রাজশাহী শহর থেকে সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরে পৌঁছেই দেখি স্থানীয় এক সাংবাদিক অপেক্ষা করছেন। তিনি দেখাতে নিয়ে গেলেন শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা নদী। নদীর কয়েক কিলোমিটার ঘুরিয়ে এসে বললেন, এই হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের নদীর চিত্র! আমিতো দেখতে যাব পদ্মা নদীর বাংলাদেশ প্রবেশমুখ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার দূরত্ব অনেক। ভারতের হুগলী থেকে ওই উপজেলার মানাকোসা ও দুর্লভপুর এলাকায় পদ্মা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জেলা শহর থেকে বহুদূরে হওয়ায় স্থানীয় সাংবাদিকরা পদ্মার প্রবেশমুখে যেতে আগ্রহী নন; তারা জীবনে কোনোদিন যাননি। স্থানীয় সাংবাদিক রাজশাহীর ফিরতি বাসে তুলে দিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন!
ঢাকা থেকে পদ্মার প্রবেশ মুখ দেখার জন্য এতদূর এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাব? মন সায় দিচ্ছে না ফিরে যেতে। আগেই ইনকিলাবের জেলা ও উপজেলা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু স্থানীয় ওইসব সাংবাদিক ঢাকার পত্রিকার ‘আইডি কার্ড’ ব্যবহার করে রুটি রুচির ধান্দা করলেও সাংবাদিকতা বা প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে খবর সংগ্রহ করতে উৎসাহী নন। তারা মূলত তথাকথিত সাংবাদিকতায় অভ্যস্ত। রাজশাহীর ফিরতি বাসে ছেড়ে দিয়েছে। সিটে পরিচয় হলো জনৈক মো: রুবেলের সঙ্গে; তিনি জানালেন তার বাড়ি শিবগঞ্জের উপজেলার দুর্লভপুর। ঢাকার সাংবাদিক পদ্মার দূরবস্থা দেখতে এসে সেখানে যেতে না পেরে মহানন্দা দেখেই মনের দুঃখে ফিরে যাচ্ছি শুনেই বললেন, ‘আপনি যেতে চাইলে বাস থেকে নামেন আমি আপনাকে নিয়ে যাব’। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! দু’জনই বাস থেকে নেমে পড়লাম। দুপুরে হোটলে খেয়ে তিনি নিজের মোটরসাইকেলে আমাকে নিয়ে ছুটলেন শিবগঞ্জের দুর্লভপুরের দিকে।
এগিয়ে চলছে বাইক। ৪০ থেকে ৪২ কিলোমিটার যাওয়ার পর পদ্মার দেখা মিললো। এ কোন পদ্মাকে দেখছি? নদীর ৬০ ভাগ শুকিয়ে বিশাল চর জেগেছে। যেদিকে চোখ যায় শুধুই বালুরাশি! কিছু অংশে পানি প্রবাহ থাকলেও তিন ভাগে তা প্রবাহিত হওয়ায় কাজে আসছে না। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের জীবন ব্যবস্থায়। বর্তমানে সেচ ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পদ্মায় পানি না থাকায় চৈত্রের খরায় বিশুদ্ধ পানির জন্য বসানো নলকূপে পানি উঠছে চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এ ছাড়াও কোনো কোনো নলকূপে পানিই উঠছে না। প্রবেশ মুখে পদ্মা নদীর পানি শুকিয়ে ধু ধু বালুচরে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নদীতে পানি প্রবাহ না থাকায় মানুষের মধ্যে হতাশা। কেউ কেউ বলছেন, ৩০ বছরের পানি চুক্তি করা হয়েছে কাজির গরু কেতাবের মতোই। পানির ন্যায্য হিস্যা ভারত কখনো দেয়নি। পানির জন্য ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে এমন খবর শোনেননি চরের মানুষ। তাই পানির অভাবে পেশা বদল করে বিভিন্ন পেশায় চলে গেছেন মানুষ। যারা কোনো পেশায় যেতে পারেননি তারা দিনভর মাছ ধরে দুশ’ তিনশ’ টাকা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন অনেক কষ্টে।
আগের দিন রাজশাহী শহরের বড়কুটি পদ্মা গার্ডেনে গিয়েছিলাম। ইনকিলাবের রাজশাহী ব্যুরো প্রধান রেজাউল করিম রাজু ভাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। যেদিকে চোখ যায় ধু ধু বালুচর। মাইলের পর মাইল নদী শুকিয়ে মরুভ‚মি হয়ে গেছে। নৌকার বদলে চলছে ট্রাক, ঘোড়ার গাড়ি। এর আগে রাজশাহীর পবা উপজেলার পদ্মার চর মাঝেরদিয়া ঘুরেছি। সীমান্ত গ্রাম হারুপাড়া, খাসমালপাড়া ঘুরে দেখেছি পদ্মার পানি প্রবাহের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। অথচ এক সময় ওই সব এলাকায় খরস্রোতা নদী ছিল। পূর্ব পাড়া, আদর্শগ্রাম নামে দুটি গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বললাম। তারা জানালো এবারের বন্যায়ও পানি ছিল প্রচুর। নদীর দুই পাড় ভেঙেছে পানির স্রোতে। কিন্তু চৈত্র মাস শুরু হতে না হতেই নদী শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে। পদ্মা নদীর বুকে নৌকার বদলে ট্রাক ও ট্রাক্টর চলছে। হুমায়ুন কবির নামের একজন বললেন, আমার বাবা-দাদা সবার পেশা ছিল মাছ ধরা। এক সময় নৌকায় করে পদ্মায় মাছ ধরতাম। গ্রামের অনেকের পূর্বপুরুষ মাছ ধরে সংসার চালাতেন। পদ্মায় পানি না থাকায় নদীতে এখন মাছ পাওয়া যায় না; এখন ট্রাকের হেলপারি করি। হারুপাড়া গ্রামের আতাহার আলী বললেন, নদীতে মাছ ধরতাম। নদীতে পানি না থাকায় গরু প্রতিপালন করছি। ছেলে নৌকার বদলে ট্র্যাক্টরে করে পণ্য পরিবহন করে থাকে। দুর্গাপুরের রাখাল রফিকুল ইসলাম বললেন, আগে নৌকায় মানুষ পারাপার করতাম। মাঝে মাঝে নদীতে মাছ ধরতাম। এখন নৌকার বদলে ট্রাকে করে মানুষ বহন করি। ইট বালু পরিবহন করি। কয়েক মাস আগে পদ্মার যে এলাকায় ৭ থেকে ৯ ফুট পানি ছিল; সেখানে এখন ট্রাক চলাচল করে। নদীর বুকে রীতিমতো ট্রাক চলাচলের রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে পদ্মার প্রবেশদ্বার গোদাগাড়ীর ভূখন্ড। নদীতে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল পদ্মার এই পয়েন্টে পানি নেই বললেই চলে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে পদ্মা চলে গেছে ফের ভারতীয় ভূখন্ডের মধ্যে। হেলালুর রহমান নামের এক ছেলে জানালেন, পদ্মার কিছু এলাকায় পায়ের গোড়ালিও ভিজে না। হেঁটেই নদী পার হচ্ছেন গোদাগাড়ীর চরাঞ্চলের মানুষ। বেশিরভাগ ধু ধু বালুচরে চলছে গরুর গাড়ি। কোথাও চলছে ট্রাক্টর ও ট্রাক। আর পানি না থাকায় নদীতে মাছ ধরতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন পদ্মা পাড়ের জেলেরা।
গোদাগাড়ীর স্থানীয় এক পরিবেশবিদ শহিদুল ইসলাম পরিচয় জেনে চায়ের দাওয়াত দিলেন। নিজ বাসায় চা খেতে খেতে জানালেন, বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের মনোহরপুরে মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান। ১৯৭৫ সালে বাঁধ চালুর পর থেকে এর প্রভাবেই মূলত পদ্মা এখন ধু ধু বালুচর। ’৭৬ সালে মাওলানা ভাসানী ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছেন। তখন থেকে পদ্মা পাড়ের মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু সরকার কঠোর না হওয়ায় মানুষ পদ্মার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে কিছুই করতে পারছেন না। শহিদুল ইসলাম বললেন, ভারতের গঙ্গা রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কিছু অংশ দিয়ে প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করেছে। একসময়ের খরস্রোতা এ পদ্মা রাজা রাজবল্লভের কীর্তি ধ্বংস করে দিয়েছে। যার জন্য পদ্মাকে স্থানীয়রা কীর্তিনাশা নদী নামেও চেনেন। নদীর স্রোত আর গাতিধারার সেসব কথা পদ্মা পাড়ের মানুষের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি। মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বছরের অধিকাংশ সময়ই এখন পদ্মার বুকে পানি থাকে না। দেখা যায় না পালতোলা নৌকা আর মাঝিমাল্লাদের গান। শুষ্ক মৌসুমের আগেই পদ্মায় নৌকা চলাচল রুদ্ধ হয়ে যায়। নৌকার যায়গা দখল করেছে ট্রাক আর ঘোড়ার গাড়ি।
এদিকে পদ্মার পাবনার পাকশির হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা নদীর বুক জুড়ে ধু ধু বালুচর। রেল সেতু ও সড়ক সেতুর নিচে গম, ডাল, বাদামসহ নানান শষ্যের চাষাবাদ হচ্ছে। নদীর পানি প্রবাহ একেবারেই স্থির। পাবনা শহর থেকে দক্ষিণে ৬ কিলোমিটার দূরে পদ্মার বাম তীর। এখান থেকে পদ্মার ওপারে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ী। কুষ্টিয়ার সেই পয়েন্টে পদ্মা নদী শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বুক চিরে প্রায় ৫ কিলোমিটার শুধু ধু ধু বালুচর। এ বালু চরের মাঝে দু’টি স্থানে পানির সরু চ্যানেলে নৌকা দেখা গেল। নৌকাতে চড়ে মানুষ পাড় হয়ে বালু চরে আবার হাঁটছে ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার। এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মার বালু চরেই এখন ঘোড়ার গাড়ী, ট্রাক, ট্রাক্টরে চড়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নদী পারাপার হচ্ছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন