হাওরের কৃষকের বঞ্চনার যেমন শেষ নেই, তেমনি তাদের দুর্ভাগ্যেরও কোনো সীমাপরিসীমা নেই। বারবার ফসল হারানোর বেদনাকে দূরে সরিয়ে এবার তারা আশায় বুক বেঁধেছিল। আর কদিন পরেই শুরু হবে ধান কাটার ধুম। স্বপ্নের সোনালী ফসল তুলবে ঘরে। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন আবারো পুড়ে ছাই হলো বৈশাখের তপ্ত ঝড়ে। যেসব ধানের শীষ বেরুচ্ছে অথবা এখনো চাল পরিপুষ্ট হয়নি গত রোববার কালবৈশাখী ঝড়ো হাওয়ায় সে সব ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ভয়াবহ ক্ষতি কিভাবে পোষাবে তা ভেবে নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চল হিসেবে খ্যাত মোহনগঞ্জ, মদন ও খালিয়াজুড়ি থানা এলাকার হাজার হাজার কৃষক পরিবার এখন দিশেহারা। গতকাল সোমবার সকাল থেকে হাওরাঞ্চলে চলছে কৃষকদের বিলাপ করা কান্না।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হঠাৎ সন্ধ্যায় প্রচন্ড গতিতে ধূলাবালিসহ ঝড়ো বাতাস শুরু হয়ে ৩-৪ ঘণ্টাব্যাপী বৃষ্টিহীন গরম বাতাসের তান্ডব চলে। এতে ধানের শীষের রেনু ঝরে পড়াসহ তৌওড় গর্ভ জমির ক্ষতি হয়েছে বেশি, আবার অনেক জমিতে পাতা পুড়ে যাওয়া লক্ষণও দেখতে দিয়েছে। এলাকার অনেক গ্রামের কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর মধ্যে চলছে আহাজারি এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে জনসাধারণের মুখ হতে। হাওরের ফসল ছাড়াও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মৌসুমি ফলেরও।
মোহনগঞ্জ থানার হাটনাইয়া গ্রামের কৃষক আজহারুল ইসলাম মানিক গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গত ৪ এপ্রিল রোববার বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ, মদন ও খালিয়াজুড়ি থানার বিশাল হাওর এলাকায় গরম ঝড়ো বাতাস হয়। ওই বাতাসের পর হাওরের লাখ লাখ হেক্টর জমির নতুন ধান নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয় ভাবে বলা হয় চুচা। স্থানীয় লোকজন এটিকে আল্লাহ’র গজব বলে উল্লেখ্য করছেন। এ ধরনের ঘটনা গত ৭০ বছরেও কেউ দেখেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, মোহনগঞ্জ ৭টি ইউনিয়নের ছোট-বড় প্রায় ২০-২৫ হাওরের বি২৯ জাতের ধানি জমির ৭০% ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে যে সব জমিতে আগে ধান চাষ করা হয়েছে তার তেমন ক্ষতি হয়নি। সেই সব জমির মধ্যে কিছু জমির ধান এখন কাটা শুরু হয়েছে।
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে খালিয়াজুরী উপজেলায় ১৯ হাজার ৯ শত ৫০ হেক্টর, মদনে ১৭ হাজার ৩ শত ৪০ হেক্টর ও মোহনগঞ্জ উপজেলায় ১৭ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। এবার আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হবে বলে আশা ছিল কৃষকদের। সারা বছরের একমাত্র হাড়ভাঙা কষ্টে ফলানো সোনার ফসল ঘরে তুলতে কৃষকরা বিভোর সময় পার করছেন। জমিতে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেছে। কিন্তু গত রবিবার সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে মাত্র কয়েক মিনিটের কালবৈশাখী ঝড়ের গরম বাতাস যেন কৃষকদের সব স্বপ্ন বিলীন করে দিয়েছে। ধার-দেনা করে এক ফসলি জমির ফসল হারিয়ে পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই কৃষকের।
মদনের তিয়শ্রী ইউনিয়ের বাগজান গ্রামের কৃষক আবুল মিয়া, খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দীপুর গ্রামের আরিফ মিয়া ও মদনের ব্যবসায়ী আবুল হাসনাতসহ অনেকেই জানান, হাওরের এক ফসলি বোরো জমির ফসল দিয়ে সারা বছর পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। রোববার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টার গরম বাতাসে অধিকাংশ জমির সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। ঋণ করে জমিতে ফসল উৎপাদন করেছিলাম। এখন সারা বছর খাব কি আর কি দিয়ে ঋণ পরিশোধ করব। সরকার যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
গতকাল সকালে মদন উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদসহ কৃষি বিভাগের লোকজন হাওরাঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। মদন উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কৃষি অফিসার রায়হানুল হক জানান, রোববার সন্ধ্যায় কালবৈশাখী ঝড়ে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান জানান, খবর পেয়ে আমি স্থানীয় কৃষি অফিসারদের নিয়ে মদন, মোহনগঞ্জ ও কালিয়াজুরী উপজেলার বিভিন্ন হাওরাঞ্চল পরিদর্শন করছি। যে সমস্ত জমিতে এখনও ধান পাকে নাই সে সমস্ত জমির ধান গরম বাতাসের কারণে চিটা হয়ে গেছে। আমাদের লোকজন মাঠে আছে। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপনের চেষ্টা চলছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন