বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সোর্স পায় না দুদকের ‘সোর্সমানি’

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৪ এএম

সোর্সের জন্য বরাদ্দকৃত ‘সোর্সমানি’ পাচ্ছেন না দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনো সোর্স। সোর্সের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে অন্য খাতে। এক খাতের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অন্যখাতে ব্যয়ের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটি অনেক প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। অথচ একই ঘটনা হরদম ঘটছে খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনেই। সোর্সমানি ব্যয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটিতে পুরোনো। পূর্বসুরিদের অনুসরণে এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হচ্ছে এখনও। তাই এ বিষয়ে একটি অভ্যন্তরীণ গাইডলাইন প্রয়োজন বলে মনে করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

দুদক সূত্র জানায়, আইনে প্রাপ্ত ‘আর্থিক স্বাধীনতা’র আওতায় দুদকের অর্থ ব্যয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না অডিট বিভাগ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সোর্সমানি নিয়ে দুদক কর্মকর্তাদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে চাপা অসন্তোষ। দুদকের মুষ্টিমেয় কর্মকর্তার মাঝে বণ্টন হচ্ছে এ অর্থ। অধিকাংশ কর্মকর্তাই বঞ্চিত হচ্ছেন সোর্সমানি থেকে। ফলে সোর্সের পেছনে ব্যয় হচ্ছে না দুদকের সোর্সমানি। প্রশ্ন উঠেছে, দুদকের সোর্সমানি তাহলে যায় কোথায়?

সূত্রমতে, আইনে দুর্নীতি দমন কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৫(১) ধারায় কমিশনের আর্থিক ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সরকার প্রতি অর্থ বৎসরে কমিশনের ব্যয়ের জন্য উহার অনুকূলে নির্দিষ্টকৃত অর্থ বরাদ্দ করিবে এবং অনুমোদিত ও নির্ধারিত খাতে উক্ত বরাদ্দকৃত অর্থ হইতে ব্যয় করার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করা কমিশনের জন্য আবশ্যক হইবে না।’
(২) এই ধারার বিধান দ্বারা সংবিধানের ১২৮ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মহাহিসাব নিরীক্ষকের অধিকার ক্ষুণœ করা হইয়াছে বলিয়া ব্যাখ্যা করা যাইবে না। এ দু’টি ধারায় কমিশনের আর্থিক ক্ষমতা এবং স্বাধীনতার বিষয়টি স্পষ্ট। তাই সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ কোনো খাতে ব্যয় করা হবে-সেটি কমিশনের নিজস্ব এখতিয়ার। এই এখতিয়ার বলে দুদক ‘সোর্সমানি’ হিসেবে কিছু অর্থ ব্যয় করে। এ ব্যয় নিয়ে রয়েছে নানা কথা। সোর্সমানি ব্যয়ের কোনো স্থায়ী বিধিবিধান না থাকায় একদিকে উঠেছে যেমন যথেচ্ছ ব্যয়ের অভিযোগ। তেমনি রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় খাতে সোর্সমানি ব্যয় না করার অভিযোগ।

সূত্রটি জানায়, চলমান অর্থবছরে দুদকের জন্য দেড়শ’ কোটি টাকা বার্ষিক বরাদ্দ রাখা হয়। এটি বিগত অর্থবছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। সেবছর বরাদ্দের অংক ছিল ১৪০ কোটি টাকা।
আগের অর্থ বছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১২৩ কোটি টাকা। এ অর্থের অধিকাংশ ব্যয় হবে বেতন-ভাতা, দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং প্রশিক্ষণের পেছনে। দ্বিতীয় বৃহৎ ব্যয়টি হচ্ছে প্রসিকিউটরদের পেছনে।
সোর্সমানি হিসেবে বরাদ্দ হয় নগণ্য একটি অংক। সহকারী পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা দু’দফায় বছরে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে পেয়ে থাকেন। তবে অনেকেই কোনো সোর্সমানি পান না। এটি নির্ভর করে কাজের ধরন ও পরিধির ওপর।

সূত্রটি আরও জানায়, দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহে দুদকের নিজস্ব ও নির্ভরযোগ্য কোনো সোর্স নেই। প্রধান সোর্সই হচ্ছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ। এছাড়া সরাসরি করা কিছু কিছু অভিযোগও অনুসন্ধানের জন্য নেয়া হয়। এ দু’টি সোর্সের কোনোটির পেছনেই দুদকের কোনো ব্যয় নেই। যে সব পেপার কাটিং দিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক সেই পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে ন্যূনতম চা-নাশতার বরাদ্দও নেই ‘সোর্সমানি’ থেকে। সব অর্থই ব্যয় হয় দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কার্যক্রমের পেছনে।
দুদকে রয়েছে ৬টি বিভাগীয় কার্যালয়। বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত, অনিষ্পন্ন শাখা, রাজধানীসহ ৬ বিভাগের মাঠ পর্যায়, প্রতিরোধ ও গবেষণা, আইন বিভাগ, প্রশাসন ও হিসাব, ছয়টি বিভাগ দেখাশোনা করেন ৮ মহাপরিচালক। এর মধ্যে শুধুমাত্র বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখায় কর্মরতরাই সোর্সমানি পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। মাঠপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তাই সোর্সমানি পান না বলে জানান। সোর্সমানি কারা পাবেন, কেন পাবেনÑ এ বিষয়ে স্থায়ী কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরেও। একেক কমিশন একেকভাবে ‘এডহক ভিত্তিক’ পন্থা বাতলে নেন। এর ফলে এ নিয়ে দুদকে প্রতিষ্ঠা হয়েছে এ প্রকার ভাগ-ভাটোয়ারার সংস্কৃতি।
অভিযোগ বা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ‘কেস টু কেস’ সোর্সমানি দেয়া হয়। মামলার গুরুত্ব ও তদন্তের গুণগত মান বিবেচনায়ও এ অর্থ দেয়া হয় বলে দাবি করছে কমিশন।

সূত্রমতে, তদন্ত কর্মকর্তারা নিজ নিজ বিভাগের পরিচালককে ভাউচার দাখিল করে সোর্সমানির বিল করেন। সেটি ফরোয়ার্ড ও কাটছাঁট করে পাঠিয়ে দেন সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালকের কাছে। তিনি পেশ করেন কমিশনে। কমিশন দাবিকৃত সোর্সমানি থেকে কিছু হ্রাস করে অর্থ অনুমোদন করেন। অনুমোদনসমেত আবেদন যায় প্রশাসন বিভাগে। সেখানে স্বাক্ষর করে অর্থ বিভাগে সেটি দাখিল করে হিসাব বিভাগ থেকে অর্থ তুলে নেন সোর্সমানির দাবিদার তদন্ত কর্মকর্তারা।
দুদক সূত্র জানায়, সোর্সমানি মূলত ব্যয় হয় মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে। তদন্ত কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ, যোগাযোগ, যাতায়াত, বিকল্প সোর্সের মাধ্যমে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ, ফটোকপি করা, আদালতে সাক্ষী-আসামিকে হাজির করানো, সহায়ক পুলিশ সদস্যদের আহার করানোর মতো বিভিন্ন কাজে ব্যয় হয় সোর্সমানি। কর্মকর্তারা নিজ পকেট থেকে আগে ব্যয় করে পরে ভাউচার দাখিলের মাধ্যমে এ অর্থ দুদকের হিসাব বিভাগ থেকে উত্তোলন করেন।

সোর্সমানি উত্তোলনের নানা হয়রানি ও বঞ্চনার কথাও তুলে ধরেন কয়েকজন ভুক্তভোগী কর্মকর্তা। অবসরের সময় ঘনিয়ে আসা একজন উপ-পরিচালক বলেন, ২৭ বছর চাকরি জীবনে তদন্তে বহু অর্থ ব্যয় করেছি নিজের পকেট থেকে। সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে কর্মরত এমন কোনো কর্মকর্তা নেই যাদের টিএ. ডিএ. বিল বাকি পড়েনি।
বঞ্চিত কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, ন্যায্যতা নয়- মহা-পরিচালকদের ইচ্ছে অনুযায়ী বণ্টন হয় বরাদ্দকৃত সোর্সমানি। পুলিশ, এনএসআই যে সোর্সমানি পায় সেটি দুদকের পুরো বাজেটের সমান। প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত সোর্সমানির অংক যেমন বাড়ানো উচিৎ, তেমনি বণ্টন সুষম ও যৌক্তিক হওয়াও প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। কারণ, সোর্সমানি যৌক্তিক অংকের না হলে তদন্ত কর্মকর্তারা নিরুৎসাহিত হবেন। নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হতে বাধ্য হবেন। তদন্তের মানও ভালো হবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন