মাহে রমজানকে সামনে রেখে কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়ছিল। এবার লকডাউনের ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আরও অস্থির হয়ে উঠেছে নিত্যপণ্যের বাজার। সরকারের কোনও হুমকি-ধামকি কাজে আসছে না। স্বভাবগতভাবেই একশ্রেণির ক্রেতা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বাজারে এবং পাড়ামহল্লার দোকানে। আর অসাধু ব্যবসায়ীরাও সেই সুযোগটি লুফে নিচ্ছে। এখন চলছে- চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্য কেনাকাটার ধুম। লকডাউন শুরু হলে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে- এ আশঙ্কায় নিত্যপণ্য মজুতের যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
প্রতিবছর রমজান এলেই একশ্রেণির ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে সরকার সতর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল সকালে তিনি তার সরকারি বাসভবনে দেয়া ব্রিফিংয়ে এই কথা বলার সঙ্গে এক সপ্তাহ লকডাউনের ঘোষণা দেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাজার নতুন করে অস্থির হয়ে উঠে।
ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বাজার অস্থির করার যে কোনও অপপ্রয়াস সরকার মেনে নেবে না। অহেতুক মূল্যবৃদ্ধি ও মজুতদারি নিয়ন্ত্রণে সরকার সতর্ক। ইতোমধ্যে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কোনও ধরনের সিন্ডিকেটের কাছে সরকার বাজার ব্যবস্থাকে জিম্মি হতে দেবে না। সরকার তথা মন্ত্রীর এসব হুঁশিয়ারিকে তোয়াক্কা না করেই বেড়ে গেছে- তেল, পেঁয়াজ, সবজি, ডিম, আলুসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম। সরকার নির্ধারিত দামে কখনোই কোনও পণ্য বিক্রি হয়নি বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা।
গতকাল সকালে ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল দেশি পেঁয়াজ। লকডাউন ঘোষণার পর সেই পেঁয়াজ বিকেলে বিক্রি হয় ৪০ টাকায়। স্থান ভেদে তা ৪৫ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। চালের দাম আগে থেকেই সরকারের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ৫৫ টাকার নিচে খাওয়ার উপযোগী মোটা চাল নেই। ৭০ টাকার নিচে নেই চিকন চাল। লকডাউনের এক ঘোষণায় প্রতি ডজন ডিমের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারদরের দোহাই দিয়ে ভোজ্যতেল বিশেষ করে সয়াবিন তেল আগে থেকেই বেশি দামে বিক্রি করছে কোম্পানিগুলো। এমন পরিস্থিতিতে সরবরাহ সংকটের কথা বলে বাড়তি সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ১৪০ টাকা লিটার দরের সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৫২ টাকা লিটার দরে। আশঙ্কা করা হচ্ছে লকডাউন ঘনিয়ে এলে দাম আরও বাড়তে পারে।
এদিকে রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে লকডাউনের এক সপ্তাহ দিনে অন্তত চার ঘণ্টার জন্য ব্যবহারিক বিলাসী পণ্যের পাইকারি দোকান খোলা রাখার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। গতকাল সারা দেশে লকডাউন ঘোষণার পর তারা এ দাবি জানিয়ছেন। সংগঠনের সভাপতি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসের সঙ্গে কথা বলে দাবিটি জানিয়েছি। তারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।
কারণ ব্যাখ্যা করে হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, যেহেতু গত রমজান এবং ঈদে দেশের সব মার্কেট বন্ধ ছিল একই লকডাউনের কারণে, এবারও যদি বন্ধ থাকে তাহলে বিলাসী পণ্য বিশেষ করে ঈদের জামাকাপড়, কসমেটিকসের মতো পণ্যের ব্যবসায়ীরা মাঠে মারা যাবেন। আপাতত এসব পণ্যের পাইকারি মার্কেট খোলা রাখার অনুমতি চাই আমরা। কারণ এই মুহূর্তে এসব পণ্যের খুচরা বিক্রি শুরু হয়নি। চলছে পাইকারি পর্যায়ের বিক্রি। তাই আমরা এই সুযোগটি দৈনিক মাত্র চার ঘণ্টার জন্য চেয়েছি।
এদিকে দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লকডাউনেও অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে র্যাব। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ায় আগামীকাল (৫ এপ্রিল) থেকে সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এসময়ে যাতে অসাধু চক্র সুবিধা নিতে না পারে সেজন্য লকডাউনেও গোয়েন্দা নজরদারি ও র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, লকডাউনের সুযোগ নিয়ে যাতে কোনও অসাধু চক্র জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে না পারে সেই লক্ষ্য নিয়ে র্যাব মাঠে থাকবে। র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিও থাকবে।
কাওরানবাজারের নিত্যপণ্যের পাইকারি ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম লালমিয়া জানান, এখন চলছে রোজার বেচাকেনা। রোজা উপলক্ষে রাজধানীর খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্যের মজুদ গড়ছেন। এমন সময় লকডাউনের ঘোষণায় শনিবার দুপুরের পর থেকে পণ্যের বেচাকেনা বেড়েছে কয়েকগুণ। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিমত, যেহেতু লকডাউনে নিত্যপণ্যের দোকান খোলা থাকবে, কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকবে, সেসময় পরিবহন খরচও বাড়বে। তাই আগেভাগেই অতিরিক্ত পণ্য কিনে রাখছেন তারা।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গণমাধ্যমকে বলেছেন, বাজারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। চলবে গোয়েন্দা নজরদারি। আতঙ্কিত হয়ে ক্রেতাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য না কেনার পরামর্শ দিচ্ছি। আতঙ্কিত হবেন না। কোনও পণ্যেরই ঘাটতি নেই। দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণের নিত্যপণ্য মজুদ রয়েছে।
চট্টগ্রামে বাজারে ভিড়
চট্টগ্রাম ব্যুরো : এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণার পর চট্টগ্রামের কাঁচাবাজারে ক্রেতার ভিড় লেগেছে। গতকাল শনিবার দুপুরের পর থেকে নগরীর হাট-বাজারে ক্রেতা সমাগম বাড়তে থাকে। অনেকে অতিরিক্ত পণ্য কিনছেন। আবার অনেকে আসন্ন মাহে রমজানের বাজারও সেরে নিচ্ছেন। ব্যবাসয়ীরা বলছেন সপ্তাহের প্রথম শনিবার এবং মাসের শুরু। তার উপর সামনে রমজান থাকায় ক্রেতার ভিড় এমনিতেই বেশি। তার উপর লকডাউনের ঘোষণায় বাজারে ক্রেতার স্রোত নামছে। হঠাৎ ক্রেতা বেড়ে যাওয়ায় কিছু কিছু পণ্যের সঙ্কট দেখিয়ে অতিরিক্ত দাম আদায়ের অভিযোগ করছেন ক্রেতারা।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সোমবার থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা আসার পর নগরবাসী বাজারমুখী হতে শুরু করেন। যদিও এর আগে শুক্রবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগরীতে সন্ধ্যা ছয়টার পর ওষুধের দোকান ও কাঁচাবাজার ছাড়া অন্য সবকিছু বন্ধ রাখার গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
এরপরও লকডাউনের সময় চলাচল সীমিত হতে পারে এবং বাজারে নিত্যপণ্যের সঙ্কট দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কায় অনেকে বেশি করে ভোগ্যপণ্য কিনে রাখছেন। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, আলুর মতো পণ্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি করে কিনে রাখছেন অনেকে।
গতকাল বিকেলে নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজার, চক বাজার, বহদ্দারহাট কাঁচা বাজার, আগ্রাবাদ কর্ণফুলী বাজার, কাজির দেউড়ি বাজার, স্টিল মিল, পাহাড়তলী বাজার, ষোল শহর কর্ণফুলী বাজারসহ নগরীর ছোট বড় সব বাজারে ছিলো উপচেপড়া ভিড়। এসব বাজারের প্রবেশ পথে রীতিমত যানজটের সৃষ্টি হয়। মাছ গোশত শাক-সবজির দোকানের পাশপাশি মুদি দোকানেও ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ক্রেতাদের অনেকে বেশি পণ্য কিনছেন। আজ রোববারও বাজারে এমন ভিড় থাকবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এদিকে ফের লকডাউন ঘোষণায় উৎকন্ঠায় নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন