শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পানির সুরক্ষা প্রয়োজন

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া প্রাণী বা উদ্ভিদের অস্তিত্ব আশা করা যায় না। পানি আমাদের জীবন। পানিই সম্পদ। পানিবিহীন জীবন আমরা কল্পনাও করতে পারি না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সূত্রে জানানো হয়েছে দূষিত পানি পান করার ফলে প্রতি বছর বিশ্বে শিশুসহ লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কোথাও বা সন্তানসম্ভবা মায়েরা দূষিত পানি পান করার ফলে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দেন। কখনো কখনো আমরা কিছু কিছু জন্তুকে খাল-বিল, নদী-নালা ও নর্দমার নোংরা পানি পান করতে দেখি। তেমন ছবি দেখে আঁতকে উঠে আমরা ভাবি, যদি বাস্তবে আমাদেরও এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। এমন পরিস্থিতি যে আমাদের ক্ষেত্রেও আসবে না, তা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এক ফোঁটা পানির জন্য হাহাকার করতে হয় এমন জায়গাও আছে। পৃথিবীতে এমন দেশও আছে যেখানে প্রতিদিন পানির জন্য অগনিত মানুষকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হয়। এমন দেশও রয়েছে যেখানে তেলের মূল্যের চেয়ে পানির মূল্য বেশি।

বর্তমানে বিভিন্ন কারণে পানীয়জলের গুণাগুণ ও শস্যের উৎপাদন কমে আসছে। হয়তো ভবিষ্যতে মানুষের পানি সম্পদের জন্যে নিজের ওপর ধিক্কার জন্মাবে। গাছপালার মতো মানুষও শুকিয়ে মারা যাবে। বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত দূষিত বর্জ্য পদার্থগুলো মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীরও ক্ষতি করছে। গাছপালারও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কীটনাশক, রাসায়নিক সার নদী-নালা, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদিতে গিয়ে মিশেছে। এর ফলে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী আজ মৃত্যু ঝুঁকিতে।

এদিকে, প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা চিন্তা না করে আমরা যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছি, গাছ-গাছড়া কেটে, মাটি কেটে নগর তৈরি করছি, জলাশয় মাটি দিয়ে ভরাট করে অট্টলিকা নির্মাণ করছি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে কলকারখানা তৈরি করছি, তাতে ভবিষ্যতে আমাদের হাহাকার করতে হবে পানির জন্য। এমন দিন আর বেশি দূরে নয়, যখন কৃষককে চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে হবে বৃষ্টির জন্য। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে অবজ্ঞা করে আমরা এগিয়ে চলেছি আধুনিক নাগরিক সভ্যতার দিকে। আদিম মানুষ অরণ্যে থেকে গাছ-গাছালির ফলমূল খেয়ে বেঁচে ছিলেন। আজকে ভাবতে অবাক লাগে যে, তা কী করে সম্ভব ছিল। এখন অরণ্য বলতে কিছুই নেই। চারিদিকে কেবল অট্টালিকার সারি। আজকের জমানার অধিকাংশ ছেলেমেয়ে অরণ্য চোখেও দেখেনি। অরণ্য কী তা ছবি দেখিয়ে বোঝাতে হয় তাদের।

পৃথিবীর সবকটি সাগর, মহাসাগর, উপসাগর, নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হ্রদ-হিমবাহ, মেরুতুষার, ভুগর্ভস্থ পানি দিয়ে বারিমন্ডল গঠিত। পৃথিবীর মোট পানির শতকরা ৯৭ ভাগ পানি সমুদ্রে থাকে। শতকরা দুইভাগ পানি আছে হিমবাহ ও মেরুতুষারে। মানুষের পানীয় এবং অন্যান্য ব্যববহারের উপযোগী মাত্র এক ভাগ পানির উৎস নদ-নদী, হ্রদ, পুকুর, ডোবা, কুয়ো, নলকূপ, ঝরনা ও ভুগর্ভস্থ পানি। সমগ্র পৃথিবীতে পানির পরিমাণ ও মান হ্রাস পাচ্ছে। পরিত্যক্ত পানির শোষণ ও পানীয় জলের শুদ্ধিকরণ বিঘিœত হচ্ছে। অথচ পানি ছাড়া প্রাণী বা উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারে না। পানির অপচয়ের মাত্রা দিনে দিনে বাড়ছে। তাই পানিসম্পদ ব্যবহার ও পানি সংরক্ষণের জন্য যথাযথ আইন প্রণয়ন জরুরি।

বাংলাদেশসহ বিশ্বে তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। স¤প্রতি জানা গেছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি হওয়ার ফলেই তিব্বত এলাকার হিমবাহগুলো বেশ দ্রæত গলে যাচ্ছে। এ জন্য ভবিষ্যতে অর্থাৎ ২০৫০ সাল নাগাদ উপকূলবাসী থেকে শুরু করে যাযাবর জাতি পর্যন্ত এশিয়ার ২০০ কোটি মানুষ পানিসংকটে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারনা। বরফ খুব পুরু হয়ে জমাট বাঁধে। পরে সেগুলোর গলিত পানি গিয়ে পড়ে ইয়াংশি, ইয়েলো, ব্রহ্মপুত্র এবং মেরু সহ এশিয়ার বড় বড় নদ-নদীতে। এসব নদী এবং আরো কিছু বড় নদী তিব্বতের হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। ওয়াটে স্টেট ইউনিভার্সিটির হিমবাহ বিশেষজ্ঞ লনি থম্পসন বলেন, অনেক বিজ্ঞানীর মতে, তৃতীয় মেরু হিসাবে পরিচিত এ মালভূমির তাপমাত্রা বিশ্বের অন্য অংশের তুলনায় দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। মানহাটনে এশীয় সমাজে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এক সভায় থম্পসন বলেন, উচ্চ তাপমাত্রায় হিমবাহ দ্রæত গলে যাওয়ায় এশিয়া জুড়ে পানি সরবরাহ নিয়ে এক আশঙ্কার কালোমেঘ তৈরি হয়েছে। বর্তমান হারে বরফ গলতে থাকলে তিব্বত মালভূমির দুই তৃতীয়াংশ হিমবাহ ২০৫০ সালের মধ্যে গলে যাবে। এর পূর্বেই মানুষ পানির জন্য মালভূমির যে স্তরের ওপর নির্ভরশীল তা আক্রান্ত হবে। ফলে পানি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে।

ওয়াশিংটনের উডরো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্স-এর পরিবেশ ও নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক জিওফ ডাবেলকে বলেন, নদ-নদীর পানি কমে গেলে চীন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভূটানের প্রায় ২০ কোটি মানুষ সংকটে পড়বে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির তিব্বত বিষয়ক অধ্যাপক রবার্ট বারনেট বলেন, পানি সংকটের ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে, এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে নতুন ধরনের যুদ্ধ শুরু হতে পারে। থম্পসন অবশ্য এও বলেন, গলে যাওয়া পানি ধরে রাখার জন্য বাঁধ নির্মাণ করলে কিছু ক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে। কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আর এ ধরনের বাঁধ নির্মাণে উজানের দেশগুলোর লোকদেরকে বাধার মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ সমৃদ্ধ পানিরাশির দেশ। নদী, খাল, বিল ও জলাশয়ের প্রাচুর্য হেতু বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে অধিকাংশ পুকুর ও জলাশয়। পানির উৎস হচ্ছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী।

জানা গেছে, পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে গুরুতর সংকট এবং সংকটের আবর্তে পড়তে চলেছে বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা। ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে নেমে আসবে পানি সংকট। আরো জানা গেছে, ইতিমধ্যেই পৃথিবীর ২৯টি দেশের প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ পানিসংকটের সম্মুখীন। ইন্টারন্যশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটের প্রধান ফ্রাঙ্ক রিমবারম্যান বলেন, আগামী বছরগুলোতে পানির অভাব গুরুতর আকার ধারণ করবে। তাঁর মতে, ভবিষ্যতে আধা বা পুরো খরাপ্রধান অঞ্চলে পানির অভাব বিস্তার লাভ করবে। বর্তমানে পানির চাহিদা যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে তাতে বেশিরভাগ নদী পানির অভাবে আগামী বছরগুলোতে শুকিয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন যে, বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চল মারাত্মক পানি সমস্যার সম্মুখীন। বিশ্ববিজ্ঞানীদের জনমঞ্চ এক বিবৃতিতে বলেছে, ক্রমবর্ধমান পানির অভাব খাদ্যের যোগান এবং মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করছে। এতে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের চরম ক্ষতি হচ্ছে। সেই জন্য প্রয়োজন পানি সংরক্ষণ ও পানির সীমিত ব্যবহার। বৃষ্টিপাতের প্রয়োজনে অরণ্য সংরক্ষণ ও নতুন বৃক্ষ রোপণ।

বাংলাদেশ জনবহুল দেশ বর্তমানে এর পানিসংকট প্রবল। নদ-নদীই এখানকার পানির প্রধান উৎস। বর্ষায় নদ-নদীগুলো বৃষ্টির পানিতে পুষ্ট হয়। হয় খরস্রোতা। বর্ষায় নদীগুলোর পাড় ভাঙতে থাকে। ফলে লোকালয়ের ক্ষতি হয় বেশি। পানির অন্যান্য উৎস হল দেশের অসংখ্য দীঘি, পুকুর, গভীর কূপ, কৃত্রিম হ্রদসহ অন্যান্য জলাভূমি। এখানকার পানিতে লোহা ও আর্সেনিকের প্রভাব আছে। প্রদূষিত পানীয় জলের ঘাটতি আছে। বিভিন্ন নদ-নদী শহরাঞ্চলসহ কিছু কিছু গ্রামাঞ্চলে পাইপ লাইনে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। তবুও দেশের প্রায় সর্বত্রই লেগে আছে পানি সংকট। দেশে জলাশয়, পুকুর, ডোবা ভরাট করা আইনসিদ্ধ নয়। তবুও শহরাঞ্চলে কিংবা গ্রামাঞ্চলেও অনেক জলাশয়, পুকুর, ডোবা ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি করা হচ্ছে, যা পানি সংকটকে আরো প্রকট করেছে। দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলের অধিবাসীরা তীব্র পানি সংকটের সম্মুখীন, যা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জানা যায়। তাই পানি সংকট মোকাবেলা সরকারি উদ্যোগ বেশি প্রয়োজন। সচেতনতা ও সরকারি এ আইনের দ্বারা গঠিত যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমে এই পানিসম্পদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

এ কথা সত্যি, জনসংখ্যার ভায়বহ বৃদ্ধি তথা প্রকৃতিকে দাস করার প্রচেষ্টা আমাদের জীবনে ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে। আমরা একটু সচেতন হলেই পানিকে সম্পদ মনে করে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে পারি। বর্জ্য পদার্থ নষ্ট করে বা অন্য কাজে লাগিয়ে জিনিস বা ঘর সাজানোর সামগ্রী তৈরি করতে পারি। এভাবে দূষিত পানিকে সৎকাজে লাগানোর উপায় বের করে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে পারি। এক ফোঁটা পানিও যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে নজর রাখার জন্য সতর্ক হওয়ার সময় এসে পড়েছে এখনই, আর দেরী নয়।
লেখক: সাংবাদিক কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন