শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চীন পারলে আমরা পারছি না কেন?

অজয় কান্তি মন্ডল | প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৩ এএম

দেশে আবারো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের হার, মৃত্যুর হার এবং সর্বোপরি একটু একটু করে আবারো পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে। অনেকের ধারণা ছিল, পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে হয়তো করোনা নির্মূল হবে, কিন্তু পরিস্থিতি পুরোটাই বিপরীত দিকে মোড় নিয়েছে। সরকারি হিসাব মতে, গত পহেলা এপ্রিল ২৪ ঘণ্টায় দেশে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫৯ জনের। এছাড়াও শনাক্তের হার শতকরা প্রায় ২৩ ভাগ, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। পরিস্থিতি যে দিনকে দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে, সেটা প্রতিদিনের আক্রান্ত এবং মৃত্যু হারের সমান্তরাল গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ার চিত্র থেকে সুস্পষ্ট।
এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের সাথে জনগণের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। একমাত্র জনগণই পারে এই বিশেষ মুহূর্তে সরকারের সাথে তাদের নিজেদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তার জন্য দরকার শুধু সামান্য সচেতনতা বৃদ্ধি ও খুবই সহজ কিছু বিষয়ের নৈমিত্তিক অনুশীলন। সবাই যদি নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে সচেতন হয়ে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলি, তাহলে অচিরেই এই খারাপ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ মিলবে। তা না হলে সামনে আরও বেশি খারাপ সময় অপেক্ষা করছে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
বিশ্বে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগে চীন সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাসের মৃত্যুর মিছিলকে মোকাবেলা করেছিল। কঠোর কিছু নিয়মকানুন মেনে তারা পেরেছিল এবং এখনো পারছে জনগণকে করোনাশূন্য প্রতিটা দিন উপহার দিতে। কোনো রকম ভ্যাক্সিনেশন ছাড়া চীন কীভাবে এই দুঃসাধ্য সাধন করেছে, সেটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হতে পারে। ‘হ্যাঁ’, সত্য কথা, শুধুমাত্র সামান্য কিছু নিয়ম-কানুন মেনেই চীন সব কিছুকে মোকাবেলা করেছে এবং বিশ্বের কাছে একমাত্র করোনা মোকাবেলায় সফল দেশ হিসেবে বাহবা পাচ্ছে।
চীনের এই বাহবা পাওয়ার পিছনে বেশ কিছু সহজ সাধ্য নিয়ম আছে। যেটা যেকোন দেশ এদের থেকে নিয়ে করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে বলে আমি মনে করি। চীনে দীর্ঘদিন যাবত নতুন করে করোনা ভাইরাস সনাক্তের কথা শোনা যায়নি। তবে মাঝেমধ্যে কিছু প্রদেশে হাতে গোনা দুই-এক জনের লোকালি ট্রান্সমিটেড হওয়ার খবর পাওয়া যায়। আর তখনি সেটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যে সকল কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আছে চীনা প্রশাসন সেটা করে যাচ্ছে। এর ফলে এই ভাইরাস পরবর্তী পোষকদেহ খুঁজে না পেয়ে সেখানেই তার জীবনচক্রের ইতি টানছে।
ভাইরাস মোকাবেলায় চীনের সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কোনো বিদেশি, তিনি যেই হোন না কেন চীনে প্রবেশ করতে পারবেন না। এই নিষেধাজ্ঞার কোনো সময়সীমা নেই। যেটা শুরু হয়েছিল গত বছরের জানুয়ারি মাসের দিকে। তবে কোনো বিদেশি বা চীনা নাগরিক যে কেউ চাইলে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চীন ত্যাগ করতে পারবেন। যে সকল চীনা নাগরিক তাদের পেশাগত কাজের সুবাদে অন্যান্য কোনো জরুরি প্রয়োজনে অন্য দেশে অবস্থান করছেন তাদের চীনে প্রবেশের জন্য বেশ কঠোর কিছু নিয়ম-কানুন আছে। তার মধ্যে অন্যতম, দেশে প্রবেশ করার সাথে সাথে বাধ্যতামূলক আইসোলেশানে থাকার ব্যবস্থা। এই আইসোলেশানের মেয়াদ সর্বনিন্ম একুশ দিন থেকে এক মাসের উপরও হতে পারে। বিদেশ থেকে নেগেটিভ করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন থাকার পরও দেশে প্রবেশের সাথে পুনয়ার টেস্ট করানো এবং আইসোলেশানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে আবারো টেস্ট করিয়ে নেগেটিভ প্রতিবেদন পাওয়া সাপেক্ষে চীনা ওই ব্যক্তিকে উন্মুক্ত পরিবেশে চলাচলের সুযোগ দেওয়া হয়। করোনা মোকাবেলায় চীনের এটা সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ বলে আমার মনে হয়।
এই একই চিত্র চীনের ভিতরের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রেও খুবই কড়াকড়িভাবে বহাল আছে। তবে সেক্ষেত্রে আইসোলেশানে থাকার মেয়াদ সর্বনিন্ম চৌদ্দ দিন। গেল জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে চীনাদের নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মিলিয়ন মিলিয়ন চীনা নাগরিক নিজেদের দেশের ভিতরে এবং বাইরের দেশ থেকেও চীনে যাতায়াত করেছেন। কিন্তু সংক্রমণের কোনরকম ভয়াবহ ঘটনা ঘটেনি, শুধু এই নিয়ম কঠোরভাবে পালনের জন্য। এছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে কিছু রুটিন মাফিক কাজ তারা লাগাতার করে যাচ্ছে। যেগুলোর ভিতর সবসময় প্রাধান্য দেওয়া হয়, মাস্ক ব্যতীত যেকোন পাবিøক প্লেসে চলাচল নিষিদ্ধ। সেটা হতে পারে যেকোন গণপরিবহন, পার্ক, সুপারমল, লোকাল মার্কেট, হাসপাতাল, ভ্রমণকেন্দ্র, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকসহ যেকারও কর্মক্ষেত্র। এছাড়াও উপরিউক্ত প্রায় সবখানেই প্রবেশের সময় সার্বক্ষণিক সকলের শরীরের তাপমাত্রা স্বয়ংক্রিয়ভাবে থার্মাল স্ক্যানারের সাহায্যে বা ম্যানুয়ালি পরিমাপের ব্যবস্থা আছে। যেখানে কারও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে মেশিনে সংকেত দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ সজাগ হয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়।
চীনা প্রশাসনের বেশ কিছু নজরকাড়া বিষয়ও সাধারণ জনগণকে এই পদক্ষেপ নিতে বেশ সাহায্য করেছে। যেমন, করোনা ভাইরাস মোকাবেলার যাবতীয় সরঞ্জামাদি যেমন: মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পোর্টেবল ছোট থার্মাল স্ক্যানার ইত্যাদি খুবই সুলভ মূল্যে জনগণের হাতের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে। যেটা দিনমজুর থেকে শুরু করে দারিদ্র্যসীমার নিচের জনগণও খুব সহজে ক্রয়সীমার নাগালে পায়।
প্রায় দেড় বছর আগে চীন থেকে নিজ নিজ দেশে ফেরা বহু ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার হাজার হাজার মানুষ অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। তারা জানেন না, কবে তারা আবার পূর্বের অবস্থানে ফিরতে পারবেন। এ বিষয়ে চীনা প্রশাসন কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বা সম্ভাবনার কথা এখন পর্যন্ত কাউকে জানায়নি। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সেই সাথে সার্বিক উন্নয়নের সাথে জড়িত এই যে এত বড় একটা জনগোষ্ঠী চীন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, তার জন্য এদের ক্ষতি হচ্ছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এরা মনে করে, যেভাবেই হোক সবার আগে করোনাকে মোকাবেলা করতে হবে। তার জন্য চীনা প্রশাসন যেকোন বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি, বৈদেশিক বাণিজ্যিক ক্ষতিসহ অন্যান্য যেকোন ক্ষতি মানতে রাজি। এরা বর্তমানে করোনা মোকাবেলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এদের ধারণা, এই বৈশ্বিক মহামারি থেকে আগে পরিত্রাণ দরকার। তার পরেই একে একে সব ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। এছাড়া গেল শীতে চীনের দুইটি প্রদেশে সামান্য কিছু আক্রান্তের খবরে পুরো প্রশাসন আবার নড়েচড়ে বসেছিল। সাথে সাথেই নিষিদ্ধ করেছিল যাবতীয় সভা, সেমিনার এবং জনসমাগম। এসব বিষয় চীনের করোনা মোকাবেলায় সবচেয়ে বেশি ফল দিয়েছে।
ভ্যাক্সিনেশন নিয়ে চীনের কারও কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কেননা, যেখানে আক্রান্তের স্তর শূন্যের কোঠায়, সেখানে ভ্যক্সিনেশন নিয়ে মাথা না ঘামানোই উত্তম। ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে কিছু বিষয়ে পরিষ্কার করা দরকার। বর্তমানে করোনার সংক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার কারণে সদ্য বাংলাদেশে সহজলভ্য ভ্যাক্সিনেরও একটা বড় ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি। কেননা, অনেকেই ভেবেছেন, ভ্যাক্সিন যেহেতু আবিষ্কার হয়েছে বা দেশে পৌঁছেছে বা অনেকেই ইতোমধ্যে নিয়েছেন, তাদের সবার ধারণা, অন্তত করোনার হাত থেকে তারা বেঁচে গেছেন। এর ফলে ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরে ভ্যাক্সিনপ্রাপ্তদের এবং সেইসাথে ভ্যাক্সিন অপ্রাপ্তদের সবার ভিতরে ‘করোনার আর কোনো ভয় নেই’ এরূপ একটা হিড়িক পড়ে গেছে। এতে করে নির্দ্বিধায় সকলে যত পারা যায় জনবহুল এলাকায় মুক্তভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে। এতে করে করোনাভাইরাস আবারো নড়েচড়ে বসেছে। এ বিষয়ে সামান্য একটু আলোকপাত করতে চাই। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু বুঝি, তাতে মনে হয়, সময়ের সাথে সাথে ভ্যক্সিনেরও আপডেট দরকার পড়বে। কেননা, গবেষকরা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছেন, করোনাভাইরাসের জিনের গঠন বহুবার পরিবর্তন হয়েছে। ফলে প্রতিবার জিনের গঠনের পরিবর্তনের সাথে সাথে ভ্যাক্সিনেরও কিছু আপডেট দরকার পড়বে। তাই ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরে ভ্যাক্সিনপ্রাপ্তদের করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বেঁচে গেছি, এই ধারণা করাটা একেবারে বোকামি বলে মনে হয়।
উপরের বিষয়গুলো খুবই সংক্ষেপে আমার বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতার আলোকে শেয়ার করলাম। বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের ভাবাটা খুবই জরুরি। বারে বারে ভোগান্তির চেয়ে একবারে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে সেটার যথাযথ প্রয়োগ করে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। যেটা চীন করেছে। যদিও চীনের মতো এতটা কড়াকড়ি পদক্ষেপ আমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব না, তার পরেও তাদের থেকে যেটুকু পারা যায় সেটুকু নিয়ে এই আপদকালীন সময়কে মোকাবেলা করাই উত্তম। কেননা, প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়া আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি যে অনেক খারাপের দিকে যাবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সাথে জনগণের উচিত, প্রশাসনের সঙ্গে সবাই একযোগে কাজ করে করোনাভাইরাসকে সমূলে নির্মূল করা।
পরিশেষে এটুকু বলব, প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক। আসুন, নিজের জীবনের মূল্য নিজেরাই অনুধাবন করি। মানব জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত আর এই সংক্ষিপ্ত জীবনকে কীভাবে আরও সুন্দর এবং স্বাচ্ছন্দ্যভাবে সাজানো যায়, সেদিকে খেয়াল করি। সবাই সচেতন হই। চীনের জনগণ পারলে আমরা কেন পারব না? আমরা বিষয়গুলো নিয়ে একটু সময় বের করে ভাবি। নিজের ভালো নিজেরাই বুঝতে শিখি। তবেই আমরাও করোনাকে জয় করে সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে নিজেদের ফিরিয়ে আনতে নিশ্চয়ই সমর্থ হবো।
লেখক: গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজো, ফুজিয়ান, চীন।
ajoymondal325@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন