বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

নেশাসক্ত ও উচ্ছৃঙ্খল খেলোয়াড় দিয়ে ফুটবলের উন্নতি আশা করা যায় না

প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ
বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কোনটি- এ প্রশ্ন যদি করা হয়, তবে সকলেই একবাক্যে বলে দেবেন ক্রিকেট। দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে ক্রিকেট এখন উন্মাদনার বিষয়। বাংলার দামাল ক্রিকেটাররা বিশ্ব ক্রিকেটাঙ্গনে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে একের পর এক সাফল্য এনে দিচ্ছে। ক্রিকেটের পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশকে এখন সমীহ করে। তাদের প্রত্যেককেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হারিয়েছে। ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ এখন আর অচ্ছুৎ বা হঠাৎ জয় পাওয়া দল নয়। ধারাবাহিকভাবেই তার সাফল্য লক্ষ্য করা যায়। ক্রিকেটের এই অভাবনীয় উন্নতি এবং বিশ্বে শক্ত প্রতিপক্ষ দলে পরিণত হওয়া নিয়ে দেশের মানুষের আনন্দ ও গর্বের সীমা নেই। ক্রীড়াঙ্গনে এখন তাদের আশার একমাত্র প্রদীপ ক্রিকেট। অথচ সত্তর-আশির দশকে ক্রিকেট নিয়ে মানুষ চিন্তাই করত না। তাদের মনপ্রাণজুড়ে ছিল কেবল ফুটবল। ফুটবলই ছিল তাদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা। গ্রামে-গঞ্জে-শহরে, পাড়া-মহল্লায় ফুটবলের যত টুর্নামেন্ট হতো, অন্য কোনো খেলা নিয়ে তা হতো না। এমনকি বিকেলে খেলা বলতে কিশোর-যুবারা ফুটবলই বুঝত। বৃষ্টি-বাদলা হলে তো কথাই নেই। দল বেঁধে মাঠে নেমে পড়ত। অসম্ভব জনপ্রিয় এই ফুটবলের এখন কী অবস্থা? কোন পর্যায়ে আছে? এ প্রশ্নের উত্তর বোধকরি সকলেরই জানা। সকলেই একবাক্যে বলবে, ফুটবল শেষ। এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এ দিয়ে কিছু হবে না। ক্রিকেটই আমাদের একমাত্র ভরসা।
দুই.
আমাদের ফুটবল এখন এতটাই দৈন্যদশায় উপনীত এবং অধঃপতিত যে, তা কল্পনাও করা যায় না। নব্বই দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত ফুটবল নিয়ে দেশের মানুষের যে উন্মাদনা ছিল, তা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে। ফুটবলের যে উন্নতিটুকু ছিল, সেটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। তা না হলে যে মালদ্বীপকে একটা সময় বাংলাদেশ পাত্তাই দিত না, সেই মালদ্বীপের কাছে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে কেন ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত হবে? এই মালদ্বীপকেই তো ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ৮-০ গোলে হারিয়েছিল। শুধু মালদ্বীপ কেন, আফগানিস্তানের মতো দলের কাছেও এখন বাংলাদেশ হারে। একটু শক্তিশালী দল হলে তো হালি হালি গোল খায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশ ৫৫ গোল খেয়েছে। দিয়েছে মাত্র ১১টি। ৪টিতে জয়, ৩টিতে ড্র আর ১৩টিতে হার। এর মধ্যে আফগানিস্তানের সাথে ৪ গোল, তাজিকিস্তানের সাথে ৫, জর্ডানের কাছে ৮ গোলে হেরেছে। আর গত মঙ্গলবার এশিয়ান বাছাইপর্ব প্লে-অফ ম্যাচে অতি দুর্বল দল ভুটানের সাথে গোলশূন্য ড্র করেছে। ফুটবলের সোনালী সময় বলে গণ্য আশি ও নব্বই দশকে এ চিত্র কল্পনাও করা যেত না। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের একমাত্র শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে ছিল শুধু ভারত। দুই দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো। ধরেই নেয়া হতো এই অঞ্চলে সাফসহ যে কোনো টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হবে হয় বাংলাদেশ, না হয় ভারত। এ ধারণা এখন কল্পনাতীত। বাংলাদেশের ফুটবলের কেন এই অবনতি, কেন তা এভাবে পথ হারাল? স্টেডিয়ামের গেট খুলে দিয়ে মাইকিং করেও কেন দর্শক টানা যাচ্ছে না? বিনা টিকিটেও কেন গ্যালারির এক-তৃতীয়াংশও ভরে ওঠে না? ফুটবল নিয়ে এমন অসংখ্য প্রশ্ন এখন করা যায়। এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পাওয়া মুশকিল। আমরা যদি ফ্ল্যাশব্যাকে সত্তর-আশি বা নব্বই দশকে ফিরে যাই, তাহলে দেখব, সে সময় ফুটবলের কী উন্মাদনা ছিল। ফার্স্ট ডিভিশন, প্রিমিয়ার ডিভিশন এমনকি সেকেন্ড ডিভিশন ফুটবল লীগে গ্যালারিতে দর্শক উপচে পড়ত। যেদিন আবাহনী-মোহামেডানের খেলা থাকত, সেদিন তো দুই দলের ভক্তদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করত। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে এই দুই দলের দর্শকদের আসন সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি ছিল, এখনো আছে। খেলার দিন টিকিট পাওয়া নিয়ে মারামারি ছিল নিত্যকার ঘটনা। খুনোখুনিও হয়েছে। খেলা বিকেলে বা সন্ধ্যায় শুরুর সময় নির্ধারিত হলে সকাল থেকে দর্শক স্টেডিয়ামে গিয়ে বসে থাকত। যারা স্টেডিয়ামে যেতেন না, তারা বিটিভি দেখতেন কিংবা রেডিও কানে দিয়ে শুনতেন। যে দলই জিতুক তাদের আনন্দ আর উল্লাসের সীমা থাকত না। ব্যান্ড-বাদ্য নিয়ে আনন্দ মিছিল করত। গরু জবাই করে খাওয়া-দাওয়ারও আয়োজন করা হতো। যে দল হেরে যেত সে দলের ভক্তরা শোকে পাথর হয়ে যেত। লজ্জায় প্রতিপক্ষের সমর্থকদের সামনে পড়তে চাইত না। নিজেরাই খেলা নিয়ে চূলচেরা বিশ্লেষণে বসে যেত। অমুকে এ ভুল পাস দেয়ায়, ডিফেন্ডার ঠিকমতো বল ক্লিয়ার করতে না পারায় বা স্ট্রাইকার সহজ সুযোগ মিস না করলে বা বারের ওপর দিয়ে বল আকাশে পাঠিয়ে না দিলে হারতে হতো না। অন্যদিকে বিজয়ী দলের ভক্তরাও আফসোস করত এই ভেবে, অমুক প্লেয়ার বক্সের ভেতর থেকে ঠিকমতো বলে টোকা দিতে পারলে আরও বেশি ব্যবধানে জিততে পারতাম। ফুটবল নিয়ে সেসময় এমন দৃশ্য ছিল অতি সাধারণ বিষয়। ফুটবল তারকাদের নিয়ে মাতামাতির শেষ থাকত না। তাদেরকে এক নজর দেখার জন্য অনুশীলন মাঠের চারপাশে ভিড় জমে যেত। সালাউদ্দিন, সালাম, ওয়াসিম, জসি, আসলাম, মুন্না, কায়সার হামিদ, মহসিন, পনির, নকিব এমন আরো অনেক ফুটবলার স্ব স্ব দলের ভক্তদের কাছে গর্বের বিষয় ছিল। এ নামগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। মনে আছে, তখন দল বদলের মৌসুম এলেই এসব ফুটবলার কে কত টাকায় দল বদল করছে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতো। মৌসুমের সবচেয়ে দামি ফুটবলার কে হতে যাচ্ছেন, এ নিয়ে ভক্তদের আগ্রহের সীমা ছিল না। যতদূর মনে পড়ে, ’৯২ সালে আবাহনীর তারকা ডিফেন্ডার মরহুম মোনেম মুন্নাকে মোহামেডান নিতে চেয়েছিল। তার পারিশ্রমিক উঠে সর্বোচ্চ ২৯ লাখ টাকা। তখন এ পারিশ্রমিকের কথা চিন্তাও করা যেত না। শেষ পর্যন্ত মুন্না দলের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে আবাহনীতেই থেকে যান। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে মুন্নাই সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকধারী ফুটবলার হয়ে রয়েছেন। তার এই পারিশ্রমিক উঠেছে কেবলমাত্র ফুটবলের প্রতি মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা ও টানের কারণে। মানুষ যদি ফুটবলের প্রতি এই অনুরাগ না দেখাত, তাহলে ফুটবলারদের দামও এত বৃদ্ধি পেত না, উন্মাদনারও সৃষ্টি হতো না। সে সময় শুধু দেশি ফুটবলারই নন, বিদেশি খেলোয়াড়ের কোটায় খেলতে আসা অনেক ফুটবলারও তারকাখ্যাতি পান। এদের মধ্যে এমেকা, নালজেগার, পাকির আলী, প্রেমলাল, শামির সাকির, চিমা ওকেরিদের কথা ফুটবল ভক্তরা এখনো স্মরণ করেন। ফুটবল নিয়ে ভক্তদের তখন এতটাই উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল যে, ’৮৫ সালে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের কিশোর দল ডানা কাপ জিতে আসায় ধরেই নিয়েছিল অচিরেই বাংলাদেশ ফুটবল দল বিশ্বকাপে খেলবে। ভক্তদের এই আশা বাড়াবাড়ি মনে হলেও ফুটবলের প্রতি তাদের এই সুতীব্র আশা-আকাক্সক্ষা আর ভালোবাসা উপেক্ষণীয় ছিল না। কতটা প্রিয় হলে আমাদের ফুটবল নিয়ে এমন আশা করা যায়! ফুটবলের প্রতি দর্শকের এই প্রত্যাশা ও ভালোবাসাই ফুটবলের এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তি হয়ে ছিল। শুধু দেশের ফুটবল নিয়েই নয়, বিশ্বকাপ নিয়েও বাংলাদেশে যে উন্মাদনা দেখা গেছে, তা ছিল বিস্ময়কর। ’৮৬ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ফুটবলার ম্যারাডোনাকে মেক্সিকোর রেফারি এডগার্ডো কোডেসাল লালকার্ড দেখিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে আমাদের দর্শকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ সময়ের মতো তখন যদি ফেসবুক বা টুইটার থাকত, তাহলে তাদের এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ কতটা ছিল, তা কিছুটা হলেও পরিমাপ করা যেত। শুধু সাধারণ ফুটবলপ্রিয়রাই নয়, জাতীয় সংসদেও তখন সংসদ সদস্যরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সমস্বরে তারা সবাই কোডেসালের তীব্র নিন্দা করেন। অথচ ম্যারাডোনা তখন বাংলাদেশ নামক দেশটিকেই চিনতেন না। তার পক্ষ হয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনার বিষয়টি যখন তাকে জানানো হয়, তখন তিনি রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের ফুটবল পাগল মানুষের এই আবেগ, উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসা এখন যেন উবে গেছে। দেশে ফুটবল বলে যে একটা খেলা আছে, তা যেন তারা ভুলতে বসেছে। যারা মনে রেখেছেন তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কোথায় গেল সেদিন! আমাদের ফুটবলের কেন এমন দুর্গতি হলো?
তিন.
খেলাধুলার মানের উন্নতি-অবনতি হতে পারে। একটি দল যে সবসময় তুঙ্গে থাকবে, এমন কোনো কথা নেই। আবার তুঙ্গে থাকা দলটির নিচে নেমে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, দলটি ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। তার স্ট্যান্ডার্ড একেবারে তলানিতে চলে গেল। যে দল তার সামর্থ্য অনুযায়ী একটি জায়গায় পৌঁছায়, তা থেকে সাময়িক অবনমন হতে পারে। তবে তার স্ট্যান্ডার্ড ঠিকই থাকে এবং ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্যও থাকে। কেন দল খারাপ করছে এ নিয়ে আলোচনা বিশ্লেষণ হয়। কোচ, নীতিনির্ধারক ও খেলোয়াড়দের মধ্যে বৈঠকের মাধ্যমে তাদের সক্ষমতার ঘাটতি কোথায় বা কোথায় ভুল হচ্ছে, এসব বিষয় শনাক্ত করে উন্নতির দিক নির্দেশনা তৈরি হয়। কঠোর পরিশ্রম ও সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে তা কাটিয়েও ওঠে। বাংলাদেশের ফুটবলের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। খেলাটি অতুঙ্গ থেকে যে নিচে পড়ল, আর দল উঠেই দাঁড়াতে পারছে না। দিন দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে। প্রায় দুই দশক হতে চলল, ফুটবল নিস্তেজ হয়ে আছে। দর্শকও উৎসাহ হারিয়ে ফুটবল ভুলতে বসেছে। ফুটবলের দিকে তাদের মুখ যেন কিছুতেই ফেরানো যাচ্ছে না। তাদেরকে ফুটবলের সোনালী সময়ের কথা স্মরণ করেই তৃপ্ত থাকতে হচ্ছে। ফুটবল যেন তাদের কাছে এখন ইতিহাস। বাংলাদেশের ফুটবলের এই দুর্দিন কবে কাটবে, তা কেউ জানে না। মালদ্বীপের কাছে ৫-০ গোলের ব্যবধানে হারার পর ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট প্রখ্যাত ফুটবলার সালাউদ্দিন স্বয়ং হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমি আর কী করতে পারি। আমি তো খেলে দিতে পারি না মাঠে নেমে।’ মালদ্বীপের কাছে বাংলাদেশের হেরে যাওয়া দেখে আশির দশকের আবাহনীর ঘরের ছেলে হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কার ফুটবল তারকা পাকির আলী হাহাকার করে বলে উঠেছেন, ‘আগের বাংলাদেশ তো এমন ছিল না। কোথায় হারালো সেই বাংলাদেশ।’ বাংলাদেশের সদ্য বিদায়ী কোচ ফাবিও লোপেজও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্রƒপ করে লিখেছেনÑ ‘এটিই বাংলাদেশের ফুটবলে সবচেয়ে মেধাহীন প্রজন্ম। ফেইক, ফেইক। বাংলাদেশের এই ফুটবলারদের সামর্থ্যই আসলে নেই।’ তবে বাংলাদেশের এই প্রজন্মের ফুটবলারদের খেলার সামর্থ্য না থাকলেও অন্য সামর্থ্য যে আছে তা একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত সাফ ফুটবলের পর দলে শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিয়েছে। খেলোয়াড়দের অনেকেই মদপানে আসক্ত। তাদের মধ্যে আত্মনিবেদনের অভাব স্পষ্ট। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা বেশির ভাগ ফুটবলারই দিনের অপরিহার্য কাজ মনে করেন। মালদ্বীপ যাওয়ার আগে-পরে মালে পৌঁছে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন তারা। পরদিন খেলা থাকলেও রাত জেগে ফেসবুকে পড়ে থাকেন অনেকে। এমনকি মাঠে ঢুকেও এই কাজ কোনো কোনো ফুটবলার করেন। পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বর্তমান প্রজন্মের ফুটবলারদের চারিত্রিক এই বৈশিষ্ট্য দেখে হতবাক ও বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। তারা যে খেলার সামর্থ্যরে চেয়ে মদ্যপান এবং ফেসবুক ও সেলফি নেশায় পারদর্শী তা প্রতিবেদন থেকেই স্পষ্ট। এটা কী ভাবা যায়, একটি জাতীয় দলের খেলোয়াড় নেশাগ্রস্ত হবেন! চরম উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হবেন! এমন উচ্ছৃঙ্খল ও নেশাসক্ত খেলোয়াড় কী করে জাতীয় দলে ঠাঁই পান, দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন! দেশের মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত এবং রাষ্ট্রের অর্থের অপব্যয় করার, এ অধিকার তাদের কে দিয়েছে? তারা কী করে জাতীয় দলে সুযোগ পান? ফুটবল ফেডারেশন বা নির্বাচকরা কি এ দায় এড়াতে পারেন? মদ্যপ ও মাতাল শ্রেণির খেলোয়াড়দের দোষ দিয়ে লাভ কি! তারা তাদের চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। মূলত তাদের যারা নির্বাচিত করেছেন, সেই নির্বাচকম-লী সর্বোপরি ফুটবল ফেডারেশনকেই এ দায় বহন করতে হবে। তারা দলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে যেমন ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি ফুটবলারদের শৃঙ্খল করতে এবং দেশের প্রতি তাদের দায়বোধ ও দেশপ্রেম সৃষ্টি করতে পারেননি।
চার.
বাংলাদেশের ফুটবলের যতটুকু উন্নতি ছিল এবং দর্শকের মধ্যে যে উন্মাদনা ছিল ফুটবল ফেডারেশন  সেই উন্নতি এবং উন্মাদনা যে ধরে রেখে এগিয়ে নিয়ে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, তা আজকের অভাবনীয় অবনতি দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না। যে মালদ্বীপ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভুটান বাংলাদেশের ভয়ে তটস্থ থাকত, জেতার স্বপ্ন দূরে থাক, হারার ব্যবধান কত কম হয়, এ হিসাব করত, সেই তারাই এখন বাংলাদেশকে হারায় এবং হারানোর হুমকি দেয়। শক্তি-সমর্থ্যে দেশগুলো কী উন্নতিই না করছে!  খেলা দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, তারা এগিয়ে চলেছে। আর বাংলাদেশ কেবল পিছিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক যুগে এসে ফুটবলের কত কি বদলে গেছে! ট্রেনিংয়ের ধরণ থেকে শুরু করে খেলার পদ্ধতি বদলেছে। বাংলাদেশ কি এর সাথে তাল মেলাতে পেরেছে? ভাবতে অবাক লাগে এনালগের যুগে যে ফুটবল দর্শক মাতিয়েছে, এই ডিজিটাল যুগে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়েও সেই ফুটবল দর্শককে কোনোভাবেই আকৃষ্ট করতে পারছে না। অথচ বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এখনই সবচেয়ে দামি বিদেশি কোচিং স্টাফ। টম সেন্টফিটের মতো আন্তর্জাতিকমানের কোচ, ব্রিটিশ টেকনিক্যাল ডিরেক্টর, দক্ষিণ আফ্রিকান ট্রেনার, নিউজিল্যান্ডের গোলরক্ষক কোচ। এই চার বিদেশি কোচের পেছনে বেতন হিসেবে মাসে ৩০ হাজার ডলার বা ২৪ লাখ টাকা এবং থাকা-খাওয়াসহ আরও ১০ হাজার ডলার বা ৮ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। বিপুল অংকের টাকার ব্যয়ের প্রতিফলন মাঠে নেই। শুধু কোচিং স্টাফই নয়, অনুশীলন ও ফিটনেসের আধুনিক সরঞ্জামাদিও এ সময়ের ফুটবলে যুক্ত হয়েছে। বলা যায়, ফুটবল এখন হাতে-কলম থেকে কম্পিউটারাইজড ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে। সালাউদ্দিন-সালামরা কি তাদের সময়ে এসব সুযোগ-সুবিধার কথা কখনো চিন্তা করেছিলেন? অথচ শত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে কঠোর পরিশ্রম ও শৃঙ্খলবদ্ধ জীবনযাপনের মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে দর্শকের মনের মণিকোঠায় নিয়ে গেছেন। তাদের দেখে এবং আদর্শ মেনে অনেক তরুণ উদ্বুদ্ধ হয়েছে এবং ফুটবলার হয়েছে। তাদের দেখে এবং তাদের সাথে খেলে নিজেদের ধন্য মনে করেছে। সাধারণত জাতীয় দলে সেসব ফুটবলার সুযোগ পান, যারা দেশের সেরা এবং দেশের সম্মানের জন্য নিবেদিত প্রাণ। এ সময়ে এসে আমরা দেখছি, মদ্যপ ও নেশাসক্তরা জাতীয় দলে ঠাঁই পাচ্ছেন। এই যদি হয় জাতীয় দলের অবস্থা, তাহলে আমাদের ফুটবলের উন্নতি আশা করা যাবে কীভাবে। এসব ফুটবলারকে দেখে আদর্শ মনে করে তরুণদের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বরং তাদের প্রতি অনীহা ও অশ্রদ্ধায় মুখ ফিরিয়ে নেবে। বলাবাহুল্য, বর্তমানে যেসব ফুটবলার রয়েছেন, তাদের অনেকের নামই দর্শক জানে না। যে দেশে আইকনিক ফুটবলার দেখা যায় না, সে দেশে ফুটবলের উন্নতি হতে পারে না। এ বিষয়টি আমাদের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাদের বুঝতে হবে এবং বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমরা দেখেছি, ফুটবলের উন্নতির চেয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ফেডারেশনের চেয়ারে বসা নিয়ে প্রতিযোগিতা, কোচ নিয়োগ ও বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক আওয়াজ দিতে। অথচ খেলার কোনো উন্নতি নেই। এতে প্রতীয়মান হয়, ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার যেমন একটি প্রবণতা রয়েছে, তেমনি খেলোয়াড়দের মধ্যেও চরম বিশৃঙ্খল এবং উন্নাসিকতা দেখা দিয়েছে। যে যার মতো চলছেন। এর ফলে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে গেলেও বিনিময়ে ফুটবল থেকে গ্লানি ও অসম্মান ছাড়া কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন