করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদে থাকতে দেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। টিকা দিতে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে সুরক্ষা পোর্টালের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে হয়। যে পোর্টালটি নিয়ন্ত্রণ করছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতর। অন্যদিকে টিকাদানের অন্যান্য সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু সুরক্ষা পোর্টালে চাহিদামতো সব সুবিধা না থাকায় টিকাদানে নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে।
আর তাই দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়লেও সুরক্ষা পোর্টালের জটিলতায় চাহিদা থাকলেও মানুষ টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারছে না। এতে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এদিকে গত প্রায় এক মাসে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকার নতুন কোনো চালান না আসায় কমে যাচ্ছে মজুদও। কবে নাগাদ পরবর্তী চালান আসবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ।
চাহিদা সত্তে¡ও টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে নিবন্ধন জটিলতা বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীবান্ধব নিবন্ধনব্যবস্থা এখনো চালু না হওয়াকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য কেউ কেউ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহির্বিশ্বে টিকার নানা ধরনের বিভ্রান্তির প্রভাব পড়ছে বলেও মনে করছেন। আবার কারো কারো মতে, টিকা হাতে না পাওয়ার কারণেই স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে টিকার নিবন্ধন ও গ্রহণ দুটি ক্ষেত্রেই কমিয়ে রাখার কৌশল বলে মনে করছেন। যার ফলে নিবন্ধন কমে যাচ্ছে।
এদিকে টিকার নতুন চালান শিগগিরই আসবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, বেক্সিমকোর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। যথাসময়ে আমরা টিকা পাচ্ছি। টিকা নিয়ে উদ্বেগ দ্রæতই কেটে যাবে বলেও উল্লেখ করেন ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, দেশে করোনা টিকা দেয়ার প্রথম ধাপে ৪০ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী ও ফ্রন্টলাইনারদের মিলে তিন কোটি ৯৫ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে গত এক মাস ৯ দিনে (২৭ ও ২৮ জানুয়ারি ধরে) ওই লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষের নিবন্ধন হয়েছে। গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ৫৭ লাখ ৭০ হাজার ১৯৮ জন। আগের দিন যা ছিল ৫৬ লাখ ৮০ হাজার ৬৪৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় নিবন্ধন করেছেন ৮৯ হাজার ৫৫৫ জন, যা ঘণ্টা হিসাবে হয় তিন হাজার ৭৩১ জন। অথচ গত মাসে কিছুদিন প্রতি ঘণ্টায় গড়ে পাঁচ হাজারের ওপরে নিবন্ধন হয়েছিল।
অন্যদিকে নিবন্ধনকৃতদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ মানুষ টিকা নিয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৪৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৫৪ জন। যা আগের দিন ছিল ৪৩ লাখ ৯৮ হাজার ৯৪ জন। এক দিনে নিয়েছেন ৯৭ হাজার ৮৬০ জন, যা আগের দিনের তুলনায় কিছুটা বেশি হলেও গত মাসের তুলনায় অনেক কম। এদিকে দেশে এ পর্যন্ত ভারত সরকারের উপহারসহ টিকা এসেছে মোট ৯০ লাখ ডোজ। সে হিসাবে গতকাল পর্যন্ত হাতে টিকা আছে ৪৫ লাখ ৪ হাজার ৪৬ ডোজ। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ডোজের টিকাই শুধু এখন হাতে আছে। টিকার নতুন চালান দ্রæত সময়ের মধ্যে না এলে এই টিকা দিয়েই দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সে হিসাবে দ্বিতীয় ডোজ শুরুর আগে কিছুদিন প্রথম ডোজের বিরতি দেয়া হতে পারে বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্ভরযোগ্য সূত্র।
এদিকে নিবন্ধন জটিলতার কারণ খুঁজতে গিয়ে সুরক্ষা পোর্টালে ১২টি সমস্যা চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। যা ইতোমধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতরকে জানানো হয়েছে। তবে সমস্যা সমাধানে এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনটি জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস (ম্যানেজম্যন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) বিভাগ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমানে সুরক্ষা পোর্টালে কেন্দ্র পরিবর্তন, টিকার স্ট্যাটাস আপডেট করা, পুরনো নিবন্ধিত ব্যক্তিদের টিকা নিতে এসএমএস পাঠানো, টিকার শিডিউল ঠিক করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে জটিলতা রয়েছে। এমনকি কোন শ্রেণির কত মানুষ টিকা নিয়েছে সেটিও জানা যাচ্ছে না। এসব কারণে টিকাদানে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
কেন্দ্র পরিবর্তনের জটিলতা : কেন্দ্র পরিবর্তনের জন্য একটি মডিউল সুরক্ষা থেকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে শুধুমাত্র যারা নিবন্ধন করেছেন অথচ সিডিউল করা হয়নি অথবা টিকা দেয়া হয়নি তাদের কেন্দ্র পরিবর্তন করা যাবে। অথচ ৭ থেকে ১৪ ফেব্রয়ারির মধ্যে যারা নিবন্ধন করে টিকা নিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই নিয়েছেন অন্য কেন্দ্র গিয়ে। ফলে কেন্দ্র পরিবর্তন নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া অনেক নাগরিক প্রথম কেন্দ্র টিকা দেয়ার পর বদলিজনিত কারণে অন্য জায়াগায় চলে গিয়েছিলেন বিশেষ করে সেনাবাহিনী এবং পুলিশের অনেক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মচারি। তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হচ্ছে।
পেছনের তারিখে সিডিউল করে টিকা প্রদান: গত ৭ থেকে ১৪ ফেব্রয়ারি অনেকে নিবন্ধন ছাড়াই টিকা দিয়েছেন। তারা তাদের নিজ নিজ কেন্দ্র নিবন্ধন করলেও পেছনের ডেটে সিডিউল করার সুবিধা না থাকায় জাটিলতায় পড়েছেন। যার সমাধান করা প্রয়োজন।
হোয়াইটলিস্টিং সুবিধা স্বাস্থ্য অধিদফতরকে না দেয়া: অধিদফতর থেকে প্রতিদিন এনআইডি তালিকা পাঠানোর পরেও অনেকের এনআইডি সার্ভারে নিবন্ধন নিচ্ছে না। এক্ষেত্রে এনআইডি তালিকা আইসসিটি ডিভিশনকে পাঠানো হলেও একই তালিকার অনেকে বাদ পড়ছেন। এক্ষেত্রে অতি দ্রæত হোয়াইটলিস্ট করার ব্যবস্থা স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাতে থাকা প্রয়োজন।
টিকার স্ট্যাটাস আপডেট করা: অনেক কেন্দ্র থেকে ভুলে টিকা প্রদান করে ফেলছে। এক্ষেত্রে টিকা প্রদান উইথড্রো করার কোন ব্যবস্থা নেই।
টিকার শিডিউল ঠিক করা: অনেক সময় অনেক কেন্দ্র থেকে ভুল তারিখে সিডিউল করে ফেলে। এক্ষেত্রে শিডিউল ঠিক করার ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি। ফলে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
পুরনো নিবন্ধিত ব্যক্তি যারা টিকা নেয়নি তাদের এসএমএস পাঠানো: আগে যারা নিবন্ধন করেছেন কিন্তু এখনো টিকা নেননি, তাদের টিকা নিতে মনে করিয়ে দিতে এসএমএস পাঠানোর ব্যবস্থা থাকলে অনেকেরই সুবিধা হতো। যা করা হচ্ছে না।
এমআইএসকে ওটিপি ছাড়া নিবন্ধনের সুবিধা দেয়া: অনেক অনিবন্ধিত ব্যক্তি যারা আগে টিকা নিয়েছেন তাদের নিবন্ধনে আনতে এমআইএসকে ওটিপি ছাড়া নিবন্ধন সুবিধা দেয়া প্রয়োজন।
ওটিপি ছাড়া টিকা কার্ড দেখা : এমন একটি ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন যাতে ওটিপি ছাড়া সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র থেকে তার টিকার কার্ড দেখা যায়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি টিকার কার্ড নিয়ে আসে না। জন্ম তারিখ এবং এআইডি জানা না থাকলে টিকা কার্ড দেখা সম্ভব হয়নি। এজন্য এমআইএস এর আরও একটি এক্সেস প্রয়োজন ওটিফি ছাড়া টিকা কার্ড দেখার জন্য।
সিডিউল এর ডেট প্রদান ছাড়া টিাকাদান : বর্তমানে কোন এনআইডি খুজে তার সিডিউল ডেট এবং টিকাদান ডেট এই দুটো ডেট দিলেই তার টিকাদান সম্পন্ন হয়। অনেকে দুটো দিতে ভুল করার জন্য সিস্টেমে দেখায় টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সম্পন্ন হয়নি। এজন্য অনেকে তাদের টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করলেও আসেল তাদের টিকাদান সম্পন্ন হয়নি। শুধুমাত্র টিকাদানের তারিখ দিলেই যেন তাদের টিকাদান সম্পন্ন হয়ে যায় সেটার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এর সঙ্গে সিডিউলের তারিখ দেয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।
কেন্দ্র থেকে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা: রাজধানীর বেশকিছু কেন্দ্র আছে সেখানে তাদের নিবন্ধনের কোটা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বেশ কিছু পুরোন নিবন্ধিত ব্যক্তির টিকাদান বাকি রয়েছে। বিশেষ করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এক্ষেত্রে ওইসব প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব নিবন্ধন ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
ড্যাশবোর্ডে শিডিউল এবং এসএমএস পাঠানোর সংখ্যা দেখা : বর্তমানে ড্যাসবোর্ডে কতজনকে সিডিউল করা হয়েছে এবং কতজনকে এসএমএস পাঠানো হয়েছে সেটি দেখার কোন ব্যবস্থা নেই।
কোন ক্যাটাগরিতে কতজনের নিবন্ধন : এ পর্যন্ত কোন ক্যাটাগরিতে কতজন নিবন্ধন করেছেন এবং কতজন টিকা পেয়েছেন সেটি সুনির্দিষ্টভাবে দেখার ব্যবস্থা করা। যাতে ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট প্লান কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে সেটি বোঝা যায়। কিন্তু সুরক্ষা পোর্টালে সেই ব্যবস্থাও করা হয়নি।
নিবন্ধনে নানামুখী জটিলতার বিষয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম বলেন, নিবন্ধন জটিলতা থাকছে না। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে কারিগরি অনেক বিষয় বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তেমন কোনো জটিলতা নেই। আর নিবন্ধন তুলনামূলক কতটা কমেছে তাও দেখতে হবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, টিকা গ্রহণের প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে নিবন্ধনজনিত জটিলতা; এখন পর্যন্ত আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীবান্ধব নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করতে পারিনি। ফলে বিষয়টিকে অনেকেই ঝামেলা মনে করছে। আবার অনেকেই মনে করছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে গেছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি উল্টো চিত্র। মানুষের বেপরোয়া আচরণের কারণে দেশে সংক্রমণ আবার দ্রুত বাড়ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন