কারখানায় উৎপাদিত পণ্য কিংবা সেবাখাতের বিভিন্ন ধাপে মূল্য সংযোজন করা সহজ হলেও মাঠ ফসল বা কৃষি খামারে উৎপাদিত পণ্য এবং সেবার যে কোন ধাপে মূল্য সংযোজন করা অনেক কঠিন। তাই, বিগত দুই দশক ধরে কৃষি সেক্টরে ভ্যালু চেইন উন্নয়ন বিষয়টি জোরালোভাবে শোনা যাচ্ছে। আর্ন্তজাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), বিশ্ব ব্যাংক, জাইকা, ইউএসএইডসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকার এবং এনজিও’র মাধ্যমে বেশ কিছু কৃষি পণ্য যেমন সবজি, ফল, ডেইরি প্রভৃতির ভ্যালু চেইন উন্নয়নে অনুদান এবং ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। ভ্যালু চেইন উন্নয়নের বিষয়টি এখন আমাদের পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে। এই বিষয়ে প্রায়ই সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
কৃষি পণ্যের ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রক্রিয়া যত দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তত টেকসই ও সমৃদ্ধ হবে। কারণ কৃষিশুমারি ২০১৯ এর প্রিলিমিনারি রিপোর্টে দেখা যায়, দেশের মোট পরিবারের ৪৬ দশমিক ৬১ ভাগ এখনও কৃষির উপর নির্ভরশীল। আমরা বিশে^ ধান উৎপাদনে ৩য়, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, আলু উৎপাদনে ৭ম, আম উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম অবস্থানে আছি। তারপরও প্রতি বছর কৃষিজাত পণ্য আমদানিতে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ^ব্যাংক জানিয়েছে, খাদ্য ও কৃষি পণ্য আমদানিতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের ব্যয় হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন উন্নত দেশগুলোর চেয়ে পুরোপুরি আলাদা হবে। কেননা আমাদের দেশে ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সংখ্যা বেশি। যাদের আমরা মাঝারি বা বড় কৃষক পরিবার বিবেচনা করছি, কৃষিভিত্তিক কারখানা স্থাপনের সুযোগ বা দক্ষতা কোনটি তাদের নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৩ এর হিসাব অনুযায়ী, মোট কৃষক পরিবারের ২৮ ভাগ ভূমিহীন। যাদের জমির গড় আয়তন সর্বোচ্চ ০.১৫ (শূন্য দশমিক ১৫) বিঘা। একই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সংখ্যা ৪০ দশমিক ২ ভাগ। যাদের চাষের জমির গড় আয়তন সর্বোচ্চ ১.৪৯ (১ দশমিক ৪৯) বিঘা। সঙ্গতভাবেই বলা যায়, তাদের পক্ষে এককভাবে কোনো ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। প্রাণীসম্পদ বা মৎস্য সম্পদ সেক্টরেও একই কথা প্রযোজ্য।
কৃষি সেক্টরে ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আসলে সরকারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। কাঁচামাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন্ ধাপে উৎপাদনের মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো এবং পণ্য বিশেষে পুনর্ব্যবহার পর্যন্ত সকল ধাপ ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অংশ। তাই ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কোন কোন ধাপে আমরা মূল্য সংযোজন করতে পারবো তা নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করে নির্বাচন করতে হবে। এ পর্যন্ত বাস্তবায়িত প্রকল্প এবং বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন করে আমাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। আমরা জানি, মূল্য সংযোজনের অন্যতম ধাপ কাঁচামাল সংগ্রহ এবং পণ্য উৎপাদন পর্যায়। কৃষি পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হলো (বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ সুবিধা) এবং দক্ষ শ্রমিক। উৎপাদিত পণ্যের গুণতগমান নিশ্চিতকরণ, বাজারমূল্য নির্ধারণ এবং কৃষক/খামারির মুনাফা অর্জনের জন্য সুলভে মানসম্পন্ন উপকরণ প্রাপ্তি একটি বিশেষ শর্ত। সরকার কৃষক পর্যায়ে পর্যাপ্ত সার, কীটনাশক ও সেচ সুবিধা সফলভাবে দিতে পেরেছে। তবে উচ্চফলনশীল বীজের ঘাটতি এখনও আছে। উচ্চফলনশীল বীজের অভাবে সমপরিমাণ সার, কীটনাশক ও সেচ প্রয়োগ করে কৃষক কম পরিমাণ ফলন পাচ্ছে। উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার করে ১৫ থেকে ২০ ভাগ ফলন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। সুতরাং বলতে পারি, বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে আমাদের ভ্যালু চেইন উন্নয়নের যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে।
পোল্ট্রি শিল্পে বিরাজমান অবস্থা ব্যাখ্যা করা প্রায় দুঃসাধ্য একটি বিষয়। এক সপ্তাহে বাচ্চার দাম বাড়ে, পরের সপ্তাহে খাদ্যের দাম বাড়ে; তার পরের সপ্তাহে কমে যায় ডিম কিংবা ব্রয়লারের দাম। এ যেন সাপ লুডু খেলা। অথচ, আমরা যদি এই শিল্পে একটি পূর্ণাঙ্গ ভ্যালু চেইন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে শুধু পোল্ট্রি খামারি নয়; হাসি ফুটবে লাখ লাখ ভূট্টা চাষি ও সয়াবিন চাষির মুখে। গবাদিপশুর খাদ্যের বাজারও পোল্ট্রি খাদ্যের দামের মতো অনিয়ন্ত্রিত। স্থানীয় জাতের গরুর দুধ এবং মাংস উৎপাদন ক্ষমতা দুটোই সংকর জাত বা উন্নত জাতের তুলনায় অনেক কম। যে কারণে প্রতি একক আয়তনে বিশে^র যে কোন দেশের চেয়ে বাংলাদেশে গরুর সংখ্যা বেশি হলেও কাক্সিক্ষত দুধ বা মাংস আমরা পাচ্ছি না। এখানেও ভ্যালু চেইন উন্নয়নের অপার সুযোগ আছে।
ফসল উৎপাদন বা কৃষি পণ্য উৎপাদনের পর ভ্যালু চেইন উন্নয়নের দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে আমরা বিবেচনা করতে পারি প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং, পরিবহন এসব বিষয়। ভোলা জেলার দুর্গম চরে মহিষের বাথানের মালিক জানেন, শহরে দুধের অনেক চাহিদা এবং দামও অনেক বেশি। কিন্তু প্রক্রিয়াজাতকরণ আর পরিবহনের অভাবে তার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ নেই। শহরের ভোক্তা পত্রিকা পড়ে বা টিভিতে খবর দেখে আফসোস করেন খাঁটি দুধের জন্য। রংপুরের চর এলাকার সবজি চাষি সবজি বাজারে বিক্রি করতে না পেরে গরুকে খেতে দেন। অথচ, এই বাঁধাকপি হিমায়িত গুদামে ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। একটু উদ্যোগ নিলে প্রায় দেড় মাস পর্যন্ত ফুলকপি সংরক্ষণ করা যায়। ব্ল্যানচিং পদ্ধতিতে ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মূলা এবং আরও অনেক সবজি প্রায় ৩ থেকে ৫ মাস সংরক্ষণ করা যায়। এ সবই তো ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ধাপ। গবেষকরা বলছেন আমাদের উৎপাদিত শাক-সবজি ও ফল-মূলের ৩০ ভাগ নষ্ট হয় সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে অব্যবস্থাপনার জন্য। সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এই হার ১০ ভাগে কমিয়ে আনা সম্ভব। কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য এবং বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের জন্য যে মানের ও সংখ্যার কারখানা আমাদের দরকার তা এখনও গড়ে উঠেনি। এ জন্য অবশ্য ভোক্তাকেও কিছুটা দায়ী করা যায়। কেননা বিদেশি পণ্যের প্রতি ভোক্তাদের আলাদা একটা মোহ আমরা সবসময়ই দেখতে পাই। একই মান সম্পন্ন দেশি পণ্যের জন্য ভোক্তা বিদেশি পণ্যের সমান মূল্য পরিশোধে অনাগ্রহী। ভোক্তাকে আকৃষ্ট করতে পণ্যের প্রচারণাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে হলে পণ্যের গুণগতমান নিশ্চিত করার পাশাপাশি এ বিষয়ে প্রচারণাও চালাতে হবে। ১০০ গ্রাম পেয়ারা থেকে ৬৮ কিলোক্যালরি, কুল বা বরই থেকে ৭৯ কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। ১টি বড় কলা থেকে ১২০ কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। ১০০ গ্রাম আপেল থেকে ৫২ কিলোক্যালরি, কমলা থেকে ৫৩ কিলোক্যালরি এবং ১০০ গ্রাম ড্রাগন থেকে ৬০ কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। পুষ্টি বেশি হলেও দেশীয় ফলের দর এবং চাহিদা বিদেশি ফলের চেয়ে অনেক কম।
শোনা যায়, অনেক কোম্পানি পণ্য উৎপাদন খরচের চেয়ে ঐ পণ্যের প্রচারণায় বেশি অর্থ ব্যয় করে। সে তুলনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্য বিষয়ে কোনো প্রচারণা নেই বললেই চলে। বিশ্বমানের দুগ্ধপ্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা নিয়ে, আমদানিকৃত চিনির চেয়ে উৎকৃষ্টমানের দেশীয় চিনি নিয়ে কোনো প্রচারণা চোখে পড়ে না। অথচ, মিল্কভিটার উপর নির্ভর করে টিকে আছে লাখ লাখ ডেয়রি খামারি; গুণগত মান সম্পন্ন দুধ পাচ্ছে লাখ লাখ ভোক্তা। একই কথা বলা যায়, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)’র ক্ষেত্রে। উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ সরবরাহ, সেচ সুবিধা, সার-কীটনাশক সরবরাহের মাধ্যমে বিএডিসি আমাদের মাঠ ফসল উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। মিল্কভিটা এবং বিএডিসি ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অন্যতম মডেল। পণ্যের সঠিক প্রচারণাও কিন্তু ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অংশ। তৈরি পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, নির্মাণ শিল্প যেহারে উদ্যোক্তা তৈরি করতে পেরেছে, কৃষি প্রধান দেশে কৃষি ভিত্তিক শিল্প সেভাবে কেন উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারছে না, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ রইলো।
লেখক: কৃষিবিদ, টিভি নাট্যকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন