বঙ্গবন্ধু নামটা শুনলেই কেন জানি না গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর মহান আত্মত্যাগ, মহান নেতৃত্ব, বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, জ্বালাময়ী ভাষণ, পাহাড়সম মমতাÑ সব কিছু চিন্তা করলে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’র আসনে মন ভরে না। মনে হয়, আরো বড় কোনো আসনে তাঁকে বসিয়ে ও অধিষ্ঠিত করতে পারলে তবেই তাঁকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হতো। দেশের জন্য ওনার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করলে বারবার শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়।
জাতির জনকের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সর্বক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা ছিল সুনিপুণ। তিনি সব সময় শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে ভেবেছেন এবং সেই ভাবনার মধ্যে ছিল মৌলিকত্ব, ছিল নতুনত্ব, ছিল বিচক্ষণতা, ছিল সৃষ্টিশীলতা, ছিল দেশের মেধাচর্চাকে এগিয়ে নেয়ার ব্রত, ছিল দেশের মানুষকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষিত করার কৌশল। স্বাধীনতার পর যখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, অর্থনীতি ও অবকাঠামো চরমভাবে বিপর্যস্ত, তখন বঙ্গবন্ধু দেবদূতের মতো এসে এদেশের হাল ধরেছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশের মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সে শিক্ষা অবশ্যই হতে হবে বিজ্ঞানধর্মী। সেজন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া লাখ লাখ স্কুল-কলেজকে পুনর্গঠিত করেছিলেন। বিজ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা ও প্রচেষ্টা ছিল স্বাধীনতার পর সরকার গঠনের সাথে সাথে তার একের পর এক প্রতিফলন শুরু হয়। ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই দেশসেরা বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (তৎকালীন পিসিএসআইআর) প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক ড. কুদরত-এ-খুদাকে নিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠন করার মাধ্যমে প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও শিক্ষাকে কতটুকু মূল্যায়ন করেছিলেন।
বিশ্ব তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে প্রবেশের এক দশকের মাথায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম হয় বাংলাদেশের। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হিসেবে গড়ে তোলা এবং তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্যোগী করতে জাতির পিতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ পায়। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন, যার সুফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশ টেলি কমিউনিকেশন আদান-প্রদানে মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করছে।
পরমাণু গবেষণার মাধ্যমে দেশকে কীভাবে উপকৃত করা যায় সেদিকে বঙ্গবন্ধু নজর দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার আগ্রহে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় সাভারে ২৬৫ একর জমি পরমাণু গবেষণার জন্য বরাদ্দ প্রদান করা হয়, যার ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন ও দর্শনকে ধারণ করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে চলেছে।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে চারদিকে শুরু হয়েছিল রোগ-শোক এবং হাহাকার। আন্তর্জাতিকভাবেও চলছিল নানান সংকট। চারিদিকে দেখা দিয়েছিল খাদ্য সংকট। তখন বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তিকে প্রাধান্য না দিলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর খাবার যোগানো খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে এবং তখন থেকেই তিনি কৃষি গবেষণার উন্নয়নে জোর দেন। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন-সহ আরও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ভিতর দিয়ে বিজ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি জাতির পিতার যে একাগ্রতা ছিল, সেটার স্পষ্ট প্রতিফলন পাওয়া যায়। ধান গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতির পিতা ১৯৭৩ সালে আইন পাসের মাধ্যমে ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। এছাড়াও কৃষি গবেষণার মাধ্যমে দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক প্রতিষ্ঠান সৃজন করেন। যেখানে বিজ্ঞানীদের নিরলসভাবে গবেষণার ফল আমরা প্রতিনিয়ত হাতেনাতে পাচ্ছি। দেশ স্বাধীনের পরে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর খাবার যোগান কঠিন হলেও এখন দেশে আঠারো কোটি জনগণের খ্যাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েও খাবার উদ্বৃত থাকে।
১৯৫৫ সালে বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার পরিচালনায় পিসিএসআইআর নামে যাত্রা শুরু করে স্বাধীনতার পরে দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ’ (বিসিএসআইআর) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ড. কুদরাত-এ-খুদার অক্লান্ত পরিশ্রমে চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে গড়ে ওঠে আরও দুইটি শাখা গবেষণাগার। পরবর্তীতে জয়পুরহাট এবং ঢাকার সাভারে দুইটি শাখা গবেষণাগার স্থাপিত হয়। সকল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দেশের বহুমুখী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিসিএসআইআর-সহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আমাদের দেশ অন্যান্য উন্নত দেশের কাতারে নিজেদের জায়গা করে নেবে, সেই আশাটুকু আমরা ব্যক্ত করতেই পারি।
লেখক: গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজো, ফুজিয়ান, চীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন