পাশে প্রকল্পের গার্ডার তোলার সময় তা ভেঙ্গে পড়ে। এর আগে রাতে প্রকল্পের আব্দুল্লাহপুর পলওয়েল কনভেনশন সেন্টারের সামনে একটি গার্ডারের ঢালাই ধসে পড়ে। দুর্ঘটনায় চীনা দুই নাগরিকসহ ১০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দুর্ঘটনাস্থলের পাশ দিয়ে সরু সড়ক ধরে যান চলাচল করতে গিয়ে সৃষ্ট যানজট উত্তরা থেকে রাজধানীর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এতে যাত্রীরা অশেষ দুর্ভোগের শিকার হয়। বিগত ৯ বছর ধরে বিআরটি’র এই প্রকল্পের কাজ চললেও তার গতি এতটাই ধীর যে অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। দুর্ঘটনার কারণে এখন এ প্রকল্পের মান এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। গত রোববার গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এক ভিডিও বক্তব্যে প্রকল্পের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। টঙ্গীতে বিআরটি লেন নির্মাণে পুরনো ইট-বালু ব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, প্রকৌশলীরা ‘পার্সেন্টেজ’ নিয়ে নিম্নমানের কাজ করছেন।

বিআরটি প্রকল্পের কাজের ধীরগতি ও মান নিয়ে বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যে প্রকল্পের কাজ চলছে তার ধীরগতি নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়াল সড়ক যৌথভাবে নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ), সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকার প্রকল্পটি ২০১২ সালে শুরু হয়ে চার বছরে শেষ হওয়ার কথা। নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় আরো দুই দফা সময় বাড়ানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ৯ বছরেও এর কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩৮ শতাংশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো প্রকল্পের মেয়াদ যখন বৃদ্ধি করা হয়, একই সাথে এর ব্যয়ও বৃদ্ধি করা হয়। বিআরটি প্রকল্পের ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের কারণে বিগত ৯ বছর ধরে রাজধানী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত যেতে যাত্রীদের অশেষ দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। ব্যস্ততম এ সড়কে বিআরটি’র ফ্লাইওভার ও সেতু নির্মাণের জন্য মাঝ সড়ক বরাবর জায়গায় জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়েছে। এতে যেমন পুরো এলাকা ধুলায় ধূসরিত হচ্ছে, তেমনি সরু পথে যানবাহন চলাচল করতে গিয়ে প্রতিদিন তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলা প্রকল্পের কারণে উত্তরা এবং টঙ্গি এলাকার জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। প্রকল্পে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও দৃশ্যমান নয়, যার ফলাফল হিসেবে ভয়াবহ দুটি দুর্ঘটনা ঘটা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি যদি নদীর উপর কোনো সেতুর হতো তাহলে এই দুর্ঘটনার ফলে কি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, তা কল্পনাও করা যায় না। এই দুর্ঘটনায় অল্পতে রক্ষা পাওয়া গেছে। বিআরটি প্রকল্প সরকারের তিনটি সংস্থা বাস্তবায়ন কাজে নিয়োজিত। সরকারি যেকোনো প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি নতুন কোনো বিষয় নয়। নির্মাণ কাজের ধীর গতি, নকশার ত্রুটি এবং গুণগত মানও প্রশ্নবিদ্ধ। নানা ধরনের দুর্নীতিও এর সাথে জড়িয়ে থাকে। জনমনে এখন এ ধারণা বদ্ধমূল যেকোনো প্রকল্প মানেই কোনো না কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি থাকবে। এর সাথে জড়িত কিছু লোকের পকেট ভারি হবে। সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পকে ব্যক্তি স্বার্থে বাণিজ্যিক রূপ দেয়া হয়। উন্নত বিশ্বে যেকোনো বড় প্রকল্পের মেয়াদ যদি দশ বছর ধরা হয়, তা তারা শেষ করে অর্ধেকের কম সময়ে। আমাদের দেশে হয় এর উল্টো। প্রকল্পের মেয়াদ তিন বা চর বছর ধরা হলে তা শেষ করতে দশ বছরের বেশি লাগিয়ে দেয়া হয়। বিআরটি-এর এই প্রকল্পসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্পের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। কোনো প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও তার গুণগত মান এবং ত্রুটি নিয়ে প্রশ্নও উঠে। কুড়িল ফ্লাইওভার এবং মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের নকশার ত্রুটি নিয়েও একসময় প্রশ্ন উঠেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে যেকোনো প্রকল্প নেয়ার আগে এর সঠিক পরিকল্পনা, ফিজিবল স্টাডি এবং বাস্তবায়ন দক্ষতার বিষয়টি বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ থাকে। এসব দিক সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরীবিক্ষণ না করেই শুরু করে দেয়া হয়। বিমানবন্দর গোল চত্বরকে কেন্দ্র করে যে একাধিক প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেগুলো একইসঙ্গে শুরু করার ফলে পুরো এলাকা এলোমেলো হয়ে পড়েছে। অথচ সঠিক পরিকল্পনা এবং পর্যাপ্ত স্টাডি করে প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু করলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।

বিআরটি প্রকল্পের দুর্ঘটনা এর মান ও নিরাপত্তা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে তার দায় সরকারকেই নিতে হবে। প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় কেন বারবার বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যাখ্যা দেয়া জরুরি। বছরের পর বছর ধরে প্রকল্পের কাজ চলার নামে জনগণের অর্থের অপচয় কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বিআরটি প্রকল্পে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এতে সরকারের অন্যান্য মেগা প্রকল্পকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। আমরা মনে করি, যেকোনো প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে নির্ধারিত মেয়াদ ও ব্যয়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়। এর গুণগত মানের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের অর্থের অপচয়ের অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বছরের পর বছর ধরে প্রকল্প চলবে, ব্যয় বাড়বে, জনভোগান্তি সৃষ্টি হবে, তা চলতে পারে না। এজন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack+Ali ১৬ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ পিএম says : 0
O'Muslim how long you will sleep????????? they have destroyed our country in every way.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন