হক ও সত্যের ওপর অটল-স্থির থাকা এবং সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জান পর্যন্ত কোরবান করে দেয়ার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসে আছে। সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী উলামায়ে হক্কানীর জীবন কাহিনী যুগে যুগে অমর শিক্ষা-আদর্শ রেখে গেছে। তারা শাসকদের দ্বারা নিষ্ঠুর নির্যাতন ভোগ করেছেন, কারাবরণ করেছেন, কিন্তু সত্য হতে এক বিন্দুও এধার-ওধার হননি। অটল-অবিচল থেকে জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। এরূপ অসংখ্য ঘটনার মধ্যে দৃষ্টান্তস্বরূপ মাত্র কয়েকটি ঘটনার কথা নিম্নে তুলে ধরা হলো;
১. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.): কুখ্যাত অত্যাচারী-জালেম শাসক উমাইয়া সাম্রাজ্যে ইরাকের গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাকাফী জামে মসজিদে খুৎবারত। সেখানে একবার আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)ও উপস্থিত। তার বক্তব্য শুনে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বলতে লাগলেন, ‘হে খোদার দুশমন! খোদার হারাম করা বিষয়গুলোকে হালাল করেছ, খোদার ঘরকে বরবাদ করেছ এবং খোদার বন্ধুদেরকে হত্যা করেছ।’
এ কড়া বাক্যগুলো শুনে হাজ্জাজ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইনি কে?’ কেউ বললেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)’। নাম শুনে হাজ্জাজ তাকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, ‘বড়ে মিয়া! খুব বলেছ, তোমার জ্ঞান আছে কি?’ কিছু মন্দ বাক্য উচ্চারণ করে হাজ্জাজ মিম্বর হতে অবতরণ করে, রাগে ক্ষোভে অস্থির। তার মনের আগুন দাউ দাউ করে জ¦লছিল। হাজ্জাজ তার এক গোলামকে ইঙ্গিত করে। গোলাম বিষ মিশ্রিত একটি অস্ত্র ইবনে উমর (রা.) এর দিকে নিক্ষেপ করে এবং তার পায়ে বিদ্ধ হয়। ফলে তার শরীরে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে এবং তাতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাই ইতিহাসে তাকে শহীদ বলা হয়।
২. ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.): হিজরি ১৪৬ সালে আব্বাসীয় খলিফা মনসূর হজরত ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর নামে এই মর্মে পয়গাম প্রেরণ করেন যে, আপনি খেলাফতের দরবারে উপস্থিত হবেন। মনসূর তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সে জন্য অজুহাত খুঁজছিলেন। ইমাম সাহেব দরবারে উপস্থিত হলে এক ব্যক্তি তার পরিচয় তুলে ধরে বলেন, ‘বর্তমান দুনিয়ার ইনি সবচেয়ে বড় আলেম।’ মনসূর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কার নিকট শিক্ষা লাভ করেছেন?’ ইমাম প্রসিদ্ধ ওস্তাদগণের নাম উল্লেখ করলেন, যাদের শিষ্যত্বের ধারা বিশিষ্ট সাহাবাগণ পর্যন্ত পৌছে। মনসূর ইমাম সাহেবকে বিচারকের পদ গ্রহণের অনুরোধ জানান।
ইমাম সাহেব তা গ্রহণ করতে স্পষ্ট অস্বীকার করেন এবং বলেন, ‘আমি এ পদের যোগ্য নই।’ মনসূর রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘আপনি মিথ্যা বলছেন।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি মিথ্যা বলেছি বলে যদি আপনার মনে হয়, তাহলে আমার এই কথা সত্য যে, আমি এ পদের যোগ্য নই, কেননা মিথ্যাবাদী ব্যক্তিকে বিচারপতির পদে নিযুক্ত করা যায় না।’
ইমাম সাহেবের এ দুঃসাহাসিক বক্তব্য শুনে দরবারের সবাই বিস্মিত হয়ে পড়েন। অতঃপর মনসূরের নির্দেশে ইমাম সাহেবকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তিনি কারাগারে তার দরস চালু রাখেন। তার অজ্ঞাতসারে মনসূর তাকে বিষপান করান। তিনি যখন বিষক্রিয়া অনুভব করেন, তখন সেজদায় রত হয়ে পড়েন এবং এ অবস্থায় হিজরি ১৫০ সালে ইন্তেকাল করেন।
৩. হজরত ইমাম বোখারী (রহ.): ‘আমিরুল মোমেনীন ফিল হাদীস’, অর্থাৎ হাদীস শাস্ত্রে আমিরুল মোমেনীন উপাধিতে ভ‚ষিত হজরত ইসমাঈল বোখারী (রহ:) সকল শাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করার পর তাঁর বিশ^ বিখ্যাত হাদীস ‘জামে সহীহ’ রচনা শেষ করেন এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তখন শহরবাসীগণ তাকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন, এমনকি তাকে দীনার-দেরহাম উপহার দিয়ে তাকে সম্মান্নিত করেন।
তার প্রতি মানুষের অগাধ ভক্তি ও অসাধারণ মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা প্রদর্শনে দুনিয়াপ্রেমিক স্বার্থান্নেষী ধর্ম ব্যবসায়ী ‘উলামা সু’ হিংসায় জ¦লে উঠে। তারা বোখারার শাসনকর্তা আমির খালেদ ইবনে আহমদ আয সুহলীকে ইমাম বোখারী (রহ.)-এর উচ্চ মর্যাদার ভয় দেখিয়ে বিভ্রান্ত করে।
আমির ইমাম সাহেবের নিকট লোক প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য, তিনি জামে বোখারী ও ইতিহাস তার বাসভবনে গিয়ে পড়াবেন। ইমাম সাহেব আমিরের প্রেরিত লোককে বলে দিলেন, ‘আমিরকে বলে দেবে যে, আমি দ্বীনের ইলমকে অপমান করতে পারি না যে, তা সুলতান ও আমিরদের দ্বারে দ্বারে নিয়ে বেড়াব। আমিরের যদি হাদীসের ইলমের প্রয়োজন ও তা শেখার আগ্রহ থাকে তা হলে তাকে আমার গরিব খানায় অথবা আমার মসজিদে এসে সাধারণ লোকদের সাথে পড়তে হবে অথবা হাদীস শ্রবণ করতে হবে।’
আমির এ নির্ভীক জবাব শুনে দারুণভাবে অসন্তুষ্ট হন এবং তাকে বোখারা হতে নির্বাসিত করেন। এমনকি ইমামুল মোহাদ্দেসীনের প্রতি কুকুর পর্যন্ত লেলিয়ে দেয়া হয়। তিনি সেখান থেকে খরতং এলাকার সমরখন্দে চলে যান এবং হিজরি ২৫৬ সালে সেখানে ইন্তেকাল করেন। বোখারার অধিবাসীরা ইন্তেকালের খবর শুনার পর তার মাজারে এসে তবারক হিসেবে এত বিপুল পরিমাণে কবরের মাটি নিয়ে যায় যে, সরকারের পক্ষ হতে কয়েকজন চাকর রাখা হয়, তারা প্রতিদিন কবরে মাটি ঢালত এবং এভাবে কবরের সুরক্ষা বিধান করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন