বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গুলি, রক্তপাত ও ধ্বংসাত্মক কাজ মোটেই সমর্থনীয় নয়

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন | প্রকাশের সময় : ২ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৮ এএম

রক্তে কেনা এ স্বাধীনতা। তাই এ জাতির জীবনে স্বাধীনতা সব সময়ই বিশেষ কিছু। সবচেয়ে বড় ও গৌরবময় অর্জন। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, বিশেষ করে জাতির ভবিষ্যৎ তরুণ-যুবাদের জন্য প্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যে এ জাতির জীবনে আবেগ ও আনন্দের মিশেলে এক অনন্য মুহূর্ত হিসেবে দেখা দেবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই? এক বছর আগে এ দেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণ জাতির এ আবেগ-উচ্ছ¡াসে নতুন মাত্রা যোগ করে। বিগত বছর ১৭ মার্চ জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে শুরু হয় বছরব্যাপী নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে মুজিববর্ষ পালনের উদ্যোগ। দুর্ভাগ্য, জাতি যখন বিপুল উদ্দীপনায় এ উদযাপনের দিকে এগুচ্ছিল, তখনই করোনা মহামারির ভয়াল থাবা সব পরিকল্পনা লন্ডভন্ড করে দিল। তা সত্তে¡ও সীমিত পরিসরে বছরব্যাপী নানা আয়োজনে মুজিববর্ষ পালন অব্যাহত থাকে। অবশেষে এ বছর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ১০১-তম জন্মবার্ষিকীতে ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচির মাধ্যমে, যার মেলবন্ধন ঘটে সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালার সাথে। এভাবে যখন করোনার ঝুঁকিমুক্ত অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পরিবেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত বলে অনুমিত হচ্ছিল, তখনই আঘাত হানতে শুরু করল করোনার নতুন ঢেউ। একদিকে তো এই নতুন আপদ, অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়ে সৃষ্ট তিক্ত বিতর্ক আনন্দের আমেজকে কেমন যেন অন্য রকম করে তুলতে শুরু করে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে নজরকাড়া সব আয়োজনের মধ্যে অন্যতম ছিল বিশ্ব নেতাদের, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশসমূহের, সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের অংশগ্রহণ। এদের অনেকেই এ অনুষ্ঠানে সশরীরে অংশ নিয়ে এ আয়োজনকে মহিমান্বিত করেন। অন্যরা তা না পারলেও বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেন এবং এর উত্তরোত্তর আরও উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অতুলনীয় সহযোগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ বিবেচনায় এ অনুষ্ঠানে ভারতের অংশগ্রহণ বিশেষ গুরুত্ব পাবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। স্বাধীনতার পর নানা বিষয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের মিঠেকড়া সম্পর্ক সত্তে¡ও ভারত আমাদের আজন্ম বন্ধু এবং নিকটতম প্রতিবেশী। স্বাভাবিকভাবেই এ গুরুত্বের দাবিদার। এ নিয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ ছিল না। কিন্তু, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উগ্র সাম্প্রদায়িক, মুসলিম বিদ্বেষী ও নাগরিকপঞ্জির নামে আপাত বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকার কারণে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মতো ঐতিহাসিক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তাঁর অংশগ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি উঠে।

সরকারের জন্য বিষয়টি এক কঠিন সমস্যা তৈরি করে। একদিকে ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যার কিনা এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশাল ভূমিকা রয়েছে, তার প্রধানমন্ত্রী এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের দাওয়াত কবুল করেছেন এবং সাগ্রহে এতে যোগদানের অপেক্ষায় আছেন। অন্যদিকে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদির অতীত ও বর্তমান নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে বিভিন্ন সংগঠন যে কোনোমূল্যে তাঁর আগমন ঠেকাতে বদ্ধপরিকর বলে ঘোষণা দিতে থাকে। অবশেষে কিছু সংগঠন ২৬ মার্চ কোনো কর্মসূচি রাখবে না বলে ঘোষণা করায় বিষয়টির একরকম রফা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে, অন্য কিছু সংগঠন তাদের অবস্থানে অবিচল থাকে।

বায়তুল মোকাররম থেকে একদল লোক মোদি-বিরোধী মিছিল বের করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং দৃশ্যত কিছু রাজনৈতিক কর্মীও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তাদের প্রতিহত করতে অবস্থান নেয়। এ সময় ওখানে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ফেসবুক-ইন্টারনেটের এ যুগে এ খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। কোনো কোনো জায়গায়, বিশেষ করে হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, প্রতিবাদী মিছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের রূপ নেয়। ফলে, গত কয়েক দিনে অকালে ঝরে পড়ে বেশ কিছু তাজা প্রাণ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় অনেক সহায়-সম্পদ। যেখানে অনাবিল আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে তার বদলে রক্তের দাগ পড়লো রাজপথে। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে।

দেশটি স্বাধীন হয়েছিল রক্তের সাগর পেরিয়ে। একজন শান্তিপ্রিয় জননেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত রক্তক্ষয় এড়ানোর চেষ্টা করে গেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যখন তাঁর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তখনও সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেন। আমি প্রায়ই ভাবি, তিনি কেন স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধীতাকারীদের অনেককেই উদারভাবে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন? একটি উত্তরই খুঁজে পেয়েছি, তিনি মনে করেছিলেন, এটি বিভেদের সময় নয়, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সময়। ’৯০-এর দশকে বঙ্গবন্ধুতনয়া যখন প্রথমবার সরকার গঠন করেন, তিনিও ঐকমত্যের সরকার গঠনের ডাক দিয়েছিলেন। আমার কাছে তাঁর সেদিনকার আহবানকে বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথের অনুসৃতি বলেই মনে হয়েছে।

দেশ ও দশের স্বার্থে একজন জননন্দিত জাতীয় নেতার কর্মনীতি এমনটিই হওয়ার কথা নয় কি? ইতিহাস থেকে আমি দু’টি উদাহরণ দেব। মহানবী (সা.) যখন মক্কা বিজয় করেন, এত দিন যারা তাঁকে এত কষ্ট দিয়েছেন, তাঁকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন, তাদের সবাইকে তিনি উদারভাবে ক্ষমা করে দেন, কোনো প্রতিশোধ নেয়ার কথা চিন্তাই করেননি। তিনি চাইলে সেদিন মক্কায় রক্তের নহর বইয়ে দিতে পারতেন। মক্কাবাসীরা তাঁকে এবং তাঁর সহচরদের যে অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন করেছেন, তাতে এটাই কি তাদের প্রাপ্য ছিল না? কিন্তু, তিনি সে পথে হাঁটেননি। তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিলেন। অনাগত দিনের পৃথিবীবাসীর জন্য এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এর ফল কী হয়েছিলো তা তো ইতিহাস। তাঁর এ মহানুভবতায় এতদিনকার মরণপণ শত্রুদের মস্তক আপনিই নুয়ে এলো। এদের অনেকেই পরবর্তীতে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও দিগি¦জয়ে অতুলনীয় ভূমিকা রাখলেন। দ্বিতীয় উদাহরণটি নিকট অতীতের। দীর্ঘ সংগ্রামের পর দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ জননেতা নেলসন ম্যান্ডেলা যখন বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হন, তাঁর এতদিনকার শত্রু শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের সাথে শত্রুতা ভুলে গিয়ে সবাইকে নিয়ে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে হাত দেন। তা না করলে আজও দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের চিরায়ত সংঘাত অব্যাহত গতিতে বহমান থাকত।

যে প্রশ্নটি আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, দেশ কি এভাবে অনৈক্য, হানাহানি আর বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ঘুর পাক খেতে থাকবে? হিংসা হিংসার জন্ম দেয়। রক্তপাত আরও রক্তপাতের পটভূমি তৈরি করে। ইতিহাসে এ নজিরের অভাব নেই। গত ক’দিনে যেভাবে বুলেটের আঘাতে একের পর এক জীবন ঝরে পড়লো, তাতে মনে হতে পারে এদেশে এখন সবচেয়ে সস্তা বুঝি মানুষের প্রাণ। মনে রাখা চাই, যারা মারছে আর যারা মরছে, সবাই তো এ মাটিরই সন্তান। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, এত রক্তক্ষয়ের পরেও কিছু স্বার্থান্বেষী মহল হিংসা-বিদ্বেষ আরও উসকে দিতে চায়। দেশকে নামে-বেনামে ক্রমাগত বিভক্ত করে এরা কার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে, তা চিন্তা করার এখনই সময়। দেশি-বিদেশি যে সব মতলববাজ দেশটাকে লুটেপুটে খেতে চায়, তারা কখনই চাইবে না এ দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হোক। এখন, আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি তাদের ফাঁদে পা দিয়ে দেশকে সর্বস্বান্ত করব, নাকি নিজেদের মধ্যকার বিভেদ কমিয়ে এনে দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেব?
লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack Ali ২ এপ্রিল, ২০২১, ৯:২৬ পিএম says : 0
Why we liberated our beloved mother land from barbarian pakistan??? they killed/raped us for 9 months but after liberation become we also slave of awami league, our country have been destroyed in every way. O'Allah appoint a muslim who will rule our Creator's Law [Qur'an] who Created us from a atomic drop of despise water The Al-Mighty Allah only then we will be able to live in peace with human dignity and there will be no more poor people.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন