বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুজিব শতবর্ষ সংখ্যা

উপজাতিদের অধিকার রক্ষায় বঙ্গবন্ধু সব সময় সচেষ্ট ছিলেন

মাহের ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে ইতিহাসের দায় যেমন বলা হয়েছে, তেমনি যথার্থই বলা হয়েছে যে, এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। স্বাভাবিকভাবেই ইতিহাসের লম্বা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে এই সমস্যার রং ও ধরন এবং দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে সময়ের সাথে সাথে। ফলে, যা ছিল এক সময় নিতান্তই আইন শৃঙ্খলজনিত বিষয়, তা আরেক সময় পরিগণিত হয়েছে অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক এমনকি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় হিসেবেও। এর সূত্রপাত বহু আগে হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সরকারের কিছু কিছু কর্মকান্ডকে এই সমস্যার সাথে জড়ানোর অনিয়মিত প্রচেষ্টা দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। সঙ্গতকারণেই, এ প্রসঙ্গে তৎকালীন সরকারের কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়ে যায়।
স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই যখন পুরো দেশ স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি নির্দয় ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন ব্যতিক্রম। শুধু তাই নয়, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের প্রতিও প্রতিশোধপরায়ন ছিলেন না, যার প্রমাণ মিলে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ২৯ জানুয়ারিতে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের এক প্রতিনিধিদল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে। তিনি উক্ত প্রতিনিধিদলকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ক. বাংলাদেশ সরকারের চাকুরীতে উপজাতীয়দের ন্যায্য হিস্যা প্রদান করা হবে। খ. উপজাতীয়দের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি পুরাপুরিভাবে সংরক্ষণ করা হবে। গ. উপজাতীয়রা তাদের ভূমির অধিকার আগের মতোই ভোগ করতে থাকবেন। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২।)
উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ সালে আইএলও কনভেশন-১০৭ বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত হয়। যেখানে উপজাতি স¤প্রদায়ের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ইত্যাদি সকল অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকার করার পাশাপাশি নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষপের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু পাহাড়ের উপজাতিদের প্রতি মূলত আন্তরিক ছিলেন, সংবেদনশীল ছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে ধর্মকে সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এই সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে পাহাড়িদের পক্ষেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৫ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনার সময় সংসদ সদস্য এমএন লারমা রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানদিতে পবিত্র কোরান এবং গীতা পাঠের পাশাপাশি ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ করার প্রস্তাব করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ সময় হতেই অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর আমলেই রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানাদিতে ত্রিপিটক এবং বাইবেলও পাঠ করার চর্চা শুরু হয়। (ঝুবফ অনঁ জড়ুযধহ, (২০১৬), ঞযব ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং, উযধশধ, কধষরশড়ষড়স চৎড়শধংযড়হধ. ২০১৬, ঢ়. ১১৫. )
একথা সত্যি যে, বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের বিপক্ষে ছিলেন। যে কারণে ত্রিদিব রায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রার্থিতার বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। (রইসুল হক বাহার অনুদিত প্রিয়জিত দেব সরকার রচিত ‘পশ্চিম পাকিস্তানের শেষ রাজা’ বাতিঘর, চট্টগ্রাম, ২০১৬।) বঙ্গবন্ধুর এহেন মনোভাবের কথা জানতে পেরেই হয়ত বা এমএন লারমা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করেননি। (সিদ্ধার্থ চাকমা, প্রসঙ্গঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম, কলকাতা, নাথ ব্রাদার্স, বঙ্গাব্দ ১৩৯২, পৃ-৩৮।) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করলেও বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের প্রতি কখনোই বিরূপ ভাবাপন্ন ছিলেন না। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ও উদারতার ধারা অব্যাহত ছিল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেই তিনি চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে শ্রীমতী সুদীপ্তা দেওয়ানকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর চেম্বারে সাক্ষাৎ করে সংসদ সদস্য সুদীপ্তা দেওয়ান বঙ্গবন্ধুকে তার নির্বাচনী এলাকা এবং উপজাতীয় জনসাধারণের সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘উপজাতীয় এলাকার জনগণের জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করা হবে। উপজাতীয় জনগণ ও স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক এবং অন্যান্য নাগরিকদের মতই সমান সুযোগ ও সুবিধা ভোগ করবে।’ (দৈনিক পূর্বদেশ, ৭ জুন ১৯৭৩।) শুধু তাই নয়, তিনি যে পাহাড়ের অধিবাসীদের দুর্দশায় ব্যথিত ছিলেন, সেটা উপলব্ধি করতেও দেরী হয় না। ‘প্রধানমন্ত্রী দুঃখের সঙ্গে বলেন, অতীতের ঔপনিবেশিক সরকারের শোষণ ও অবহেলার ফলেই উপজাতীয় এলাকায় কোনরূপ উন্নয়ন হয়নি। বঙ্গবন্ধু বলেন, উপজাতীয় এলাকার জনগণের দুঃখের দিনের অবসান হয়েছে। উপজাতীয় জনগণও স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক এবং অন্যান্য নাগরিকদের মতই সমান সুযোগ ও সুবিধা ভোগ করবে।’ (ঘধনধ ইরশৎধস করংযড়ৎব ঞৎরঢ়ঁৎধ (ঊফ.), (২০১৭), ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং: ঔড়ঁৎহবু ঃড়ধিৎফং চবধপব ধহফ চৎড়ংঢ়বৎরঃু. উযধশধ: গরহরংঃৎু ড়ভ ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং অভভধরৎং.)
সংসদ সদস্যের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পার্বত্য অঞ্চলের শিক্ষার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্যে বিশেষ আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ক. ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ৩টি। খ. চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ২টি। গ. ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ৩টি। ঘ. চট্টগ্রাম প্রকৌশল কলেজ ২টি। ঙ. ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৩টি। চ. কৃষি কলেজ ২টি। ছ. পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ৫টি উল্লেখযোগ্য। (দৈনিক পূর্বদেশ, ১৮ জুন, ১৯৭৩।)
এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৈদেশিক বৃত্তি মঞ্জুর করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই বিভিন্ন উপজাতীয় ছাত্র-ছাত্রীকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি, কিউবা এবং ভারতে পাঠানো হয়। উপজাতীয় ছাত্র ছাত্রীদের আবাসিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য পাকা দালান বরাদ্দ করা হয়। মূলত পাহাড়ের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপের ফলে, যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৬১ সালে শিক্ষার হার ছিল ১২.৭৯%, ১৯৭৪ সালে তা ১৯.৪৮% এ উন্নীত হয়। (ডাঃ এ কে দেওয়ান, ২০১৫, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু, দ্বিতীয় সংস্করণ)
প্রশাসনিক দৃষ্টি ভঙ্গীতেও বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের স্বার্থ রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। সে কারণেই ১৯৭৩ সালের ১১ ডিসেম্বর চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে এক উপজাতীয় প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে ১৯০০ সালের ব্রিটিশ রেগুলেশন প্রবর্তনের অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন। উক্ত প্রতিনিধিদল ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের জাতীয় বৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য এই জেলার বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা প্রদানের দাবী জানান।’ এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ‘প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিধিদলকে আশ্বাস দেন যে, নির্বাহী আদেশ বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ করা হবে এবং বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে।’ (জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ (২য় মুদ্রণ), রাঙামাটি, স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা, ১৯৯৩, পৃ. ৫২-৫৩।)
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্রæয়ারিতে দ্বিতীয়বারের মতো রাঙামাটি গিয়ে স্থানীয় এমপি, সার্কেল চিফ, হেডম্যান, কারবারী, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং অগণিত জনসাধারণের সামনে ঘোষণা করেছিলেন, ‘জাতীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার অবশ্যই রক্ষা করা হবে।’ তিনি আরো বলেছিলেন যে, ক. উপজাতীয়রা তাঁদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য অন্যান্য নাগরিকের মতো একই সুবিধা ভোগ করবেন। খ. এই এলাকার জনসাধারণের জন্য স্কুল স্থাপন এবং চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে। গ. উপজাতীয় জনসাধারণের উপর কোনো মহলের নির্যাতনই সরকার বরদাশত করবে না। তাঁদের জমি ও ধন-সম্পত্তি কাউকে স্পর্শ করতে দেয়া হবে না। ঘ. জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে স্থানীয়দের অধিকতর সুবিধা দান, বন সম্পদ রক্ষা এবং ব্যবসা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে স্থানীয়রা যেন বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করা হবে। (দৈনিক বাংলার বাণী এবং দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ ফেব্রæয়ারি ১৯৭৫।)
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় শুধু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সক্রিয় সহযোগিতা করেননি, বরং পরবর্তীতেও বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা অব্যাহত রাখেন। এতদসত্তে¡ও, রাজপরিবারের আর্থিক সংকট চলছিল বলে বঙ্গবন্ধু নিজেই ত্রিদিব রায়ের ছোট ভাই সমিত রায়কে রাঙামাটি সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের আদেশ দিয়েছিলেন। (শরদিন্দু শেখর চাকমা, বংগবন্ধু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম, ঢাকা, বিভাস, ২০১১, পৃ. ৯।) যে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে, জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের আহŸান জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার (চযরষধফবষঢ়যরধ, চবহহংুষাধহরধ, ঔঁষু ২৬, ১৯৭৩, ঢ়ধমব ১৩.); সেই ত্রিদিব রায়ের পুত্র দেবাশীষ রায়কে চাকমা রাজা হিসেবে ঘোষণা প্রদান করা হয়। (দেওয়ান, ২০১৫, পৃ-২৬।) বঙ্গবন্ধু যে প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন না, তার প্রমাণ মেলে যখন ১৯৭৩ সালে রাঙ্গামাটিতে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, ত্রিদিব রায়ের অপরাধের জন্য রাজ পরিবারের অন্যদেরকে দায়ী করা উচিৎ নয়।
বঙ্গবন্ধু প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যোগ্য উপজাতিদের বহাল ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, তাঁর শাসনামলেই শরদিন্দু শেখর চাকমাকে কক্সবাজার মহকুমায় মহকুমা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে কোনো উপজাতিকে মহকুমা প্রশাসক পদে পদোন্নতি দেয়া হয় নি। এছাড়াও সেনাবাহিনীর মেজর মংখ্য’কে লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয় এবং বিমলেশ্বর দেওয়ানকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বাকশাল গঠনের পরে উপজাতিদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করানো হয়। যেমন, জেলা গভর্নর পদে খাগড়াছড়িতে মং চীফ এবং বান্দরবানে বোমাং চিফকে নিয়োগ করা হয়। (চাকমা (বঙ্গাব্দ ১৩৯২), প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২।) এর পাশাপাশি বাকশালের জেলা সেক্রেটারি হিসেবে খাগড়াছড়িতে অনন্ত বিহারী খীসা, বান্দরবান জেলায় কে এস প্রু এবং রাঙামাটি জেলায় চারু বিকাশ চাকমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, সংসদ সদস্য এম এন লারমাকে পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনের সদস্য হিসেবে ১৯৭৪ সালে লন্ডনে প্রেরণ করা হয়েছিল। (যঃঃঢ়ং://নহ.রিশরঢ়বফরধ.ড়ৎ, ২৭ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে দেখা হয়েছে।)
উপজাতিদের ভাগ্যোন্নয়নের পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকে ভেঙ্গে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলা গঠনের আদেশ দেয়া হয়। এছাড়াও ১৯৭৩ সালের ৯ আগস্ট পার্বত্য জেলার জন্য পৃথক উন্নয়ন বোর্ড গঠনের ঘোষণা করা হয়। (দৈনিক বাংলাদেশ সংবাদ, ১০ আগস্ট ১৯৭৩।) অধিকন্তু ১৯৭৩-৭৪ সালের বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেমন, ‘সরকারি জুম কর (৬ টাকার মধ্যে ১.২৫ টাকা) মওকুফ, বেতারে ‘উপজাতি’ অনুষ্ঠান প্রচার, বাংলা একাডেমি কর্তৃক উপজাতীয় গল্প, কবিতা, ছড়া, লোকগাথা ও রূপকাহিনী প্রকাশ ইত্যাদি।’ (কমরেড খালেকুজ্জামান রচিত ‘পার্বত্য চুক্তি প্রসঙ্গ’ শীর্ষক প্রবন্ধ হতে উধ্বৃত। বর্ণিত প্রবন্ধটি জিবøু রহমানের পার্বত্য চট্টগ্রাম-সমস্যা ও সমাধান (১৯৭২-১৯৯৮), শ্রীহট্ট প্রকাশ, সিলেট, ২০১৮ হতে প্রকাশিত গ্রন্থে পরিশিষ্ট হিসেবে (পৃ. ১৫৬-১৮৮) সন্নিবেশিত করা হয়েছে।)
রাঙ্গামাটি শহর রক্ষার জন্যে বঙ্গবন্ধু বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৪ আগস্ট বাংলার বাণীতে প্রকাশিত ‘রাঙামাটি শহর রক্ষা ও উন্নয়নে দু’কোটি টাকার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে’ শীর্ষক এক সংবাদ হতে জানা যায় যে, শুধু ভাঙ্গনের হাত থেকে রাঙামাটি শহর রক্ষা করাই নয়, বরং সংযোগ সড়ক নির্মাণও করা হবে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের এলাকা বিদ্যুতায়নের পরিকল্পনাও ঐ সময়ে গ্রহণ করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে পুলিশ এবং রক্ষী বাহিনীতে যথাক্রমে তিন শত এবং দুই শত উপজাতিকে নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়াও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও উপজাতীয়দের তুলনামূলকভাবে বেশি হারে সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আনারস বাজারজাতকরণের জন্য এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। (চাকমা (২০১১), প্রাগুক্ত, পৃ. ১২।)
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পুনর্বাসন শুরু হয়েছিল। অথচ, বাস্তব চিত্র ছিল তাঁর পুরো বিপরীত। তৎকালীন জেলা প্রশাসক এএম. আবদুল কাদের এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক একে. ফজলুল হক দুজনে মিলে বঙ্গবন্ধুকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্য জেলা থেকে বাঙালি পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত জমি নেই। যার ফলে বঙ্গবন্ধু রাঙ্গামাটির পূর্বতন জেলা প্রশাসক ‘জিন্নাত আলীর পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পুনর্বাসনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১১-১২।)
শরদিন্দু শেখর চাকমা রচিত ‘বঙ্গবন্ধু ও পার্বত্য চট্টগ্রাম’ এবং ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সেকাল একাল’ গ্রন্থদ্বয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। লেখক জানিয়েছেন যে, রাঙ্গামাটির তৎকালীন জেলা প্রশাসক এএম. আব্দুল কাদের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের উপ-সচিব থাকাকালে বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, উপজাতিরা সহজ সরল মানুষ এবং পাকিস্তান আমলে তারা নানা ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়েছিল। এছাড়া শুধুমাত্র রাজা ত্রিদিব রায় এবং অং শুয়ে প্রু চৌধুরীর কারণে সকল চাকমা এবং অন্যান্য উপজাতিদের বাংলাদেশ বিরোধী বলে ধারণা করা ঠিক হবে না। (প্রাগুক্ত, পৃ. ১২।) শরদিন্দু শেখর চাকমা আরো জানিয়েছেন যে, ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বাকশালে যোগদানের সময় বঙ্গবন্ধু নিজেই এম এন লারমাকে বলেছিলেন, ‘তাঁর কিছু লোক চাকমাদের সম্পর্কে তাকে ভুল তথ্য দিয়েছিল, সেটা তিনি পরে বুঝতে পেরেছেন, তিনি এখন চাকমাদের জন্য কিছু করতে চান।’ (চাকমা (২০১১), প্রাগুক্ত, পৃ. ১১।)
স্মরণযোগ্য যে, দাপ্তরিক কারণ ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখার এবং তাঁর মনোভাবের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান-এর। ছাত্র জীবনে বঙ্গবন্ধু এবং জেনারেল খলিল দুজনেই একই হোস্টেলে থেকে লেখাপড়ার সুবাদে যে পরিচয় গড়ে উঠেছিল, ১৯৭৩-৭৫ সালে তৎকালীন বিডিআর-এর মহাপরিচালক পদে আসীন হওয়াতে সে যোগাযোগে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছিল। তৎকালীন বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে লিখিত ‘কাছে থেকে দেখাঃ ১৯৭৩-১৯৭৫’ গ্রন্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মনোভাবের এক খন্ড চিত্র উঠে এসেছে। তিনি জানিয়েছেন, ‘বঙ্গবন্ধু পাহাড়িদের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন।’ শুধু তাই নয়, পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে তিনি দ্ব›েদ্বর পরিবর্তে আলোচনা, সমঝোতা আর সহ-অবস্থানের মতাবলম্বনের পক্ষপাতি ছিলেন। বর্ণিত বইয়ের কয়েকটি ঘটনা হতে বুঝা যায় যে, যদিও ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু পাহাড়ে সমতলের বাঙালি পুনর্বাসনের পক্ষে ছিলেন না, তা সত্তে¡ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-সরঞ্জাম বৃদ্ধি করেছিলেন। (মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, কাছে থেকে দেখাঃ ১৯৭৩-১৯৭৫ (৩য় মুদ্রণ), ঢাকা, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৮, পৃ. ২০৫-২০৯।)
নূহ-উল-আলম লেনিন-এর (১৯৯৯) কন্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু পাহাড়ের উপজাতিদের প্রতি মূলত আন্তরিক ছিলেন, সংবেদনশীল ছিলেন। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামঃ সমুখে শান্তি পারাবার’ বইয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি উপজাতিদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাঁর শাসনামলে উপজাতিদের স্বার্থ রক্ষায় তাই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। (নূহ-উল-আলম লেনিন, পার্বত্য চট্টগ্রামঃ সমুখে শান্তি পারাবার, ঢাকা, হাক্কানী পাবলিশার্স, ১৯৯৯, পৃ. ৬৭।) প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বর্তমান চাকমা সার্কেল চীফ দেবাশীষ রায় ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রাংগামাটিস্থ জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মতামত ব্যক্ত করেছেন, ‘আমি মনে করি, যদি ১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধুকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো, সেই হত্যা যদি না হতো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে আমরা যে সংকটে রয়েছি, এর চাইতে আমরা অনেক বেশি হয়তো আশানুরূপভাবে সেই স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসন না পেতাম, কিন্তু আমার বিশ্বাস, যে কোন একটা বোঝাপড়া হয়ে যেতো বঙ্গবন্ধু ও এমএন লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য জনগণের।’ (রাজা দেবাশীষ রায়, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এম এন লারমা একজন আদর্শ দিক নির্দেশক, ১০ই নভেম্বর স্মরণে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, রাঙামাটি, ১০ নভেম্বর ২০১৮, পৃ. ৯-১০।)
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় যে, তিনি পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের সকল প্রকার স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। এছাড়াও অনুন্নত এলাকা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি তাঁর একটা বিশেষ নজর ছিল। যার ফলে এখানকার অধিবাসীদের তিনি সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন