শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মানসিক চাপ থেকে কিভাবে মুক্ত হবেন

আশ্ফা খানম হেলেন | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২৫ এএম

মানসিক চাপ আমাদের নিত্যসঙ্গী। একে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলা যায়। অথচ শারিরীক সুস্থতার জন্য মানসিক সুস্থতা জরুরি। পূর্বে মানসিক সুস্থতা নিয়ে মানুষ এত সচেতন ছিল না। বর্তমানে মানুষ এ ব্যাপারে সচেতন। আমরা প্রাথমিকভাবে স্ট্রেস কী বুঝার চেষ্টা করবো। বিজ্ঞানের ভাষায় এর সংজ্ঞা হচ্ছে, It is a form that occurs because of how events in ones external or internal environment are perceived, resulting in the physiological experience of distress and anxiety. এটি একটি এলার্ম সিস্টেমের মতো। যখনই আমরা কোনো রকম স্ট্রেসে থাকি, তখন শরীরে এলার্ম সিস্টেম অন হবার কারণে আমাদের মানসিক চাপ বেড়ে যায় এবং শরীর তখন অপ্রত্যাশিত আচরণ করা শুরু করে। আবার মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কমলে শরীর আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। আমাদের বর্তমান জীবন এতো বেশি স্ট্রেসপূর্ণ যে, এ এলার্ম যেন বন্ধই হয় না। আমরা যদি জিজ্ঞেস করি স্ট্রেস ছাড়া এমন কাউকে আপনি চেনেন? উত্তর না হবারই সম্ভাবনা বেশি।
নিজেকে স্ট্রেস মুক্ত রাখতে হলে প্রথমেই আমাদেরকে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। অতঃপর কী কী বিষয় আমাদের স্ট্রেস লেভেলকে বাড়িয়ে দেয় তা অনুসন্ধান করে বের করতে হবে। যেমন: পরিবারের ছোটকাজের স্ট্রেসের কথাই ধরি। কিছুক্ষণ পর পর খাবার টেবিলে এক একজন পরিবারের সদস্য খেতে এলে তা পরিবারের গৃহকর্ত্রীর কাজের এবং মানসিক চাপ বাড়ায়। কিছুক্ষণ পর পর তাকে নিশ্চিত করতে হয় সবাই সবকিছু ঠিকমতো খেতে পেয়েছে কিনা। এ ক্ষেত্রে এটি গৃহকর্ত্রীর জন্য খুবই অসহ্য এক মানসিক চাপ। কিন্তু পরিবারের সবাই যদি একসাথে খেতে বসার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একসাথে খায় তাহলে এতে গৃহকর্ত্রীর অহেতুক মানসিকচাপ কমে যাবে। অতএব, স্ট্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সর্বপ্রথম এর কারণগুলো জানতে হবে। আরো বড় ক্ষেত্রের কথা বললে আমরা চাকরির ক্ষেত্রে স্ট্রেস, দাম্পত্য সমস্যা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমস্যা, সন্তান লালন-পালনের চাপ প্রভৃতির কথা বলতে পারি। দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটি মানুষই এরূপ বিভিন্ন কাজের চাপের শিকার। আবার কখনো কখনো ভালো কাজ আমাদের মধ্যে মানসিকচাপ সৃষ্টি করে। যেমন: নতুন বাড়িতে উঠা, নতুন কাজে যোগদান, নতুন সংসার শুরু করা, প্রথম মা-বাবা হওয়া ইত্যাদি
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, ভালো বা মন্দ যাই ঘটুক না কেন, আমাদের জীবনে সবই মানসিকচাপের সৃষ্টি করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এই বাস্তবতা বা সত্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো এবং মানসিকচাপমুক্ত জীবনযাপন করতে পারবো? কিছু বাস্তবতা আছে, যা নিয়েই আমাদের জীবনধারণ করতে হয়। যেমন : প্রতিবন্ধী শিশু পালন, কিংবা নিজের কোন শারীরিক দুর্বলতা বা অক্ষমতা অথবা প্রিয়জনের মৃত্যু প্রভৃতি। আবার আধুনিক যুগে মানুষ যে সকল মানসিকচাপের শিকার হচ্ছে পূর্বে কোন যুগেই মানুষ সেগুলোর মুখোমুখি হয়নি। কারণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেট এখন বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের সুসংবাদ বা দুঃসংবাদ, বিভিন্ন প্রকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, কষ্টের চিত্র আমাদের দেয় এবং প্রতিমুহূর্তে বিচলিত করে মানসিকচাপ সৃষ্টি করে। এছাড়া অন্যের হাসিমাখা চেহারার ছবি প্রতিনিয়ত এই অনুভূতি সৃষ্টিকরে যে, ‘ইস! আমি কত দুঃখী’। অথচ, আমরা বুঝি না যে, যারা হাসিমাখা ছবি দিয়েছে তাদেরও অনেক মানসিক যন্ত্রণা আছে। কিন্তু তারা সেটি শেয়ার না করে আনন্দের স্মৃতি শেয়ার করেছে। নবম শতাব্দির পার্সিয়ান প্রসিদ্ধ মুসলিম পলিম্যাথ, জিওগ্রাফার, ম্যাথমেসিয়ান, ফিজিসিয়ান, সাইকলোজিস্ট এবং বিজ্ঞানী আবুজায়েদ আল বালখী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মাসালা আব্দুল আল আনফুসে শরীর ও আত্মা সম্পের্কে যা বলেছেন, আমরা বর্তমানে তার নাম দিয়েছি মন-দেহের ঔষধ, যদিও ঊনবিংশ শতাব্দিতে obsessive compulsive disorder সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়।
এই বিষয়কে নতুন বলা হলেও বালখী স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট বা নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়ে অনেক আগেই আলোচনা করেন। শুধু তাই নয়, তিনি এর শ্রেণিভেদ করেন এবং এর প্রতিকারও দেন। তিনি বলেন, মানবাত্মা মানব শরীরের মতোই সুস্থ বা অসুস্থ হতে পারে। আমরা যেমন শারীরিক অসুস্থতার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হই, ঠিক তেমনই মানবাত্মার অসুখ হলে তা সুস্থ করা জরুরি। আত্মার সুস্থতার জন্য আমাদের ইমোশন বা অনুভূতিগুলোর (tune up) টিউনআপ করা জরুরি। মানবাত্মা দুই ধরনের চাপের সম্মুখীন হয়। বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ। তিনি বলেন, অনবরত যে কোনো বিষয়ে নেগেটিভ চিন্তা আমাদেরকে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ করে তোলে। এটি অভ্যন্তরীণ মানসিক চাপ। বর্তমানে একে CBT (cognitive behaviour therapis.) বলে। আর বাহ্যিক মানসিক চাপ হচ্ছে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া অপ্রাত্যাশিত ঘটনা, যা আমাদের চিন্তিত করে অথবা কারো কাছ থেকে শোনা কোনো খারাপ ঘটনা বা নেগেটিভ বা অপছন্দনীয় কথা। তিনি বলেন, স্ট্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রথমে নিজেকে একটি স্থিতি অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মনে রাখতে হবে, বিপদ আমার দুয়ারে যে কোনো সময় কড়া নাড়বে। কারণ স্থিতি বা প্রশান্ত অবস্থায় নিজেকে বুঝানো সহজ।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আমরা সব সময় নতুন মানসিকচাপ বা বিপদের কথা স্মরণ করবো? কারণ, আমাদের এই বিশ্বাসের ধারায় এ সত্যই প্রতিভাত হবে যে এই জীবন একটি মানসিক চাপের স্থান। জীবন অনেক কঠিন। এটি পরীক্ষা ক্ষেত্র। আর প্রতিটি পরীক্ষাই আমাদের মানসিকচাপ বাড়ায়। অতএব, সব প্রকার মানসিক চাপই আমাদের জন্য পরীক্ষা। আমাদের জীবন সমস্যায় জর্জরিত। যেমন: বৈবাহিক সমস্যা, চাকরি হারানো, সন্তানদের মনের মতো মানুষ করতে না পারা, আর্থিক অসচ্ছলতা, সামাজিক বা পারিবারিক জীবনে বিভিন্ন বিষয় মনঃপুত না হওয়া প্রভৃতি। সকলের মানসিকচাপ সহ্য করার ক্ষমতা একই রকম নয়। সবাই সব পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে পারে না। ভালো বা মন্দ যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তিনি নিজেকে trained up করার জন্য গুরুত্ব দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি দু’টি পদ্ধতির শিক্ষা দেন। প্রথমত: জীবনে যখনই কোনো মন্দ কিছু ঘটে বা এর জন্য মানসিক চাপ হয় তখন ভালো স্মৃতির কথা স্মরণ করে তা দূর করা।
কিংবা কারো মন্দ কথায় আহত হলে সে সময় তার সাথে জড়িত ভালো স্মৃতিগুলো স্মরণ করা। এভাবে মন্দকে ভালো দিয়ে প্রতিহত করলে মানসিক চাপ অনেকাংশে কমে যায়। পবিত্র কুরআনেও আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, ফাহেশা বা মন্দ কথা বলা লোকদের সালাম জানিয়ে সে স্থান পরিত্যাগ করো। শুধু তাই নয়, আল্লাহতায়ালা বলেন, তাঁর মুমিন বান্দারা মন্দকে ভালো দিয়ে প্রতিহত করেন। আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কারণে মানসিক চাপকে যখন আমরা এভাবে প্রতিহত করতে শিখবো তখন বড় কোনো বিপদে মানসিক চাপ নেবার যোগ্যতা সৃষ্টি হবে। ফলে যে কোনো পরিস্থিতিকে আমরা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো।
আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, বেশি বেশি মানুষের সাথে রহঃবৎধপঃরড়হ করা। আমরা জানি, প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র। তাদের স্বভাব চরিত্রও স্বতন্ত্র। কাজেই, আমরা যত বেশি মানুষের সাথে মিশবো তত বিভিন্ন প্রকার স্বভাবের মানুষকে সহ্য করার গুণ অর্জন করবো। আর যত বেশি সহ্য করবো ততই রাগান্বিত হবার পরিস্থিতি বা উদ্বিগ্নতা বা স্ট্রেসফুল মানসিক অনুভ‚তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হবো। তিনি ছোট বড় যে কোন পরিস্থিতিতে ড়াবৎ ৎবধপঃ না করার পরামর্শ দেন। বিপদ বা সমস্যা জীবনে আসবেই। ছোটখাট বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হওয়া প্রাত্যহিক ব্যাপার। অতএব, আমাদের আত্মাকে বা হৃদয়কে trained up করতে হবে এবং নিত্যদিনের সমস্যাগুলো সুন্দরভাবে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। (চলবে)
লেখক: নারী উন্নয়ন কর্মী, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ ও প্রিন্সিপাল, চিটাগাং ভিক্টোরী ন্যাশনাল স্কুল (সিভিএনএস)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
md.omar faruk ৭ এপ্রিল, ২০২১, ৩:৪৫ পিএম says : 0
Good Trainer Thanks,
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন