শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অর্থনীতির দুষ্টক্ষত হয়ে আছে দুর্নীতি

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির আকার ক্রমশ বাড়ছে। প্রতিবছর বাজেটের আকারও বাড়ছে। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘোষিত বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার। ৫০ বছর পর চলতি বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার। বাজেটের আকারের এই বিশাল পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা লাগানো পশ্চিমাদের কাছে অর্থনীতির এই উন্নতি বিস্ময়কর। বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতি নিয়ে সাকসেস স্টোরিও হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের সাফল্যের সঙ্গে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এমডিজি পূরণে এি সাকসেস স্টোরি উন্নয়নের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এক সময় যারা তাচ্ছিল্য করতো, তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলতো তারাও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ-সিইবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে অবস্থান ৪১তম। ২০৩৩ সালে আমাদের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ১২টি দেশকে টপকে গেছে। আগামী ১৫ বছরে টপকে যাবে আরও ১৭টি দেশকে। এমন আশা জাগানিয়া সাফল্যের পেছনে বিশেষভাবে কাজ করেছে অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন। স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার পরের এক দশক বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরেছে কৃষিকে ঘুরে। এখন কেবল কৃষি নয়, শিল্প ও সেবাখাতও অর্থনীতির চাকা ঘুরাচ্ছে। রেমিট্যান্স এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির ভূমিকাও প্রথম সারিতে। তবে এতসব উন্নয়নের মাঝে কিংবা পরিসংখ্যানের কাগজে-কলমের হিসাবের মধ্যে দুর্নীতি ও জনগণের অর্থের লুটপাট ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে, লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে ধনী আরও ধনী হচ্ছে। গরিব আরও গরিব হচ্ছে। সমস্যায় পড়েছে সাধারণ মানুষ। মহামারী করোনাভাইরাস সংকটে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ চেয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। তাদের সংগঠনগুলো বলছে, প্রায় ৫৪ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখন পুঁজির সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে। এরসঙ্গে অনানুষ্ঠানিক খাতে স্বল্প পুঁজির প্রায় ৬০ লাখ উদ্যোক্তা লকডাউনে ঘরে বসে পুঁজি খেয়ে ফেলেছেন। তারা এখন নিঃস্ব। অথচ তারাও অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কর্মসংস্থানও করেন বেশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
এদের ট্রেড লাইসেন্স, করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর টিআইএন ও ভ্যাট নিবন্ধন কিংবা ব্যাংক হিসাব নেই। তাদের কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি বা বাদাম বিক্রেতা। তাদের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর খুব একটা লেনদেন বা ঋণের স¤পর্ক নেই। এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দ্রæত ঋণ প্রদানের তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তবে প্রণোদনার সব দায়িত্ব ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর আছে কিনা, এ প্রশ্ন থেকেই যায়। বৈশ্বিক মহামারি করোনা বাংলাদেশের অগ্রগতিতে কিছুট হলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের আয়রোজগার কমেছে। রপ্তানিও কমেছে। এ ছাড়া প্রবাসী আয় হ্রাসের কারণে খরচ করার প্রবণতা কমেছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে। চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে বন্যায় কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হয়েছে। করোনার কারণে কর খাতের সংস্কার বিলম্বিত হলে বা বড় প্রকল্পগুলোর খরচ বাড়লে আর্থিক খাতে ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
একদিকে অর্থনীতিতে এগিয়ে চলা, আরেকদিকে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনা গত কয়েক বছর ধরেই আলোচিত হচ্ছে। সরকারের দিক থেকে যে কোনো ছাড় বা নমনীয়তা রয়েছে এমনও নয়। কিন্তু পাচারকারী চক্র দমছে না। বতাদের বেশিরভাগই সরকারি ঘরানার। ইতোমধ্যে কানাডার বেগমপাড়াসহ বিভিন্ন দেশ ও জায়গায় অর্থ পাচারকারীদের নাম-ঠিকানাসহ পরিপূর্ণ তালিকা দাখিল করতে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে দাখিল করা তালিকায় সন্তুষ্ট হয়নি আদালত। তালিকাটিকে বলা হয়েছে অস¤পূর্ণ-অপর্যাপ্ত ও খাপছাড়া। জবাবে দুদক জানিয়েছে, তারা কাজ করছেন এ নিয়ে। অর্থপাচার নিয়ে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ক্যানাডায় টাকা পাচারের গুঞ্জনের কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন। প্রাথমিক তথ্যে দেখেছেন, টাকা পাচারে কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সরকারি চাকুরেই বেশি। তিনি জানিয়েছেন, তার ধারনা ছিল পাচারকারীদের মধ্যে রাজনীতিকের সংখ্যাই বেশি হবে। কিন্তু এ তালিকায় রাজনীতিবিদ মাত্র চারজন। ব্যবসায়ী আছেন সামান্য কয়েকজন। ২৮টি কেস স্টাডির কথা বললেও পাচারকারীদের নাম বা তালিকা দেননি তিনি। বিষয়টি আদালতে গড়ালেও প্রসঙ্গটি আর এগোয়নি।
অথচ দুর্নীতিসহ অর্থ খাতে নয়-ছয় না হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি কোন পর্যায়ে পৌঁছাতো তা কল্পনাও করা যায় না। ২০১৫ সালে ঢাকা সফরে এসে বিশ্বব্যাংকের তখনকার প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশকে দেখেছেন এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার হিসেবে। প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৯তম দেশ। জরিপ বা আশা-ভরসার বাংলাদেশ এখন এখন উন্নয়নের সর্বজনীন মডেল। দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশটিতে দারিদ্র্য হ্রাসের এ সাফল্যকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছে বিশ্বব্যাংকও।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, জলাবদ্ধতা, নদীর নাব্য হ্রাস, পানির স্তর নেমে যাওয়া, ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা প্রতিনিয়ত হুমকিতে পড়ছে। অর্থনীতি পড়ছে ঝুঁকিতে। তার ওপর উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত শিল্পায়নের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ধকল সইতে হচ্ছে। এই বিরূপ প্রাকৃতিক পরিস্থিতির মধ্যেও দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। এক সময় পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করতো। মাঝেমধ্যে প্রতিবেশী ভারত থেকেও বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল্যায়নে কার্পণ্য ও তাচ্ছিল্য ছিল। দেশটির স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশ এতই গরিব যে, দেশটির মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্ব অফার করা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
দেশের অর্ধেক মানুষই ভারতে পাড়ি জমাবে। রেড্ডির সেই কথার জবাব দিয়েছেন ভারতের খ্যাতনামা সাংবাদিক কারান থাপার। হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, রেড্ডি বাংলাদেশ স¤পর্কে জানেনই না। দেশটি কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছে, তার বিন্দুবিসর্গ জানেন না। তিনি এ কথাও জানেন না যে, জীবনের গুণগত মান বোঝায় এমন প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ ভারতকে পিছে ফেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের খ্যাতনাম বুদ্ধিজীবী পারভেজ হুদোবয় দেশটিরর ডন পত্রিকায় বলেছেন, একসময় বলা হতো দরিদ্র ও দুর্যোগকবলিত বাংলাদেশ লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ এক ভিন্ন দেশ, তাকে বলা হচ্ছে পরবর্তী এশিয়ান টাইগার। একসময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় অচেনা দেশটি এখন আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচিত। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষায় সবচেয়ে বেশি অবদান বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের আজকের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও অবস্থান নিয়ে বিদেশিদের এই উপলব্ধি এমনি এমনি আসেনি। বাস্তবতার আলোকেই তারা স্বীকার করছেন ও স্বীকৃতি দিচ্ছেন। গত ৫০ বছরে দেশকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। আমরা মনে করি, উন্নয়নের এই অগ্রগতি ধরে রাখতে এবং এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে দুর্নীতি বড় ধরনের ক্ষত হয়ে রয়েছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে অর্থনৈতিক এই অগ্রযাত্রা আরও বেগবান হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন